আধুনিক প্রজন্মের নাগরিক হিসেবে ভাষা আন্দোলনের বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার নেই, তখন একটু ভাবতে ইচ্ছে হয়- আমাদের জীবনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কত খানি? আমরা কি ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে জীবনাচরণের আদর্শ মনে করি নাকি কিছু উপন্যাস গল্পের নাটকের ফ্যাশনের মাস হিসেবে পালন করি। এর উত্তরে আমাদের মানসিক দরিদ্রতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। অথচ ভাষা আন্দোলনের চেতনা আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা, মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার বিকাশ করেছে। ভাষা-আন্দোলনের বহুমাত্রিক প্রভাব সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলাসহ সৃষ্টিশীলতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবদান রেখেছে।
বর্তমান প্রজন্মের এই স্মৃতিভ্রষ্টতে আমি লজ্জিত। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যতটুকু জানা তা পাঠ্যপুস্তক আর কিছু পড়াশোনার কারণে, ছোট সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল আমার কাছে উৎসবের দিন হিসেবে পরিচিত, কারণ ইটের উপর ইট দিয়ে শহীদ মিনার বানানো, বিভিন্ন জায়গা থেকে ফুল চুরি করে শহীদ মিনারে পুষ্পস্থাপন, খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে চলা, আমাদের শৈশবকে এক ধরনের দুরন্তপনা যোগ করে দিতো এই দিনটি, তার ওপর সামাজিক, কিছু ধর্মীয় অনুভূতির উপেক্ষা আমাদের করতে হতো। মোট কথা একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ছিল এক আনন্দঘন, উত্তেজনাপূর্ণ তারুণ্যের দিন।
এরপর পাঠ্যপুস্তকে একুশের গল্পের তপু এসে অনেক দিন মনে দাগ কেটে ছিল, যতবার পড়তে হতো ততবার এক ধরনের বেদনাহত হয়ে যেতাম, কিন্তু একুশের চেতনাবোধ আমাকে নাড়িয়ে তোলে । ভাষা আন্দোলনের বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকায় মাতৃভাষা কি অনুগ্রহ তা বুঝেছি অনেক দেরিতে, আমার মনে হয় এ প্রজন্ম মাতৃভাষার আবেগটা ধরতে পারছেনা, কারণ দেশের বেশিরভাগ মানুষ কথা বলতে অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে, একটু প্রতিকূল পরিবেশে পড়লেই বুঝতে পারতো আমাদের পূর্ব প্রজন্ম কি উপহার আমাদের দিয়ে গেছেন, যেমন অনেকে দেশের বাইরে গিয়ে মাতৃভাষার দরদ টা বুঝি । সেদিন জহির রায়হানকে খুব অনুভব করেছি, ‘জেলার সাহেব, জেলখানা বড় করুন। আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব।’ এই উক্তিটি অনুধাবন করতে পেরেছি। একধরনের উত্তেজনা আর নিজের ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে গর্ব ও স্বস্তিবোধ করেছি। বাঙলা ভাষার চেতনাবোধ অনুভব করি কবিতা লিখতে, প্রেয়সীর কাছে নিজের আবেগ উপস্থাপন করতে গিয়ে, সত্যি যদি মাতৃভাষা না থাকতো তাহলে কি হতো। যখন দেখি এই প্রজন্মের নাগরিকরা বাংলাকে উপেক্ষা করছে, কথা বলতে গিয়ে ভাষার শ্রুতিমাধুর্য নষ্ট করে ফেলছে, তখন তাদের প্রতি ঘৃণা ছাড়া মনে কিছু আসে না, প্রত্যেক ছাত্রের পড়ার টেবিলে একটা ডিকশনারি থাকলেও বাংলা অভিধান চোখে পড়ে কম, একুশের চেতনাবোধ এখন টিশার্টে অথবা একুশে ফেব্রুয়ারি নির্ভর হয়ে পড়েছে। কখনো কখনো বিশ্বায়নের কারণে বাংলা ভাষাকে একটু অবহেলা করছে এ প্রজন্ম। অন্য ভাষা শিখতে ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে যতটা সময় ব্যয় করছে বাংলা ভাষা চর্চা ও শুদ্ধ উচ্চারণের তত সময় আমরা ব্যয় করতে পারিনি। বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলোর মধ্যে মাতৃভাষা দিবস পালনে একধরনের স্বস্তি অনুভব করি, কেননা এই দিবস প্রধান দুই দলের ঘৃণ্য রাজনৈতিক ব্যবসার বিষয় থেকে মুক্ত।
