'ড. ইউনূস একটা চোর', এটা শুনতে পারলে এ দেশের এক শ্রেণীর সম্বাদিক নামের প্রাণী প্রচণ্ড আনন্দ উত্তেজনা অনুভব করেন। যেটি হয়ত তারা বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের হারেও অনুভব করেন না। ইউনূসকে ঘিরে দেশীয় গণমাধ্যমের অরুচিকর নোংরামি। এটা আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি ।
দেশের বহু চুরি, ডাকাতি ও লুটের খবর এদের মন খারাপ হয়, লুকুচুরি খেলে, এটাকে হালাল করার তরিকা আবিষ্কার করে এ সব নিম্ন রুচির লোকেরা। সম্বাদিকতা জগতকে এরা কুলষিত করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েব ভিত্তিক পত্রিকা “দি ডেইলি কলার” গত ১৭ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম এতে এতটাই উত্তেজেতি বোধ করে, এ বিষয়ে অভিযুক্তের বক্তব্য জানার ফুসরত পর্যন্ত পায়নি। একমাত্র ইংরেজি দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট দেখলাম তারা ঘটনা সম্পর্কে ইউনূস সেন্টারের কাছে জানতে চেয়েছে, বাকিদের জানার দরকার নেই। উঠতে বসতে আমেরিকাকে গালি দেওয়া কিছু লোকও ভুল রিপোর্টটি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ছেপে দিয়েছে। আহা কি দারুণ নৈতিক সম্বাদিকতা।
আর ইউনূস বেচারাও বিষয়টা আমলে নিলনে না প্রথমে, পরে অবশ্য একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে, দেমাগি-দলদাসত্বের সম্বাদিকতার জগতে জ্ঞানীর কদর থাকবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।
“Disgraced Clinton Donor Got $ 13 Million in State Department Grants Under Hillary” শিরোনামের রিপোর্টে বলা হচ্ছিলো- প্রফেসর ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন সরকারের অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর ক্ষমতাশালী বন্ধু সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁকে এই অর্থ পেতে সাহায্য করেছেন। প্রতিবেদনটিতে আরেকটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলা হয়েছে যে, প্রফেসর ইউনূস মিসেস ক্লিনটনের পারিবারিক ফাউন্ডেশনকে অনুদান দিয়েছেন। এতে এমন একটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে মিসেস ক্লিনটনের পারিবারিক ফাউন্ডেশনকে অনুদান দিয়েছেন বলেই প্রফেসর ইউনূস মার্কিন সরকারের নিকট থেকে অনুদান পেয়েছেন।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে যে দুর্নীতির অভিযোগে প্রফেসর ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়েছিল। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ইচ্ছাকৃত অপপ্রচার।
ইউনূস সেন্টার এ রিপোর্টের ব্যাখ্যায় বলছেন, ' প্রথমত, প্রফেসর ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন সরকারের কোন টাকা গ্রহণ করেননি। উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য সৃষ্ট এজেন্সীগুলো কোন ব্যক্তিকে অর্থ দিতে পারেই না। রিপোর্টটিতে সম্পূর্ণ একটি মিথ্যা প্রচারিত হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রফেসর ইউনূসকে ১৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়া হয়েছে। একজন ব্যক্তিকে টাকা দেয়ার কোন ক্ষমতা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেই। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদারককারী সংস্থা এটা হতে দেখলেই এ ব্যপারে বড় রকম একটা প্রতিবাদ জানাতো। প্রতিবেদনটি মার্কিন সরকারের সংস্থাগুলির কাজ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ একটা মিথ্যা ধারণার সৃষ্টি করেছে।'
'দ্বিতীয়ত, পত্রিকাটি বলছে যে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের ওয়েব সাইটে পাওয়া তথ্য থেকে তারা জানতে পেরেছে যে প্রফেসর ইউনূস ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে একবার ১ লক্ষ ডলার, আরেকবার ৩ লক্ষ ডলার অনুদান দিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের ওয়েব সাইটে এরকম কোন তথ্যই নেই। অনুদান বা অন্য কোন খাতে প্রফেসর ইউনূসের কোন নামই ওয়েব সাইটে নেই। গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভে যোগদান করার জন্য ফি বাবদ টাকা দিয়েছেন এটার উল্লেখ আছে। ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এখানে যোগ দিতে হলে ফি দিয়ে যোগদান করতে হয়। গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফি দিয়ে তাই করেছেন।'
https://www.clintonfoundation.org/contributors?category=$100,001 to $250,000&page=2
