আগের পর্ব গুলো পড়ুন এখানেঃ
ইসলামে নারী নেতৃত্ব (পর্ব-০১)
ইসলামে নারী নেতৃত্ব (পর্ব-০২)
এবার, আলোচনা করছি সূরা আন-নামলের আয়াত ১৫-৪৪ এ বর্ণিত সাবার রাণী বিল্কিস এবং হযরত সুলাইমান(আঃ) এর ঘটনা।
“সুলায়মান পক্ষীদের খোঁজ খবর নিলেন, অতঃপর বললেন, কি হল, হুদহুদকে দেখছি না কেন? নাকি সে অনুপস্থিত?আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা হত্যা করব অথবা সে উপস্থিত করবে উপযুক্ত কারণ।কিছুক্ষণ পড়েই হুদ এসে বলল, আপনি যা অবগত নন, আমি তা অবগত হয়েছি। আমি আপনার কাছে সাবা থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি।আমি এক নারীকে সাবাবাসীদের উপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে।আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সেজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলী সুশোভিত করে দিয়েছে। অতঃপর তাদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। অতএব তারা সৎপথ পায় নাতারা আল্লাহকে সেজদা করে না কেন, যিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের গোপন বস্তু প্রকাশ করেন এবং জানেন যা তোমরা গোপন কর ও যা প্রকাশ কর।আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই; তিনি মহা আরশের মালিক।সুলায়মান বললেন, এখন আমি দেখব তুমি সত্য বলছ, না তুমি মিথ্যবাদী।তুমি আমার এই পত্র নিয়ে যাও এবং এটা তাদের কাছে অর্পন কর। অতঃপর তাদের কাছ থেকে সরে পড় এবং দেখ, তারা কি জওয়াব দেয়।বিলকীস বলল, হে পরিষদবর্গ, আমাকে একটি সম্মানিত পত্র দেয়া হয়েছে।সেই পত্র সুলায়মানের পক্ষ থেকে এবং তা এইঃ সসীম দাতা, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে শুরু;আমার মোকাবেলায় শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার কাছে উপস্থিত হও।বিলকীস বলল, হে পরিষদবর্গ, আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দাও। তোমাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না।তারা বলল, আমরা শক্তিশালী এবং কঠোর যোদ্ধা। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আপনারই। অতএব আপনি ভেবে দেখুন, আমাদেরকে কি আদেশ করবেন।সে বলল, রাজা বাদশারা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে, তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গকে অপদস্থ করে। তারাও এরূপই করবে। আমি তাঁর কাছে কিছু উপঢৌকন পাঠাচ্ছি; দেখি প্রেরিত লোকেরা কি জওয়াব আনে। অতঃপর যখন দূত সুলায়মানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বললেন, তোমরা কি ধনসম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদেরকে প্রদত্ত বস্তু থেকে উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক। ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমি তাদের বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসব, যার মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। আমি অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কৃত করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত। সুলায়মান বললেন, হে পরিষদবর্গ, তারা আত্নসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে বিলকীসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে? জনৈক দৈত্য-জিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বে আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে শক্তিবান, বিশ্বস্ত।কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল, আপনার দিকে আপনার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দেব। অতঃপর সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত দেখলেন, তখন বললেন এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে নিজের উপকারের জন্যেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং যে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে জানুক যে, আমার পালনকর্তা অভাবমুক্ত কৃপাশীল।