একুশের চেতনাবোধ একধরনের সামষ্টিক ঐক্য তৈরি করে। আমার খুব ইচ্ছে হয় সিয়েরালিওনের মতো অনেক দেশ যদি বাংলাকে দ্বিতীয় মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করতো। আমার মনে হয় এটা সম্ভব, কিভাবে? এজন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরই, আমরা কেন ইংরেজি শিখি, কারণটা হলো পৃথিবীতে জীবন নির্বাহের উপকরণগুলো, উন্নত সংস্কৃতির বেশির ভাগ ইংরেজিতে পাওয়া যাচ্ছে, তাই বিশ্বব্যাপী বাংলাকে ছড়িয়ে দিতে এই সব উপকরণ আমাদেরই তৈরি করতে হবে, একদিন না একদিন বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, পৃথিবীর সকল নাগরিক আমাদের ভাষা শিখবে তাদের প্রয়োজনেই। এভাবেই বিশ্ব সাম্রাজ্য তৈরি করবো আমরা বাঙালিরাই। এ ক্ষেত্রে বাঙালির এ প্রজন্মকেই হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষার ধারক, বাহক ও প্রচারক।
একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে উপচে পড়া ভিড় আর চাক্ষুস আয়োজন আমাদের যেমন সমৃদ্ধ ইতিহাস তুলে ধরে তেমনি দিন নির্ভর সংস্কৃতি পালনে আমাদের মানসিক দরিদ্রতাও মনে করিয়ে দেয়। বর্তমান প্রজন্ম অহেতুক স্মার্ট হতে গিয়ে বাংলা ভাষাকে বিষাক্ত করে ফেলেছে, আমার মনে হয় এই সব মনগড়া গুরুত্বহীন স্মার্ট হওয়া থেকেই নিজেদের বিরত রেখে মূলধারায় ফিরে আসা এবং একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশুদ্ধ বাংলা চর্চা অব্যাহত রেখে বাঙালির আত্মমর্যাদাকে অক্ষুণœ রাখাই হোক আমাদের প্রজন্মের অঙ্গীকার। পরিশেষে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা দিয়ে শেষ করি- ১৯১৮ সালে ‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ শিরোনামে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালোবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোনো ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরমে পৌঁছে পরান আকুল করে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কল্পনা-সুন্দরী তাহার মন-মজানো ভাবের ছবি আঁকে? কাহার হৃদয় এত পাষাণ যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগে না?
আধুনিক প্রজন্মের নাগরিক হিসেবে ভাষা আন্দোলনের বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার নেই, তখন একটু ভাবতে ইচ্ছে হয়- আমাদের জীবনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কত খানি? আমরা কি ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে জীবনাচরণের আদর্শ মনে করি নাকি কিছু উপন্যাস গল্পের নাটকের ফ্যাশনের মাস হিসেবে পালন করি। এর উত্তরে আমাদের মানসিক দরিদ্রতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। অথচ ভাষা আন্দোলনের চেতনা আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা, মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার বিকাশ করেছে। ভাষা-আন্দোলনের বহুমাত্রিক প্রভাব সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলাসহ সৃষ্টিশীলতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবদান রেখেছে।
বর্তমান প্রজন্মের এই স্মৃতিভ্রষ্টতে আমি লজ্জিত। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যতটুকু জানা তা পাঠ্যপুস্তক আর কিছু পড়াশোনার কারণে, ছোট সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল আমার কাছে উৎসবের দিন হিসেবে পরিচিত, কারণ ইটের উপর ইট দিয়ে শহীদ মিনার বানানো, বিভিন্ন জায়গা থেকে ফুল চুরি করে শহীদ মিনারে পুষ্পস্থাপন, খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে চলা, আমাদের শৈশবকে এক ধরনের দুরন্তপনা যোগ করে দিতো এই দিনটি, তার ওপর সামাজিক, কিছু ধর্মীয় অনুভূতির উপেক্ষা আমাদের করতে হতো। মোট কথা একুশে ফেব্রুয়ারির দিন ছিল এক আনন্দঘন, উত্তেজনাপূর্ণ তারুণ্যের দিন।