এই ওয়েব সাইটে কোথাও কোনো তালিকায় দাতা হিসেবে প্রফেসর ইউনূসের কোনো নাম নেই। অথচ প্রতিবেদনে এই মিথ্যাটাই সাজিয়ে প্রচারিত হয়েছে। এমনকি শিরোনামেও সজোরে তাই প্রচার করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, পত্রিকাটি তার প্রতিবেদনের শিরোনামে “অপমানিত” শব্দটির পরিবর্তে “বিপুলভাবে সম্মানিত” কথাটি ব্যবহার করলে তা যথার্থ হতো কারণ প্রফেসর ইউনূসকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ২০১০ সালে “কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল” প্রদান করে যা প্রতিনিধি পরিষদে উভয় দলের প্রতিনিধিদের বিপুল ভোটে ও সিনেটে উভয় দলের সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করা হয়। এছাড়াও প্রফেসর ইউনূস ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নিকট থেকে “প্রেসিডেনসিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম” গ্রহণ করেন। তাঁকে “বিশ্ব খাদ্য পুরষ্কার” (১৯৯৪), “কেয়ার হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড” (১৯৯৩) সহ অসংখ্য পুরষ্কার এবং মার্কিন সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে গত তিন দশক ধরে অসংখ্য সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।
ইউএসএআইডি-র ১৩ মিলিয়ন ডলার কোথায় গিয়েছে? গত অনেক বছর ধরে পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে “গ্রামীণ” ও “ইউনূস” নাম ধারণ করে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস এবং গ্রামীণ নামের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁর আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে এই সকল প্রতিষ্ঠান এই নাম গ্রহণ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান সেসব দেশে দরিদ্রদের সেবা প্রদান করতে ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে সৃষ্টি করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম দু’টি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে গ্রামীণ ফাউন্ডেশন ও গ্রামীণ আমেরিকা। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে ১৯৯৮ সালে গ্রামীণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর ২০টি দেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচিকে অর্থ সহায়তা দিতে এই প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ১৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক দাতাদের মধ্যে ইউএসএআইডি গত দশ বছরে একটি ক্ষুদ্র দাতা মাত্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ধনী ও নিবেদিতপ্রাণ রিপাবলিকান তাঁর নিজ অর্থে ২০০৮ সালে নিউ ইয়র্কে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকরণে গ্রামীণ আমেরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত সফল হওয়াতে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সম্প্রসারিত হতে থাকে। এখন আমেরিকার ১১টি শহরে গ্রামীণ আমেরিকার কর্মসূচি চালু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি যতই সম্প্রসারিত হয়েছে, ততই আরো বেশী টাকার প্রয়োজন হতে থাকে। প্রতিষ্ঠাতা নিজের অর্থে এটা বড় করা যাচ্ছিল না বলে তিনি বাইরে থেকে অর্থ সংগ্রহে লেগে যান। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর সময় ও শ্রম দিতে থাকেন। এতেও তিনি সফল হন। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ৬৫,০০০ মহিলা ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে এ পর্যন্ত ৩৮০ মিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছে যার আদায় হার ৯৯% এর বেশী। গ্রামীণ আমেরিকার কর্মসূচিতে ইউএসএআইডি-র সংশ্লিষ্টতা অত্যন্ত সামান্য। ইউএসএআইডি-র তহবিল পেয়েছে এরকম আরেকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে “ইউনূস সামাজিক ব্যবসা” যা ২০১২ সালে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের দু’জন তরুণ মহিলা পেশাজীবি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান কার্যালয় জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্টে অবস্থিত। “ইউনূস সামাজিক ব্যবসা” ব্রাজিল, কলম্বিয়া, হাইতি, আলবেনিয়া, বসনিয়া, মেসিডোনিয়া, তিউনিসিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া ও ভারতে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি এই দেশগুলোতে ৮.৬ মিলিয়ন ডলারের বেশী মূলধন বিনিয়োগ করে ৩৪টি সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে সামাজিক ব্যবসা তহবিল প্রতিষ্ঠা করেছে।
প্রফেসর ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণ ও সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনেক ডোনার, ব্যাংক, বিত্তশালী ব্যক্তি ও বিনিয়োগকারী অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন। ইউএসএআইডি এই বহুসংখ্যক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মাত্র একটি। ইউএসএআইডি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কাজের গুণগত মানের জন্য অর্থ সহায়তা দিয়েছে, কোন উচ্চ পদে আসীন কারো বন্ধুকে খুশী করতে নয়।
এই প্রতিবেদনটির উদ্দেশ্য যদি সৎ হতো তাহলে তথ্য অনুসন্ধানের সামান্যতম চেষ্টা করলেই তারা তা জানতে পারতো, সত্যের সন্ধান পাওয়া যেতো। সমস্ত প্রতিবেদনটি জুড়ে যত সব মিথ্যা পরিবেশন করা হয়েছে তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে তারা সাংবাদিকতার প্রতি লক্ষ্য না-রেখে শুধু মিথ্যা প্রচারণায় ব্যস্ত থেকেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:৫৮