কিস্তি :: ৮৬:: যৌবনা ঝরণা, আনন্দময় পাহাড় সমুদ্র ভ্রমণ
আমারা সংখ্যায় ১৯ জন। ছুটলাম পাহাড় ও সমুদ্র দেখার জন্য। সালটা ২০০৬। ট্যুরিস্ট সোসাইটি থেকে আমার মেয়াদের শেষ দিকে ঘটনা। বরষাকাল। টুই টম্বুর কাপ্তাই লেক।
রাতে কমলাপুর থেকে বাসে চড়লাম-বাস চলছে। আমরা আড্ডায় মগ্ন। এমন আড্ডা যে, অন্যরা একটু বাঁকা চোখে তাকাচ্ছেন। সে দিকে চোখ রাখার ফুরসত নাই। মধ্যরাতে দেখলাম-ঘুম, প্রচণ্ড ঘুমে ক্লান্ত সবাই।
রাঙ্গামাটির রাস্তায় ঢুকতেই বাসের ঘূর্ণিচক্র। চোখ কচলে সকাল দেখলো সবাই। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ জমে আছে। দূরে সূর্য উঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে।
বাটফুলের পাতা ছুঁয়ে পড়ছে, অল্প আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টি। আমাদের এমন ট্যুরের জন্য জনপ্রতি ফি ছিল ১৯০০ টাকা। হোটেলে ছিলাম ৪ রাত। ঘুরেছি ৫দিন। সেই ট্যুর এতটা আনন্দঘন ছিল, সেটি এখনো আপ্লুত করে।
রাঙ্গামাটি শহর হয়ে রিজার্ভ বাজারে সিনেমা হলের সামনে নামলাম আমরা। সামনে তাকালে গ্রিণ ক্যাসল। চন্দন দা বলে গেছেন,' তারকে ভাই আসবেন।' তাই হোটেলের অন্য সহকারি ম্যানেজার ফরহাদ চাবি নিয়ে বসে আছেন।
রুম বুঝে পাওয়ার পর দেখলাম মেঘলা আকাশ বৃষ্টি ঝরিয়ে গেলো। টিপু ভাইয়ের গ্রিণ রেস্টুরেন্টের কাঠের নিচতলায় আমরা পরোটা, ডিম আর চা খেতে খেতে ভাবছিলাম, লেকে নৌকায় আজকে ঘোরা ঠিক হবে কিনা।
তবে ভাবনার আগেই কামাল হাজির, বলল- 'তারেক ভাই, কখন আসলেন?' নৌকা আনতে গেলাম বলে বের হয়ে গেলো। আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর অপেক্ষা করলো না।
কালো ছাদ অলা একটা নৌকা নিয়ে মসজিদ ঘাটে আসলো কামাল। বলল- 'এইটা বড়ো নৌকা আছে; নিয়ে আসলাম। আপনি অনেক দিন পরে এসেছেন ,তাই।'
আমরা হোটেল ফেরার দরকার মনে করিনি, উঠে পড়লাম নৌকায়। কামাল নৌকা চালাচ্ছে। সেইবার ট্যুরে ব্যাপক স্বাধীনতা উপভোগ করেছি সবাই।
এর কারণ আমরা সবাই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। দু'একজন অতিথিও ছিলো। তারাও আনন্দে কাটিয়েছেন পুরো সময়।
রাজার বাড়ি ও বৌদ্ধ বিহার হয়ে আমরা ছুটছি শুভলং। এরই মধ্যে বৃষ্টি। সবাই ভিজছি। আনন্দময় বৃষ্টিতে ভেজা কতটা উপভোগ্য সেটি সবাই জানলো আরো একবার!
