মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার মোশাররফগঞ্জ গ্রামে ১৯৩৭ সালের ১লা নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । একজন বাঙালি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা প্রধান ছিলেন । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে খালেদ মোশাররফ ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এবং 'কে-ফোর্স'-এর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। বীরত্বের জন্য তাঁকে বীর উত্তম পদক দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকান্ডের পর ৩রা নভেম্বর তারিখে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৫ই আগষ্টের কুশীলবদের হঠিয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটান এবং বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি হন । এর মাত্র ৩ দিন পরে ৭ই নভেম্বর তারিখে তিনি এক পাল্টা অভ্যুত্থানে শাহাদাত বরণ করেন ।
খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ প্রায়ই তোলা হয়। একটি হল, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মোশতাককে সমর্থনকারী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজরদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করার পর এবং সেই অভিযানে দ্রুত সফলতা পাওয়ার পরও কেন কারাগারে বন্দি জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ঠেকানো গেল না।
উল্লেখ্য, খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ফারুক-রশিদ-নূর-ডালিম চক্রের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতি নেওয়া হলেও এই সময়ে কারাগারে বন্দি জাতীয় নেতাদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে ঘাতক চক্র মোশতাক-বিরোধী এই চারজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাকে কোনো বাধা ছাড়াই হত্যা করে। আরও লক্ষণীয়, এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলদের কাছে পৌঁছায় ফারুক-রশিদ-নূর-ডালিম চক্রের সদস্যরা দেশত্যাগ করার পর।
জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা এবং তাদের হত্যা করার সংবাদ যথাসময়ে জানতে না পারা খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলদের বড় একটি ব্যর্থতা নির্দেশ করে। শাফায়াত জামিল তাঁর বইতে এই জেল হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে লিখেছেন:
“ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে যখন বাকযুদ্ধ চলছিল, তখন ঘুণাক্ষরেও আমরা জানতে পারিনি জেলে চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের কথা। অথচ আগের রাতেই সংঘটিত হয়েছিল ঐ বর্বর হত্যাকাণ্ড। ওসমানী ও খলিলুর রহমান ঐ ঘটনার কথা তখন জানতেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তারা আমাদের কিছুই জানাননি। জানালে এভাবে ১৫ আগস্টের খুনিদের নিরাপদে চলে যেতে দেওয়া হত না। আমাদের নেগোসিয়েশন টিমকেও এ বিষয়ে কেউ কিছু আভাস দেয়নি।”
পরদিন, ৪ নভেম্বর বঙ্গভবনে শাফায়াত জামিল সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে জেল হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার কথা জানার পরও তাদের এই তথ্য না জানানোর জন্য তিরস্কার করে বলেন:
“এই ডিসগ্রেসফুল আচরণের জন্য আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি।”
খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হল, তিনি কেন বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজরদের দেশত্যাগের সুযোগ দিলেন।
১৫ আগস্ট ফারুক-রশিদ-নূর-ডালিমসহ অন্যান্য মেজরদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর, সামরিক বাহিনী, রক্ষীবাহিনী বা দেশের কোনো রাজনৈতিক দল থেকে এই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত মেজরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়নি। সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট– ট্যাংক ইউনিট বেঙ্গল ল্যান্সার্স আর গোলন্দাজ ইউনিট দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট– ফারুক-রশিদদের অনুগত থাকে। ট্যাংক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের মাধ্যমে ফারুক-রশিদরা নিজেদের শক্তি টিকিয়ে রাখে। বঙ্গভবনে নতুন রাষ্ট্রপতি মোশতাকের পাশে অবস্থান নিয়ে এই ফারুক-রশিদ-নূর-ডালিম চক্র হয়ে উঠে দেশের মূল ক্ষমতার অধিকারী। ট্যাংক আর গোলন্দাজ বাহিনী রয়ে যায় সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডের বাইরে। জেনারেল জিয়া, খলিল, ওসমানী– এই শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা কেউই এই ইউনিট দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। এই ইউনিট দুটো শুধু মোশতাক এবং ফারুক-রশিদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করত।
সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান এই মেজরদের এবং সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী ইউনিট দুটোকে চেইন অব কমান্ডে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেননি। জেনারেল জিয়াকে ফারুক-রশিদ চক্র তাদের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করত না। বরং সেই সময় সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আর ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ও এই দুজনের অনুগত অন্য অফিসারদের মোশতাক এবং ফারুক-রশিদ চক্র চিহ্নিত করেছিল তাদের ‘বিরোধী পক্ষ’ হিসেবে। জানা যায়, ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের আগেই তারা সেনাবাহিনীতে নিজেদের জন্য ঝুঁকি হতে পারে এমন ৩৩ অফিসারকে বরখাস্তের একটি তালিকা তৈরি করে। এই তালিকার প্রথম নামটি ছিল খালেদ মোশাররফ।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের উৎখাত করার জন্য সরাসরি একটি সামরিক পদক্ষেপ প্রথম নেওয়া হয় ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে, খালেদ মোশাররফ আর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে। সেনা এবং বিমান বাহিনীর মূলত মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা এই অভিযানে খালেদ-শাফায়াতের পক্ষে থাকেন। এই অভিযান পরিচালনার শুরুতেই সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়। ঢাকাস্থ তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন– রক্ষীবাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে আত্তীকৃত কয়েকটি ব্যাটালিয়ন খালেদ-শাফায়াতের পক্ষে থাকে। ফারুক-রশিদের অনুগত ট্যাংক আর কামান প্রতিরোধ করার জন্য বিমানবাহিনীর অফিসাররা ব্যবহার করেন মিগ ২১ জঙ্গি বিমান এবং এম আই ৮ হেলিকপ্টার। বিমানবাহিনীর মহড়ায় ভীত হয়েই মূলত বঙ্গভবনে মোশতাকের সঙ্গে অবস্থানরত ফারুক-রশিদ চক্র পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়।
খালেদ মোশাররফের সামরিক শক্তিকে পরাজিত করতে পারবে না বুঝেই খুনি মেজররা দেশত্যাগের জন্য দেনদরবার শুরু করে। মোশতাকও তার অনুসারীদের দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়ার জন্য খালেদ মোশাররফকে অনুরোধ করেন। এই অবস্থায় খালেদ মোশাররফ খুনি মেজরদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালিয়ে তাদের পরাজিত করার চেষ্টা করতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে জঙ্গি বিমান ব্যবহার করতে হত। তাহলে একদিকে বিমান হামলা অন্যদিকে ফারুক-রশিদের অধীনে থাকা ৩০ টি ট্যাংক আর ১৮ টি কামানের গোলাবর্ষণে একটি ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি হত। হয়তো এই চিন্তা করেই খালেদ মোশাররফ আর তাঁর অনুসারীরা ফারুক-রশিদ চক্রকে আত্মসমর্পণ করানো থেকে বিরত থাকেন।
শাফায়াত জামিল তাঁর বইতে লিখেছেন: “সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয় ও বেসামরিক নাগরিকের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের দেশত্যাগের সেফ প্যাসেজ দিতে রাজি হলাম আমরা। সে সময় এটা আমাদের মনে ছিল যে, বিদেশে চলে গেলেও প্রয়োজনে পরে ইন্টারপোলের সাহায্যে তাদের ধরে আনা যাবে।”
এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়ার জন্যই যদি খালেদ মোশাররফকে এই খুনিদের সঙ্গে ‘জঘন্য আঁতাতকারী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, তাহলে তা যথার্থ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। সেই সময়ের ঘটনাবলীর দিকে তাকালে দেখা যায়, যখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অবস্থানে ছিল তখন খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানই মোশতাক এবং ফারুক-রশিদ চক্রকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। এই গোষ্ঠী খালেদ মোশাররফকে তাদের ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রথম শক্তিশালী পদক্ষেপটি খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের উদ্যোগেই গ্রহণ করা হয়। চার নেতার হত্যাকাণ্ডের খবরটি যথাসময়ে খালেদ-শাফায়াতদের কাছে পৌঁছালে হয়তো ফারুক-রশিদ চক্রকে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হত না।
জিয়াকে বন্দি করার প্রেক্ষিতে খালেদ মোশাররফকে নতুন সেনাপ্রধান করা হলেও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, খালেদ মোশাররফ সেই সময় দেশের ক্ষমতা দখলের আগ্রহ দেখাননি। প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। খালেদের সহকর্মীরা তাঁকে বার বার রেডিও-টেলিভিশনে ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ করলেও খালেদ সেই কথায় রাজি হননি। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিই কেবল ভাষণ দেবেন, খালেদ তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন।
সেই সময়ের যে ঘটনাগুলো আমরা জেনেছি তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খালেদ মোশাররফের উদ্যোগের কারণেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজররা এবং মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। খুনি মেজরদের অনুগত ট্যাংক আর গোলন্দাজ ইউনিট দুটিকেও সেনানিবাসে ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল।
খালেদ মোশাররফ তাঁর অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে কোনো রক্তপাত ঘটাননি। অথচ ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পরপরই খালেদ মোশাররফ এবং তাঁর দুই সঙ্গী, বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কর্নেল নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমকে একটি কক্ষ থেকে জোরপূর্বক বের করে গুলি করে হত্যা করা হয়। খালেদ মোশাররফ একজন আঁতাতকারী হলে কি তাঁকে এমনভাবে হত্যা করা হত?
তথ্যসূত্র:
১। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ: রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর-কর্ণেল শাফায়াত জামিল
২। গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী- মেজর নাসির উদ্দিন
৩। উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:২০