গত বছর সউদী একটি টিভি চ্যানেলে আলেমগণ লাইভ প্রশ্নোত্তর দিচ্ছিলেন। একটি ফোন এলো সোমালিয়া থেকে। জনৈক দর্শক জানতে চাইলেন, আমাদের এখানে খুব খাদ্যাভাব চলছে। কিছু রোজাদার এমনও আছি যারা সাহরিতে কিছু খাইনা, ইফতারেও আমাদের খাওয়ার কিছু থাকে না। কয়েকদিন পর পরই আমরা মুখে দেয়ার মত কিছু পেয়ে থাকি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে সাহরি ও ইফতার ছাড়া কি আমাদের রোজা হবে? উত্তরদাতা আলেম, যিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মসজিদে নববীর মুফতি প্যানেলের সদস্য, এর কোন উত্তর না দিয়ে অঝোরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এমন রোজাদারও মুসলিম বিশ্বে রয়েছে, তারা কারো কাছে খাদ্য সাহায্য চাইছে না বরং এভাবে খাবার না খেয়ে রোজা হবে কিনা জানতে চাইছে। এর জবাব কী হতে পারে? তাদের রোজা তো অবশ্যই হবে তবে এদের খোঁজ খবর না রাখায় সক্ষম ও ধনী মুসলমানদের ঈমান থাকবে কিনা বা রোজা হবে কিনা সে প্রশ্নই মুখ্য। কান্নার এ দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের বহু দর্শক তাদের সাহায্য-সহযোগিতার পথ খুঁজে বের করেন। তাছাড়া, অনেকে বিলাসবহুল ইফতারির ছবি ফেসবুক ইত্যাদিতে পোস্ট না করার প্রচারণা শুরু করেন। আজকের এই লেখাটি যখন লিখছি তখনও মিডিয়ায় সংবাদ এসেছে যে, ইরাকের মসুলে মানুষ গাছের পাতা ও বালি খেয়ে ইফতার ও সাহরি করছে। মুসলিম বিশ্বে এ অবস্থা এখন অনেক জায়গায়ই চরম বাস্তবতা।
এই যখন অনেক মুসলমানের অবস্থা তখন ধনী আরব দেশগুলো কী পরিমাণ অর্থ নানা কাজে ব্যয় করছে তা ভাবতেও অবাক লাগে। সউদী আরব অস্ত্রচুক্তিসহ সামগ্রিক ৪০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে আমেরিকার সাথে। ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে আরব-আমেরিকান ইসলামী সম্মেলন করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সউদী বাদশাহ সালমান উপহারই দিয়েছেন ১ বিলিয়ন ডলারের। সউদী টেলিভিশন চ্যানেলের সে হৃদয় বিদারক প্রশ্নোত্তর পর্বের কোন প্রভাব কি সে দেশের শাসকশ্রেণীর পলিসিতে পড়েছে? সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার সমস্যাগ্রস্ত মুসলিম জনপদগুলোয় মানবিক সাহায্য বাবদ তারা যা ব্যয় করেছেন তা কি উপরের ব্যয়ের সাথে তুলনীয়? হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ঈমান ও তাকওয়ার দেশ ইয়েমেন যুদ্ধে যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছে প্রায়। দুর্ভিক্ষে নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে ইয়েমেনের বহু মানুষ। কিন্তুু শান্তি ও স্বস্তি সুদূরপরাহত।
দেশে গত কিছুদিন ধরে নানা বিপদ-আপদ গজব ও বিপর্যয়ের ভেতরেও রমজানের শেষ দশকে বাংলাদেশের জন্য একটি সুসংবাদ আল্লাহ দান করেছেন। দুবাই ২১তম হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বিশ্বের ১০৩টি দেশকে পেছনে ফেলে ১ম স্থান অধিকার করা বাংলাদেশী কিশোর হাফেজ তরিকুল ইসলাম ৫০ লাখ টাকার পুরস্কার ও সম্মাননা নিয়ে এসেছে। এ অর্জন বিরল ও বিশাল।