সাদিয়ার অ্যাজমার সমস্যা! তাতে কি? সবাই-বৃষ্টিতে ভিজছে, আর ও নৌকার ছাদের নীচে বসে থাকবে, এটা হতে পারে না।
সবাই নৌকার ছাদে বসে আছি। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে পুরো পাহাড়, বড় বড় ফোঁটায় কাপ্তাই লেকের ওপর গড়িয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি।
বরকল মোড়টা পার হতেই একটা বড় ঝরণা চোখে পড়লো- শীতের সময় এটা থাকে না। এতজল, এত প্রাণ, এত প্রাচুর্য নিয়ে দুরন্ত একটা ঝরণা ছুটছে, সেখানে আমরা নামবো না, হতে পারে না।
হই হই করে আমরা নেমে পড়লাম, কামাল বলল, এখানে সিকিওরিটি সমস্যা থাকতে পারে। আমলে নেয়ার মত সময় ছিল না। প্রায় এক ঘন্টা বহমান ঝরণার জলে আমরা ডুবে থাকলাম। তার পর উঠতে উঠতে আরো ১৫ মিনিট।
শুভলং ঝরণাতে বর্ষায় যে পানি থাকে, ভাবনার বাইরে ছিল। সে ঝরণায় আরো দু'ঘন্টা কাটানোর পর আমাদের কারো কারো হাঁচির উপক্রম হলাে- তাহলে কী করা যায়, ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার উপায় কি? এ সব ভাবনার মধ্যে আমরা। ততক্ষণে কামাল নৌকা ভিড়ালো সেনা ছাউনির কাছে।
নৌকা থেকে নেমে সেনা ছাউনির সামনের রাস্তা ধরে শুভলং বাজারে আমরা। সৌদিয়া রেস্টুরেন্টের দরজায় আসার আগেই বুদরুজ ভাই এগিয়ে আসলেন। বললেন, আরে 'তারক' ভাই! আপনি আসবেন, আমাদের এটা 'খল' দিবেন না। করছেন কি, সবাই ভিজে আছেন, জ্বর আসবে।
বুদরুজ ভাইয়ের সাথে আমি কথা বলছি, ফাঁকে সৌদিয়া রেস্টুরেন্টের নীচতলায় চুলার পারে সবাই। শরীরটা শুকিয়ে নিলাম । এর মধ্যে বুদরুজ ভাই লেকের কালিবাউশ মৎস, পাহাড়ি সবজি আর মশুর ডাল নিয়ে খাবার রিডি করলেন।
খাওয়ার পর মিষ্টির ব্যবস্থাও করলেন বুদরুজ ভাই। লোকটাকে আমি খুঁজে বের করেছিলাম ২০০৪ সালে। সে সময় ছোট্ট একটা ঘর ছিল। লম্বা সিঁড়ি ভেঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পর বুদরুজ ভাইয়ের দোকান। সেবার আমরা সেখানে গুরুর গোশত দিয়ে একবেলা খাওয়ার সুযোগ নিয়েছিলাম।
সন্ধ্যার দিকে শহরে ফিরলাম। ক্লান্ত সবাই । তারপরেও রাতে একবার গিরিশোভায় যাওয়া চাই। ভাসমান এ রেস্তোঁরা চালায় সীমান্ত রক্ষীরা। নুডুলস, সফট ড্রিংকস দিয়েই ডিনার।
রাতের জার্ণি, সারা দিনের বৃষ্টি বিলাস মিলে ক্লান্তি ভর করেছে। ডুলুডুলু চোখ সবার। হোটেল ফেরা। চন্দন দা বসে আছেন এককাপ চা খাবেন, বলে। নিরাশ করতে পারলাম না। তার আতিথেয়তা গ্রহণ করে রুমে ঢুকলাম।
পরের দিন আমরা যাবো বান্দরবান, সে জন্য আগেই লাইনের বাসের টিকিট কেটে আনলাম।
সকাল ৭ টার দিকে আমরা সবাই বাসে উঠলাম, ১৯ জন একসাথে হবার কারণে ফিশারি ঘাট বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস এসে আমাদের হোটেলের সামনে থেকে পিক করলো।
বাস চলছে, লোকজন বাড়ছে। এক সময় লোকারণ্য পুরো বাস। দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। কেউ কেউ ছাদেও উঠেছেন।
এর মধ্যে একটা ঠালু রাস্তায় আমরা উপরের দিকে উঠবো, বাস একবার উপরে ওঠার চেষ্টা করে আবার নিচে নেমে এলো। আমরা খুব মজা পেলাম। এখন হলে নিশ্চিত ভয়ে মুখটা শুকিয়ে যেতো!
দ্বিতীয় দফা চেষ্টা করে বাস উপরে উঠতে সক্ষম হলো। এর আগে অবশ্য বাঙ্গালহালিয়া বাজারে সকালের নাশতা করেছিলাম আমরা। বাটারে ভাজা চিনি মাখানো পরোটা দিয়ে সেই নাশতাটা স্মরণীয়।
কিছু কলা ও আম কেনা হলো বাঙ্গালহালিয়া বাজার থেকে, যে গুলো খেতে খেতে আমরা দুপুর নাগাদ বান্দরবান বাসস্ট্যান্ড। এবার বাস আমাদের হোটেলে নামাতে চাইলো না। বলল, ট্রাফিক আটকাবে!
