সবাই যায় নিঝুম দ্বীপ দেখতে...আর আমরা ঠিক করলাম যাব চর কুকরী-মুকরী দেখতে। নিঝুম দ্বীপের খুব কাছ থেকে আমরা পাড়ি জমালাম চর কুকরী-মুকরী..... নিঝুম দ্বীপ ফির কাভি!
চর কুকরী-মুকরী ভোলার দক্ষিণে মেঘনা মোহনায় বঙ্গোপসাগরের চমৎকার একটি দ্বীপ। কিন্তু আমরা ভোলার কোন লঞ্চে কেবিন পেলামনা। শেষে সদরঘাট থেকে উঠে বসলাম হাতিয়া মনপুরার লঞ্চ টিপু-৫ এ.... মনপুরা-টা দেখে গেলে মন্দ কি!
টিপু-৫ সদরঘাট ছাড়লো সন্ধ্যে ৫:৩০ টায়। সারারাত আড্ডায় কাটিয়ে দিলাম মেঘনা মোহনায় সূর্যদয় দেখবো বলে। সার্থক রাত জাগা..... লঞ্চের মাস্টার ব্রীজের সামনের ডেকে চাদর মুড়ি দিয়ে দেখলাম মেঘনার মোহনায় অদ্ভূত মোহনীয় এক সূর্যদয়!
মেঘনা মোহনায় সূর্যদয়!
মেঘনা চ্যানেলের ভোর দেখতে দেখতে ভোর৭:০০ টায় পৌঁছালাম মনপুরা দ্বীপে। মনপুরা ভোলার একটি উপজেলা। এর মধ্যে রাত তিনটায় তজুমুদ্দিনের এক ঘাট থেকে আমাদের সকালের নাস্তার এন্তেজাম হরেক রকম পিঠা লঞ্চে এসে দিয়ে গেলেন আমাদের এক সহযাত্রীর নিকটজন ....
মেঘনা মোহনায় খুব ভোরেও মাছ শিকারে ব্যস্ত জেলেরা
সকালের নাস্তা - ভোলার লোকপ্রিয় হরেক রকমের পিঠা!..কৃতজ্ঞতা জানাই রাত জেগে আমাদের জন্য তৈরী করেছেন যে সব মা-খালারা...
আমাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা করা ছিল মনপুরায়... পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজে। কিন্তু আমরা মনপুরায় নামলাম না। ঠিক করলাম টিপু-৫ হাতিয়া থেকে ফিরতি ট্রিপে যখন মনপুরায় থামবে তখন নামবো আমরা। সকাল ৯:০০টায় টিপু-৫ ভিড়লো হাতিয়ার তমরুদ্দিন ঘাটে। হৈ হৈ করে লঞ্চ থেকে নামলো সব নিঝুম দ্বীপের অভিযাত্রীর দল। ঢাকার লঞ্চ তমরুদ্দিন ঘাটে পৌঁছানোর পর একটা ট্রলার ছাড়ে নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশ্যে...দুই ঘন্টার ট্রলার জার্নি নিঝুম দ্বীপ। আমাদের মধ্যে যাদের মনে কিঞ্চিৎ ইচ্ছে ছিল এই ট্যুরেই নিঝুম দ্বীপ-টাও দেখে যাওয়ার.... নিঝুম দ্বীপের এত অভিযাত্রী দেখে তারাও নিরুৎসাহিত হলো...নিঝুম দ্বীপ আর নিঝুম নেই! যেহেতু আগে থেকে নিঝুম দ্বীপে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে আসা হয়নি, সুতরাং.... ফির কাভি! দুপুর ১২:৩০টায় টিপু-৫ হাতিয়া থেকে ফিরতি যাত্রা করবে ঢাকার উদ্দেশ্যে...হাতিয়া ঘুরে দেখার জন্য আমাদের হাতে সময় তিন ঘন্টা।
হাতিয়ার তমরুদ্দিন ঘাটে টিপু-৫।
ছায়া বিছানো হাতিয়ার মূল সড়ক!
হাতিয়া থেকে মনপুরা এক ঘন্টার জার্নি। মনপুরায় এসে নামলাম দুপুর ১:৪৫টায়।
কেওড়া বনের মধ্যে দিয়ে মনপুরার পথ...
মনপুরা দ্বীপে সন্ধ্যায় হরিণের বিচরণ ক্ষেত্র। (হরিণের দেখা মিললেও ছবি তুলতে পারিনি)
মনপুরার একটি মৎস চাষ প্রকল্প, যেখানে মনপুরা ছবির স্যুটিং হয়েছিল
মনপুরার লঞ্চঘাট। সামনে চর পড়ায় ঢাকার বড় লঞ্চ এখানে এখন আর ভিড়তে পারেনা। সন্ধ্যের আড্ডার জন্য চমৎকার জায়গা!