রমজানের এ পবিত্র মাসে কোরআনের এ প্রতিভাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারেন। বাংলাদেশ গত ২০ বছর ধরেই আন্তর্জাতিকভাবে কোরআন তিলাওয়াত, কেরাআত ও হিফজে সেরা দেশে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়টিকেও সউদী আরব অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারত। বাংলাদেশে লাখো মসজিদ, মক্তব, ইবতেদায়ী, নূরানী মাদরাসায় কোরআন ও প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষা দেয়া হয়। ইবতেদায়ী শিক্ষকরা সামান্য বেতন-ভাতার জন্য নিবিষ্টচিত্তে কাজ করতে পারছেন না। সউদী সরকার সামান্য মনযোগী হলে এদেশের সর্বস্তরের ইসলামী প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিতে পারে। যা তাদের অন্যান্য বিপুল ব্যয়ের তুলনায় কিছুই না। অথচ এর প্রভাব হতো অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের জন্য দোয়া করত। কৃতজ্ঞ থাকত। তাদের বিপদ-আপদে জীবন বাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়ত। দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষকে খাদ্যসাহায্য দেয়ার চেয়ে বড় ইবাদত আর কী হতে পারে? কোরআন শিক্ষার প্রসারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সেবা আর কী হতে পারে? সউদী আরব তার কৌশলগত অবস্থান নিশ্চিত করতে যে হারে পশ্চিমাশক্তিকে টাকা পয়সা দিচ্ছে, এসবের শেষ ফল কী হয় তা স্পষ্ট না হলেও মুসলিম উম্মাহর জন্য তার ব্যয় নি:সন্দেহে তার ভবিষ্যতের জন্য বিশেষ উপকারী হত।
ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় বিরাজ করছে এক মানবিক পরিস্থিতি। তুরস্কে ৩০ লাখ সিরিয় উদ্বাস্তু, জর্দানে ১০ লাখ। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিপন্ন মানুষ জীবনবাজি রেখে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যেতে মরিয়া। এ পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সউদী আরব, আরব আমিরাত ও কাতারের কী ভূমিকা? লিবিয়া ধ্বংসে সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রভাবে তো কাতারের বিমানগুলোই থাকত। মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মিনি পরাশক্তি ইরানের কী ভূমিকা? দুর্ভিক্ষ কবলিত ও মানবিক বিপর্যস্ত এলাকায় তার কার্যক্রম কোথায়? মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত উৎকর্ষে বাংলাদেশী জনশক্তির ভূমিকা ও অবদানের কোন তুলনা নেই। গত প্রায় ৪০ বছর ধরে এ দেশের অর্ধকোটি মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম-ঘাম দিয়ে আসছে। গত ক’বছর ধরে এক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে হতাশার সূর। টাকা পয়সা নেই, আর্থিক মন্দা অতএব শ্রমিক ছাঁটাই। কম বেতন, বকেয়া বেতন, ভিসায় কড়াকড়ি, একামায় জটিলতা, নারী শ্রমিক নিগ্রহ ইত্যাদি মিলিয়ে বাংলাদেশী মানুষ খুব হতাশ। পেটে পাথর বেঁধে যারা পড়ে আছে, যারা দেশে ফেরত আসছে তাদের পরিবার-পরিজনও বিপর্যস্ত। তারা যখন দেখে পশ্চিমাদেশে লবিং করার জন্য সউদী আরব, আরব আমিরাত ও কাতার শত শত কোটি ডলার ব্যয় করছে তখন তাদের অন্তরে যে কী হাহাকার উঠে তা কেবল চক্ষুমান লোকেরাই বুঝবেন। কোথায় ইসলামী চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, আরব ঐতিহ্য? উন্নয়নের নামে আমিরাত আজ কোন্্ পথে হাঁটছে। তুরস্কের জনপ্রিয় নেতাকে ফেলে দেয়ার জন্য যদি আরব আমিরাত ৩০০ কোটি ডলার ব্যয় করতে পারে তাহলে মুসলিম ও আরব বিশ্বের বিপন্ন মুসলমানদের জন্য তারা কী না করতে পারে? কাতার বৃটেনে যে সম্পদ করেছে তার পরিমাণ রানীর সম্পদের চেয়েও বেশি। এর আগে লিবিয়া ও ইরাক কত সম্পদ জমা করেছিল ইউরোপে? ধ্বংস ও পতনের সময় এসব কি কোন কাজে লেগেছে? সউদী আরব স্পেন, ফ্রান্স ইত্যাদিতে যত টাকা ব্যয় করেছে তার কোন বেনিফিট কী তারা আদৌ পাচ্ছে?