চান্দের গাড়ি ভাড়া করে হোটেলে ফিরলাম। এসহাক ভাই রুম রেডি করে দুলালকে বলে রেখেছেন, আমাদের জন্য চা এনে রাখতে, সে চা জুড়িয়ে যাচ্ছে বলে দুলাল ফোনে জানালো।
হোটেল পূরবীতে রুম বুঝে পাওয়ার পর দুপুরের খাবার হলো বাজারেই। বিকালটা কাটাতে গেলাম ধাতুজাতি মন্দির। এটাকে স্বর্ণ মন্দির বা গোল্ডেন টেম্পল নামেও ডাকা হয়। সেখানে ছবি তোলা, মন্দিরে ঘণ্টা বাজানো, দেবতার প্রাসাদ দেখা, মিউজিয়াম ঘুরে দেবতার পুকুরের জল ছুয়ে আসলাম আমরা। ঘণ্টাখানেক পরে গেলাম মেঘলাতে। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত থেকে হোটেলে ফেরা।
ফিরে ফ্রেশ হয়ে আমরা ছুটলাম সেনা কাফেতে। ক্যান্টমেন্টের সামনের এ রেস্তোরা বিত্তবান পাহাড়ি মানুষের সান্ধ্যকালীন ভোজন ও সময় কাটানোর একটা ভালো জায়গা।
সেখানে বসনিয়ান রুটি, জালি কাবাব আর স্পঞ্জের মিষ্টি দিয়ে ডিনার হলো। স্পঞ্জের মিষ্টি তারা দুর্দান্ত বানায়। রাত সাড়ে ৮ টা। উঠে দাঁড়ালাম সবাই। সাঙ্গু নদীর ওপর কাঁপতে থাকা সেতুর ওপর অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। নির্মল বাতাসে বুক ভরে যাচ্ছিলো। সাথে রাতের বান্দরবান আর সাঙ্গুর ঢেউয়ের শব্দে মোহিত হচ্ছিলাম সবাই।
সকালে পলাশকে বলা ছিল, চান্দের গাড়ি নিয়া আসতে। গন্তব্য আমাদের চিম্বুক। পলাশ সকাল ন'টার মধ্যেই হাজির। বৃষ্টি হচ্ছে। নাশতা সেরে বের হতেই দেখলাম বৃষ্টির আবহটা বাড়ছে। সেটি মানার মত মন ছিল না। আমরা বের হলাম।
১৯ জনের মধ্যে প্রায় সবাই চান্দের গাড়ির ছাদে। সারা রাস্তায় অনেক মজা হলো। অবশ্য পুলিশের চেকপোস্ট ও আর্মি পয়েন্টে ছাদ থেকে নেমে কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে। ভেতরে গুটি সুটি মেরে বসতে হয়েছিল বার কয়েক।
চান্দের গাড়ির সরাসরি চিম্বুকে। আমরা মেঘের ভেতর। অন্যরকম এক সকাল। মেঘের ভেতরে নিজেদের দেখছি। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছে। কুয়াশার মত বৃষ্টির পানি। ঘাসফুলের ডগায় জমে আছে শিশির বিন্দুর মত। তারপর আমরা নেমে আসি। নীচের ছোট্ট একটা দোকানে চা পানের বিরতি। সেখান থেকে গেলাম পাশের পাহাড়ে। দুপুরে খিঁচুড়ি খেয়ে ফিরছি।
ছাদে থাকা মিটির চোখে গাছের পাতার বাড়ি লাগলো। তবুও ওর নামার নাম নেই। অন্যরা আবারো উঠে এলো। ফেরার পথে আমরা নামলাম শৈলপ্রপাত ঝরণায়। বিশ ফুট চওড়া হয়ে পানি নেমে যাচ্ছে নিচে। এত যৌবনা ঝরণাটা আমরা শীতকালে দেখি ক্ষীণকায়।
ফারুকপাড়ার এ ঝরণার নিচের ক্যানেলে পানি অনেক। সেখানে নামলাম সবাই। অনেক্ষণ ধরে হেঁটে আবার পাহাড়ের ওপর দিয়ে ফিরে এলাম। মানিক দেওয়ানের ঘরে চা পান হলো। সঙ্গে এনার্জি বিস্কুট। এশা দেওয়ানের দোকান থেকে শাল মাফলার ও বাঁশের তৈরি কিছু মগ কেনা হলো। তারপর পলাশের তাড়ায় ফিরতে শুরু।
মিলনছড়িতে কয়েক মিনিটের বিরতিতে এককাপ কফি পান শেষে আমরা ফের শহরে। রাতে কেনাকটার নাম করে বাজারে ছোটাছুটি করলাম কিছুক্ষণ।
রাতে ঘুম, সকালে পূরবী হোটেলের নিজস্ব বাসে আমরা ছুটলাম কক্সবাজার। সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে আমরা কক্সবাজারে আসলাম। এত চমৎকার একটা পরিবেশ, মানুষ জন কম। ভালো লাগছিলো বিকালটা। বিচে অনেক সময় কাটানোর পর ফিরে এলাম রাতে।
জিয়া গেস্ট ইনের ওসমান খাবারটা হোটেলের রুমের সামনে ডায়নিং টেবিলেই ব্যবস্থা করেছিল।শুটকি ভর্তা, চান্দা মাছ আরো কি সব আনলো।
পর দিন সকাল বেলায় আমরা গেলাম বিচে। ভেজাভিজি হলো, বালি খেলাও। মামুন বালি দিয়ে কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করলো, বৃষ্টি সে সব মিশিয়ে দিলো। এভাবে দুপুর।
হোটেলে ফিরে বিকাল বেলায় আমরা চলে গেলাম ইনানী। ভেজার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, তবুও ভেজা হলো। অনেক্ষণ। ডাব, কলা এবং বাঁশের সাঁকোয় পানি পারাপার নিয়ে অনেকটা সময় কাটানোর পর ফিরে আসি হিমছড়ি। সেখানে সন্ধ্যা। পাহাড়ের চূড়ায় অনেক্ষণ আড্ডার পর বৃষ্টি ভেজা ট্যুরের সমাপ্তি।
সেই সাথে একটি আনন্দময় অভিজ্ঞতার সঞ্চয়!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৪ রাত ৯:৪০