মনপুরায় ক্যাওড়া বনের ওপারে সূর্য যখন পাটে!
১৯৭০ এর প্রলয়ংকরী জলচ্ছাসে বেঁচে যাওয়া মনপুরা দ্বীপের হাতে গোনা কয়েকজনের একজন .....সোবহান চাচা। শুধুই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা!
মনপুরায় থাকার মোটামুটি ব্যবস্থা করা গেলেও খাওয়ার ব্যবস্থা মোটেই সুবিধে নয়। বাজারে একটি মাত্র ভাতের হোটেল আছে। রকমারী মাছ খাবার আগাম অর্ডার দিয়ে রাতের খাবারের সাথে মিললো...চেউয়া, চাপিলা, ঢ্যালা...আর কি এক সামুদ্রিক ছোট মাছ..... মন্দ কি?!
পরদিন সকালে শুরু হলো আমাদের ট্যুরের মূল অভিলক্ষ্যে যাত্রা..... এক্সপ্লোর চর কুকরী-মুকরী! আমরা মনপুরা দেখতে এসে চলে এসেছি মেঘনা চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে নোয়াখালী সংলগ্ন এলাকায় (হাতিয়া নোয়াখালীর অন্তর্ভূক্ত)। এবার মেঘনা চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আবার যেতে হবে পশ্চিম পাড়ে মূল ভোলা ল্যান্ডে। আসার সময় মেঘনা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছি বড় লঞ্চে...কিন্তু এবার পাড়ি দিতে হবে মাছ ধরার ছোট ইঞ্জিন বোটে। বিশাল চওড়া এই মেঘলা চ্যানেল ইঞ্জিন নৌকায় পাড়ি দিতে সাহসের দরকার বৈকি! আবহাওয়া ভাল থাকায় আল্লার নাম করে যাত্রা শুরু করে দিলাম.....
ইঞ্জিন বোটে আমরা ক'জন.... আল্লাহ নাম জপছি!
নদীর কূল নাইরে.......
মহাজনের ট্রলার! দাদন নেয়া জেলেরা মাছ ধরে এইসব মহাজনের ট্রলারে জমা করে। ট্রলারে রয়েছে বরফ ও মাছ সংরক্ষণের অন্যান্য আয়োজন। তারপর বরিশাল হয়ে মাছ চলে যায় সোজা ঢাকা....
চিংড়ি পোনা ধরার ছোট জাল.....
নৌকার ছই-এর নীচে শুয়ে আমাদের এক সহযাত্রী তখনও ঢুকু ঢুকু চালিয়ে যাচ্ছেন!
ঐ যে দূরে দেখা যায় আমাদের গন্তব্য...চর কুকরী-মুকরী ও চর পাতিলা!
টানা ছয় ঘন্টা ইঞ্জিন বোটে মেঘনা চ্যানেল পাড়ির পর অবশেষে চর পাতিলায় প্রবশের খাল..
খালের দু'ধারে এই কেওড়া বন..... হরিণের অভয়ারণ্য
ভাললাগে খালের দু'ধারের বন প্রকৃতি।
এক জেলে নৌকা থেকে কিনে নেয়া তাজা মাছ.... রাতের খাবারের আয়োজন।
চর কুকরী-মুকরী ইউনিয়ন পরিষদ...যেখানে রাতের থাকার আয়োজন।
এখানে বলে রাখি..... মাছের দেশে বেড়াতে গিয়ে বড় মাছের দেখা পেলামনা। স্থানীয় বাজারে আপনি চেউয়া বা কুঁচো চিংড়ি ছাড়া ভাল মাছ পাবেন না।...ঐ এলাকার সব মাছ চলে আসে ঢাকায় বা অন্য বড় শহরে। তবে হ্যাঁ...কোন মহাজনের সাথে সখ্যতা থাকলে (যেমন আমরা এক মহাজনের আতিথেয়তা পেয়েছিলাম) তবেই সেখানে মাছ খেয়ে শান্তি!
ভাটার সময় কুকরী-মুকরী খাল।
অতিথি পাখি.....বেলে হাসের দল
দেখা মিলবে বড় আকারের চমৎকার সাইবেরিয়ান ডাক।
দেশী বক তো রয়েছেই।...আর দূরে ক্যাওড়া বনে রয়েছে হাজার হাজার হরিণ।
তাহলে আপনিও একবার সময় করে ঘুরে আসুন চর কুকরী-মুকরী!