সউদী আরব ৬টি দেশসহ কাতারের উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তাতে মূলত উভয়পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক্ষেত্রে উচিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে ফেলা। রাজনৈতিক কারণে এ অনৈক্য আখেরে মুসলমানদেরই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইরানী নেতার মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য যে, আমেরিকা এখন সউদী আরবকে দুধেল গাভীর মতই দোহন করবে। মাল্টি বিলিয়ন ডলার অস্ত্রচুক্তির পর কাতারকেও তো সে সমরাস্ত্রে সমৃদ্ধ করা বন্ধ করেনি। এক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকায় ভারসাম্য থাকতে হবে। পাকিস্তানী নেতা যেমন তড়িঘড়ি করে সউদী আরব ছুটে গিয়েছেন। তার মধ্যস্থতাকে কাজে লাগাতে হবে। কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ পবিত্র রমজানের মাহাত্ম্যকে যেন ম্লান না করতে পারে। ইসলামী মূল্যবোধ,আরব গৌরব ও পবিত্র হারামাইনের শান যেন ক্ষুন্ন না হয়। ইসরাইলের সাথে সউদী আরবের ব্যবসায়িক চুক্তি, কূটনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি উন্নতির দিকে। মহান রাব্বুল আলামীন বলে দিয়েছেন, মুসলমানরা পরস্পরের ভাই ও বন্ধু। তারা যেন মুসলমানদেরেই বন্ধু ও অভিভাবকরূপে বেছে নেয়। ইহুদী-নাসারা, অবিশ্বাসী ও মুশরিকরা তাদের বন্ধু হতে পারে না। ইহুদী ও নাসারাদের বন্ধু বা অভিভাবক রূপে গ্রহণ না করার যে নির্দেশ মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে দিয়ে রেখেছেন সেখানে আল্লাহ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, তোমাদের উপর ইহুদী-নাসারারা কোনদিনই খুশি হবে না যতক্ষন না তোমরা তাদের দলভুক্ত হয়ে যাও। (আল-কোরআন) এখানে আরব জাহানকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি আল্লাহর দেয়া মুলনীতি অনুসরণ করবে, না নিজেদের বিবেচনা অনুযায়ী শত্রুর তাবেদারি করে যাবে। যে ইসরাইল পবিত্র রমজানে প্রকাশ্য রাজপথে চারজন ফিলিস্তিনি তরুণকে গুলি করে মেরেছে, যে ইসরাইল ফিলিস্তিনে ২০ লাখ মানুষকে বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে মৃত্যু যন্ত্রনায় ফেলে রেখেছে। তার সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করে কতদূর এগোনো যাবে এটাই প্রশ্ন। দেশে দেশে মজলুম মুক্তিকামী মানুষকে উগ্রবাদী আখ্যা দিয়ে কোনঠাসা করা যাবে কিন্তু প্রকৃত ঈমানদার মজলুম মানুষের আর্তনাদে যখন খোদার আরশ কাঁপে তখন হাজার কৌশলেও নিজেদের ভোগবিলাস আর রাজত্ব ধরে রাখা যায় না। ইসলামের আলোকে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন, মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত রাখা, বিপন্ন, যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষ কবলিত মানুষকে অকৃপন সহায়তা এ মুহূর্তে জরুরি। বিশেষ করে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মুসলমানকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সার্বিক সহায়তা প্রদান অত্যাবশ্যক। যা আল্লাহর রহমত, বরকত,নিরাপত্তা ও সাফল্য পাওয়ার উপায়। মুসলিম উম্মাহর প্রতি সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন করে আরব শাসকরা তাদের ওপর আসন্ন সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারেন। সউদী বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ পারেন পবিত্র দুই মসজিদের খাদেম হিসাবে তার অবস্থানকে সংহত করে বিশ্বমুসলিমের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে। তার অনুসরণ করে অন্যান্য আরব নেতারাও গৌরবজনক পরিচয়ে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারবেন। বিশ্বপরিস্থিতির আলোকে বস্তুগত বিবেচনায় শত্রæদের হাতে পূর্ণ জিম্মি হয়ে গেলে সমস্যার সমাধান হবে না। অঢেল অর্থ ব্যয় করেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। এ ব্যাপারে বাহ্যিক ব্যবস্থা গ্রহণের চেয়ে বেশি প্রয়োজন খোদায়ী ব্যবস্থাপনার আশ্রয় নেয়া। যার মাধ্যম দান, সদাকা, সাহায্য, সহযোগিতা, মানবতার সেবা, আর্ত মানুষের প্রয়োজন পূরণ করা। অস্ত্রক্রয়, লবিস্ট নিয়োগ, বিলাসিতা ও অপচয় মুসলমানের পথ নয়। মুসলমানের পথ আল্লাহর বান্দাদের সেবা করে আল্লাহর সন্তুুষ্টি লাভ করা। বিশ্ব মুসলিমের পাশাপাশি বাংলাদেশের অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, বিদ্যুত, যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, উন্নয়ন ইত্যাদির যে ব্যয় এর সবটুকু বহন করলেও তো এসব আবরদেশের গুটিকয় সমরাস্ত্রের সমান টাকা লাগবে না। অথচ তারা আমাদের শ্রমিকদের নগন্য বেতনটুকু দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন। অর্ধশতাব্দীর উন্নয়ন সহযোগীদের তারা মিসকীন ছাড়া কিছুই মনে করেন না। যাদের আন্তরিক ত্যাগ ও নিষ্ঠার বিনিময়ে, কঠোর শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে আজ মরুভূমির বুকে গড়ে ওঠেছে বিশ্বের সেরা সব অট্টালিকা, প্রাসাদ, টাওয়ার আর সুউচ্চ স্কাইলাইন। আমাদের বিপদ আপদে তারা সাহায্য যা করেন তা উল্লেখ করার মত নয়। পবিত্র রমজানে বিশ্বমুসলিম উম্মাহর এ প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতার প্রতি আহবান, মহান বাদশাহ, আশাকরি আপনি ও আপনার সহযাত্রী আরব শাসকরা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে নিজেদের ভূমিকা ও অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করবেন। এর মধ্যদিয়ে আপনি বস্তুতপক্ষেই নিজেকে ১৬০ কোটি মুসলমানের আশা আকাংখার প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৭ সকাল ১০:৪২