সুলায়মান বললেন, বিলকীসের সামনে তার সিংহাসনের আকার-আকৃতি বদলিয়ে দাও, দেখব সে সঠিক বুঝতে পারে, না সে তাদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের দিশা নেই ? অতঃপর যখন বিলকীস এসে গেল, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তোমার সিংহাসন কি এরূপই? সে বলল, মনে হয় এটা সেটাই। আমরা পূর্বেই সমস্ত অবগত হয়েছি এবং আমরা আজ্ঞাবহও হয়ে গেছি। আল্লাহর পরিবর্তে সে যার এবাদত করত, সেই তাকে ঈমান থেকে নিবৃত্ত করেছিল। নিশ্চয় সে কাফের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাকে বলা হল, এই প্রাসাদে প্রবেশ কর। যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল সে ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলায়মান বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। বিলকীস বলল, হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আল্লাহর কাছে আত্নসমর্পন করলাম।”
আয়াতগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে যা জানা এবং উপলব্ধি হয় যে, সাবার রাণী তার শাসনের অধীন এলাকায় প্রজ্ঞা এবং দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন,সফলতা ও দেখিয়েছেন এবং তাদের সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল সূর্যকে উপাসনা করা যেটা ‘হুদ্হুদ’ পাখি সুলায়মান(আঃ)কে জানায়। সুলায়মান(আঃ) যখন সাবার রাণীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানালেন তখন সাবার রাণী তার সভাপরিষদগণের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত না নিয়ে সুলায়মান(আঃ) এর রাজত্ব ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
সূরা নামলের ২৯-৩৫ নং আয়াতে বিল্কিসকে একজন প্রাজ্ঞ শাসক হিসেবে দেখানো হয়েছে যেহেতু তিনি তাঁর পরিষদের সাথে সভায় যুদ্ধ না করে শান্তির পথে সমাধায় যেতে চেয়েছেন। এখান থেকে কুরআন আমাদেরকে একজন মহিলার মধ্যে নেতৃত্বের প্রশংসনীয় গুণ প্রদর্শন করায়।
সূরা আন-নামলের ৪১-৪৪ নং আয়াতে বর্ণিত তথ্যে দেখা যায়,সুলায়মান(আঃ) সাবার রাণীর জন্য ২টা পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন,
১, সাবার রাণীর সিংহাসনকে তিনি আসার আগেই নিজের দরবারে নিয়ে আসলেন, এবং বিল্কিস তা দেখেই চিনতে পারলেন। এখান থেকে বিল্কিসের তাঁর প্রাজ্ঞতা পরিচয় পাওয়া যায়।
২, সুলায়মান(আঃ) এর দরবারে রাণী যখন প্রবেশ করলেন যার মেঝে ছিল পানির মতন স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি এবং তা ভেবে রাণী তার পরিধেয় বস্ত্র পা থেকে একটু উপরে উঠালেন। যখন তিনি বুঝলেন তিনি বিভ্রমের স্বীকার তখন সাথে সাথেই তিনি অনুধাবন করলেন যে তিনি এতোদিন জাগতিক মোহে কিভাবে চূড়ান্ত বিভ্রমের ছিলেন এবং মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সাবার রাণী আল্লাহ্র দ্বীন কবুল করলেন। ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে, বিল্কিস তাঁর সজাগ বিবেক,প্রজ্ঞা এবং নিজেদের মিথ্যা অন্ধ বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করার সামর্থ্য দেখান।
মুসলিম নারীবিদগণ (যেমন আমিনা ওয়াদুদ) এই জায়গায় নিজেদের যুক্তিকে আরও প্রগাঢ় করেন যে, যেহেতু আল্লাহ্ ই মানুষকে হেদায়াত দান করেন সেহেতু এক্ষেত্রেও বিল্কিসে বেলায় তাই ঘটেছে এবং কোরআন সাক্ষ্য দিচ্ছে যে নারীরাও বিচারিক ও আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারে প্রথাগত ধারণার উপরে আছেন এবং এই ঘটনা নারী নেতৃত্ব নিয়ে ঋণাত্মক ধারণাকে বাতিল করে দেয়।
....................................
আগের পর্বে ভেবেছিলাম যে, এই পর্বেই শেষ করবো , কিন্তু পেরে উঠলাম নাহ। ইন শা আল্লাহ্ ৪র্থ পর্বে ইতি টানবোই।
শেষ পর্ব পড়ুন এখান থেকেঃ
ইসলামে নারী নেতৃত্ব (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:০৩