ছাদে বসে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আকাশ দেখছে শশী। কালো মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ... একটু পরেই বাঁধন হারা বৃষ্টি নামবে... বাতাসের যে গতি... তাতে মনে হচ্ছে ঝড় আসবে। নীচে শশীর মা শশী শশী বলে কখন থেকে ডেকে যাচ্ছে ... শশীর কোন কিছু আসে যায় না তাতে... মায়ের একশটা বারন শুনতে গেলে এখন শশীর চলবে না... এই জায়গা থেকে ওকে আজ কিছুতেই নামাতে পারবে না কেউ। আজ শশীর মাথায় পাগলামী ভর করেছে... ঝড়টা যত জোরেই আসুক না কেন... আজ সে ছাদ থেকে নামবে না। ও আজ দেখতে চায় ঝড় ওর কিছু করতে পারে কিনা... হোক না বজ্রপাত... আজ ও নামবে না। ছেলেবালায় দাদু একবার বলেছিল সাগর তীরে যে জেলেরা মাছ ধরে ওরা শীত গ্রীস্ম সব কিছু উপেক্ষা করে প্রকৃতিকে মেনে নিতে শিখেছে, তাই প্রকৃতি ওদের কোন ক্ষতি করতে পারে না... এর পর কয়দিন শশী সোয়েটার না পরে ঘুরতে শুরু করেছিল... সেও নিজের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে! ঠান্ডা আর ভয়াবহ কাশি বাধিয়ে সেযাত্রা ক্ষান্ত দিয়েছিল। কিন্তু আজ ক্ষান্ত দেবে না, মনের আনন্দে গুন গুন করে গেয়ে যাচ্ছে... “আজ শ্রাবণের আমন্ত্রনে দুয়ার কাঁপে, ক্ষণে ক্ষণে ঘরের বাঁধন যায়... যায় বুঝি আজ টুটে”... হঠাৎই লাজুক একটা আভা খেলে যায় অর চেহারায়! ও জানে না হাল্কা লজ্জা মেশানো একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে ওর সমস্ত মুখশ্রীতে।... শ্রাবণ শব্দটা মনে পড়তেই এই দশা!
শশীর মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়... শ্রাবণের উপর ওর ভীষন রাগ। ভালোই তো ছিল শশী। কেন যে শ্রাবণের সাথে ওর পরিচয় হল! শ্রাবণের কোন দোষ নেই... তবু রাগ হয়। শ্রাবণ কেন ওর স্বপ্নের কথা বলতে শুরু করেছিল! কেন ওর কষ্টের কথা বলতে শুরু করেছিল ওকে! সেই জন্য রাগ হয়। কেন শ্রাবণের স্বপ্নগুলো হুবহু শশীর মতই হতে গেল! অধরা স্বপ্ন! কষ্ট বলে পৃথিবীতে একটি মাত্র শব্দ থাকলেও মানুষের কষ্টগুলো বিভিন্ন। কেন শ্রাবণের কষ্টটুকু হুবহু শশীর মতই হতে গেল! অপূর্ণতার কষ্ট! কেন শশী পারেনা শ্রাবণকে নিজের থেকে আলাদা ভাবতে? রাগ হয় নিজের ঊপর... প্রচন্ড রাগ! রাগ হয়... সে অতিমানব হতে পারেনি বলে। একদিন প্রকৃতিকে জয় করতে চেয়েছিল সে। আজ স্রষ্টার গড়া প্রকৃতির কাছে এমন ভাবে হেরে গেল শশী! মাঝে মাঝে হেরে গিয়েও মানুষ জিতে যায়। এবার হেরে গেছে বলেই জীবনের স্বপ্নগুলো নতুন করে দেখতে শুরু করেছে শশী। এই হারে আনন্দ আছে, সবাই তো হারতে পারেনা!