এরপর পাঠ্যপুস্তকে একুশের গল্পের তপু এসে অনেক দিন মনে দাগ কেটে ছিল, যতবার পড়তে হতো ততবার এক ধরনের বেদনাহত হয়ে যেতাম, কিন্তু একুশের চেতনাবোধ আমাকে নাড়িয়ে তোলে । ভাষা আন্দোলনের বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকায় মাতৃভাষা কি অনুগ্রহ তা বুঝেছি অনেক দেরিতে, আমার মনে হয় এ প্রজন্ম মাতৃভাষার আবেগটা ধরতে পারছেনা, কারণ দেশের বেশিরভাগ মানুষ কথা বলতে অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে, একটু প্রতিকূল পরিবেশে পড়লেই বুঝতে পারতো আমাদের পূর্ব প্রজন্ম কি উপহার আমাদের দিয়ে গেছেন, যেমন অনেকে দেশের বাইরে গিয়ে মাতৃভাষার দরদ টা বুঝি । সেদিন জহির রায়হানকে খুব অনুভব করেছি, ‘জেলার সাহেব, জেলখানা বড় করুন। আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব।’ এই উক্তিটি অনুধাবন করতে পেরেছি। একধরনের উত্তেজনা আর নিজের ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে গর্ব ও স্বস্তিবোধ করেছি। বাঙলা ভাষার চেতনাবোধ অনুভব করি কবিতা লিখতে, প্রেয়সীর কাছে নিজের আবেগ উপস্থাপন করতে গিয়ে, সত্যি যদি মাতৃভাষা না থাকতো তাহলে কি হতো। যখন দেখি এই প্রজন্মের নাগরিকরা বাংলাকে উপেক্ষা করছে, কথা বলতে গিয়ে ভাষার শ্রুতিমাধুর্য নষ্ট করে ফেলছে, তখন তাদের প্রতি ঘৃণা ছাড়া মনে কিছু আসে না, প্রত্যেক ছাত্রের পড়ার টেবিলে একটা ডিকশনারি থাকলেও বাংলা অভিধান চোখে পড়ে কম, একুশের চেতনাবোধ এখন টিশার্টে অথবা একুশে ফেব্রুয়ারি নির্ভর হয়ে পড়েছে। কখনো কখনো বিশ্বায়নের কারণে বাংলা ভাষাকে একটু অবহেলা করছে এ প্রজন্ম। অন্য ভাষা শিখতে ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে যতটা সময় ব্যয় করছে বাংলা ভাষা চর্চা ও শুদ্ধ উচ্চারণের তত সময় আমরা ব্যয় করতে পারিনি। বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলোর মধ্যে মাতৃভাষা দিবস পালনে একধরনের স্বস্তি অনুভব করি, কেননা এই দিবস প্রধান দুই দলের ঘৃণ্য রাজনৈতিক ব্যবসার বিষয় থেকে মুক্ত।
একুশের চেতনাবোধ একধরনের সামষ্টিক ঐক্য তৈরি করে। আমার খুব ইচ্ছে হয় সিয়েরালিওনের মতো অনেক দেশ যদি বাংলাকে দ্বিতীয় মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করতো। আমার মনে হয় এটা সম্ভব, কিভাবে? এজন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরই, আমরা কেন ইংরেজি শিখি, কারণটা হলো পৃথিবীতে জীবন নির্বাহের উপকরণগুলো, উন্নত সংস্কৃতির বেশির ভাগ ইংরেজিতে পাওয়া যাচ্ছে, তাই বিশ্বব্যাপী বাংলাকে ছড়িয়ে দিতে এই সব উপকরণ আমাদেরই তৈরি করতে হবে, একদিন না একদিন বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে, পৃথিবীর সকল নাগরিক আমাদের ভাষা শিখবে তাদের প্রয়োজনেই। এভাবেই বিশ্ব সাম্রাজ্য তৈরি করবো আমরা বাঙালিরাই। এ ক্ষেত্রে বাঙালির এ প্রজন্মকেই হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষার ধারক, বাহক ও প্রচারক।
একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে উপচে পড়া ভিড় আর চাক্ষুস আয়োজন আমাদের যেমন সমৃদ্ধ ইতিহাস তুলে ধরে তেমনি দিন নির্ভর সংস্কৃতি পালনে আমাদের মানসিক দরিদ্রতাও মনে করিয়ে দেয়। বর্তমান প্রজন্ম অহেতুক স্মার্ট হতে গিয়ে বাংলা ভাষাকে বিষাক্ত করে ফেলেছে, আমার মনে হয় এই সব মনগড়া গুরুত্বহীন স্মার্ট হওয়া থেকেই নিজেদের বিরত রেখে মূলধারায় ফিরে আসা এবং একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশুদ্ধ বাংলা চর্চা অব্যাহত রেখে বাঙালির আত্মমর্যাদাকে অক্ষুণœ রাখাই হোক আমাদের প্রজন্মের অঙ্গীকার। পরিশেষে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা দিয়ে শেষ করি- ১৯১৮ সালে ‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ শিরোনামে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালোবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোনো ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরমে পৌঁছে পরান আকুল করে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কল্পনা-সুন্দরী তাহার মন-মজানো ভাবের ছবি আঁকে? কাহার হৃদয় এত পাষাণ যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগে না?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৩:২৯