'বাপি ; দ্যাখো ! পেটুক আঙ্কেল !'
মোটা লোকটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায় মৌ ! আমরা বাপ-বেটি মিলে ফুটপাথ ধরে হাঁটছি । আমাদের সামনের দিক থেকে আসছে লোকটি । হাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার বড় সাইজের পেটটা দুলছে । মৌ'র কথা লোকটার কানে গেছে বলে মনে হয় । তিনি হাসছেন । হাসি হাসি মুখে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন । মৌ'র মাথায় আলতো হাত রেখে চুলগুলো এলোমেলো করে দিলেন খানিকটা । চোখ বড় বড় করে মৌ তখন তার 'পেটুক আঙ্কেলকে' আরো কাছে থেকে দেখছে খুঁটিয়ে । ভদ্রলোক এক ঝলক আমার দিকে তাকালেন । মৌ'র কথায় নিদারুণ বিব্রত আমি । ভদ্রলোকের হাসির জবাবে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির মতো কিছু একটা ঝুলিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। সেটা কদ্দুর কি হলো জানিনা, ভদ্রলোকের দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়া দেখে সুবিধের কিছু যে হয়নি, তা অনুমেয় । আমাদেরকে পেছনে ফেলে ভদ্রলোক চলে গেলেন । মৌকে বললাম,-
'মা মণি ! আঙ্কেলকে পেটুক বললে যে ?'
'কত্তো মোটা না ?'
'হুঁ, মোটাতো একটু আছেই, তবে ওটা অসুখ !'
'অসুখ ?'
'হুম, ক'দিন আগে তোমার ঠান্ডা লেগে অসুখ হলো না, ওরকম অসুখ ।'
'ওনারও কি ঠান্ডা লেগেছে, বাপি ?'
'নাহ্ ! এটা অন্যরকম । তুমি বুঝবে না ।'
'তাহলে পেটুক বললে কি হয় !'
'মন খারাপ হয় । মনে কষ্ট যায় ।'
'মনে কষ্ট গেলে কি হয়, বাপি ?'
'কান্না পায় !'
'আঙ্কেলেরতো কান্না পায়নি ! আঙ্কেলতো হাসছেন !'
'তা ঠিক ! কিন্তু, তোমার যখন মন খারাপ হয়, কান্না পায়না ?'
'পায়তো !'
'তাহলে, কারুর মনে কষ্ট দেয়া কি ঠিক ?'
' না ! আঙ্কেলকে কি সরি বলা উচিত, বাপি ?'
'সেটা করতে পারলে খুব-ই ভালো হয় । কিন্তু তোমার আঙ্কেলতো আজ চলে গেছেন । পরে কোনদিন দেখা হলে, আমরা ওনাকে সরি বলবো । ঠিকাছে ?'
'আচ্ছা !' বলে নিজের কাজে মশগুল হয়ে যায় মৌমিতা । ছোট্ট ছোট্ট পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে থাকে । ওর বাম হাতটা আমার হাতে ধরা । গুনগুন করে গানও গায়তে থাকে আপনমনে । সে গানের কথা আমার কান অব্দি আসেনা । মেয়েটা আজ ভীষণ খুশী । প্রায় ও ঘুরে বেড়াতে চায়, সম্ভব হয়না । আজ ঈদ । ফাঁকা নগরীর ফাঁকা রাস্তা, ফাঁকা ফুটপাথ । আয়েশ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে ও,-সে আনন্দে আনন্দীত । নিজের ভেতরে মগ্ন ওর এই আনন্দ দেখে আমি মুগ্ধ । ভাবি, শিশুদের জগতটা কতোইনা নির্দোষ, অকৃত্রিম । কতো সহজেইনা ওরা সত্যিটা উচ্চারণ করে ফেলে । পেটুককে পেটুক বলে ফেলে । আমরা বড়োরা পারিনা । আমাদের দেশটাকে প্রতিদিন একটু একটু করে গিলে খচ্ছে যারা, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে বলতে পারিনা," আপনি জনাব, মস্ত বড়ো পেটুক !" ঘুষখোরকে বলতে পারিনা,- "ঘুষখোর !" একজন শিশু যদি ঘুষখোরকে চিনতে পারতো, নিশ্চয় বলে ফেলতো- 'ওই যে ঘুষখোর আঙ্কেল...!'
মৌ দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ । ফুটপাথের বৃদ্ধ পঙ্গু ভিক্ষুকটির ওপর তার দৃষ্টি । দু'এক টাকা
সাহায্যের জন্য তারস্বরে চিৎকার করেন বৃদ্ধ । বৃদ্ধের করুণ স্বর আহাজারীর মতো শুনায় । তার অল্প দূরেই মৌ'র বয়েসী একটি মেয়ে ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে কি যেন খায় । মৌ বললো,-
'উনি কাঁদছেন কেন, বাপি ? উনার কি অনেক কষ্ট ?'
'হ্যাঁ ।'
আমরা দাঁড়িয়ে থাকি আরো খানিকক্ষণ । ব্যস্ত পায়ে মানুষগুলো পঙ্গু ভিক্ষুককে পাশ কাটিয়ে যায় দ্রুত । কেউ ফিরে চায়, কেউ চায় না ! অভ্যস্ত চোখগুলোও মানুষের মতো সামনে ছুটে । এ যেন উজান স্রোতের বিপরীতে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দৌঁড় ! মাঝে মাঝে বৃদ্ধের দূর্ভাগ্যের আদি থালায় টুংটাং ঝংকার তোলে আধুলী-কয়েন । মৌর হাতটা আরো বেশী শক্ত করে ধরে আমিও বৃদ্ধকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় । জনগণের জীবনদৌড়ে শামিল হই ! খুব বেশী এগুতে পারিনা । রাস্তা থেকে কুড়িয়ে খাওয়া মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়াতে হয় । পা চলেনা । শীর্ণ দেহের শিশুটি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে বিস্কিট খাচ্ছে, পথচারী কারো পায়ে পিস্ট হয়ে থ্যাঁতলে যাওয়া বিস্কিট ।
পথশিশুটির সামনে গিয়ে আমি হাঁটুগেড়ে বসে পড়ি । আমি যেন নতজানু হই, লজ্জায় । বিড়বিড় করে উচ্চারণ করি,--
'তোর নাম কি রে; মা ?'
'ময়না !'
মেয়েটার গাল দুটো একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার । মেয়েটির কপালে চুমো খেতে ইচ্ছে করে । আমি পারিনা, আমাদের সভ্য সমাজে এই প্রথা চালু নেই ! মেয়েটির চেহারা ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করে । আমি আঁতকে উঠি । এই মেয়েটি অবিকল দেখতে আমার মৌমিতার মতো ! লক্ষ্য করি, মৌর হাতটি আমার হাতে ধরা নেই । চমকে ওঠে পেছন ফিরে তাকাই । মৌ নেই ! পঙ্গু বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি আমার দিকে চেয়ে হাসে ! ক্রুর হাসি । ক্রুদ্ধ হতে হতে আমি থেমে যাই । আমি আবিস্কার করি,- ভিক্ষুকটি আর কেউ নয়, আমি নিজেই !
দুঃস্বপ্ন ভেঙ্গে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসি আমি। ঢকঢক করে পানি খাই দু'গ্লাস । ঘামের তোড়ে দুঃস্বপ্নকে ভাসিয়ে দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে কিছু শব্দ গলা দিয়ে বের করে দিতে চাই, -- " আমার অনাগত শিশুর জন্য, আমার মৌ মা মণির জন্য আমি, খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি নিরাপদ পৃথিবী চাই !"