শশীর মা ছাদে উঠে এসেছে ... মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে! এতো পাগলামী কেন করে মেয়েটা? নানুবাড়িতে আসলেই এই ভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা ছাদে বসে থাকে। ভাবসাবেই তো বোঝা যাচ্ছে... সে আজ নামবে না। সুতরাং এখান থেকে শশীকে নামাতে একগাদা বকা আর সুদীর্ঘ লেকচার দিতে হবে এখন। তাতেও কাজ হবে কিনা কে জানে! এই মেয়েটার পাগলামীর সাথে পারে না সে। চুপ করে বকা শুনে যাবে... তারপর বলবে, শেষ হয়েছে? বলেই একটা পাগল করা মিষ্টি হাসি... কি আর করা! থাকো তুমি তোমার মত... বলে রাগে গজগজ করতে করতে হাল ছেড়ে দেবে শশীর মা। বৃষ্টিটা এসে গেছে...ঝড়ের আশায় ছিল। বেরসিক প্রকৃতি, না এলো ঝড়, না হল বজ্রপাত... আপাতত বৃষ্টি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে শশীকে! ঝড়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে ওকে। কতদিন আর প্রকৃতি ফাঁকি দেবে ওকে। একদিন প্রচন্ড ঝড়ের রাতে খোলা আকাশের নীচে এসে শশী দাড়াবেই। ঝড়ো বাতাস, ঘুটঘুটে অন্ধকার আর আকাশে বিদ্যুৎ এর চমক ওর দিগন্তের পথে হাঁটা থামিয়ে দিতে পারে কিনা দেখবে শশী। ওর কেন যেন মনে হয় ঝড় কোনদিন ওর পথ রোধ করবে না। শশীর জন্মের সময় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। যাকে জন্মলগ্নেই ঝড় বৃষ্টি এভাবে বরণ করে নিয়েছে, সেতো মেঘবালিকা। শশী নামের মেঘবালিকাটির সাথে ঝড় বৃষ্টির প্রেম একটু বাড়াবাড়ি রকমের। তবু যে মা কেন ভয় পায়... এটাই ও বোঝে না! যে ঝড়কে ভালোবাসে ঝড় কি তার পথ আটকাতে পারে? সে হিসেবে আজ ঝড় না এসে ভালোই হয়েছে। মা যেভাবে সারা বিকেল শশী শশী বলে ডেকেছে, সে ডাক উপেক্ষা করে আর যাই হোক ঝড়ের মাঝে দিগন্তের পথে হাঁটা যায় না। আচ্ছা, সে পথে কি শ্রাবণকে নেবে শশী? ...... নেবে, শশীর পৃথিবীর সব জায়গায় নেবে শ্রাবণকে, পথ যত দুর্গমই হোক না কেন! শ্রাবণ পাশে থাকলে পথ যে তাকে ক্লান্ত করতে পারে না!
এই বাড়িটার সামনে এর আগে শুধু দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ দেখেছিল শশী, যতদূর চোখ যায়, শুধু ফসলের ক্ষেত চোখে পড়ত। এবার শেষ বর্ষায় এখানে বেড়াতে এসে দেখে... ফসলের ক্ষেতের সাথে দুটো বিলও দেখা যাচ্ছে! শীতের মরা বিল দুটো বর্ষার আমন্ত্রনে পুরোপুরি জেগে উঠেছে। ছাদে বসে পশ্চিমে তাকালে শীতেবিতের বিল, আর উত্তরে তাকালে দুবলোচারার বিল। দুপুর বেলায় বিলের দিকে তাকানো যায় না, পানিতে আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখে লাগে। কিন্তু রোদ পড়ে গেলেই... হাঁটতে হাঁটতে বিলের জল থেকে সবটুকু সৌন্দর্য বুকের ভিতর ভরে নিয়ে আসতে ইচ্ছা হয় শশীর। এখন শেষ বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ভেজা দিগন্ত পুরোপুরি অবর্ণনীয় রূপ নিয়েছে। এমনিতেই এ বেলায় দিগন্তের রেখাটা থাকে কুয়াশাচ্ছন্ন। তার উপর বৃষ্টিতে দিগন্ত রেখা পুরোই ভিজে গেছে। আকাশটা সামনে বিলের পানিতে এসে একাকার হয়ে গেছে। যেন বিলের জলে পা রাখতে পারলেই আকাশে চলে যাওয়ার পথ পেয়ে যাবে শশী! এটাই তো চায় সে। ওর চোখে যে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। দুটো আকাশ। একটা আকাশ দেখা যাচ্ছে অদূরেই। ওখানে শশী বিশ্বের সাতটি মহাদেশকে দেখিয়ে একটা পতাকা উড়াবে। বাংলাদেশের পতাকা। ওই পতাকাটা নিজের হাতে বানাবে শশী। তারপর একদিন ঠিকই উড়িয়ে দেবে ওটাকে। সেদিন হয়ত ছয়শ কোটি নয়, সাড়ে ছয়শ কোটি মানুষ অবাক বিস্ময়ে লাল-সবুজ পতাকাটার দিকে ঘুরে তাকাবে। ঠিক এমনি একটা স্বপ্ন দেখে শ্রাবণও। শ্রাবণ ও চায় ওই আকাশের বুকে বাংলাদেশের নিশান ওড়াবে। শশী জানে না, তার স্বপ্নটা সে সফল করতে পারবে কিনা, কিন্তু শ্রাবণ যে পারবে... সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। শ্রাবণকে যে পারতেই হবে। শশীর আরেক আকাশের ঠিকানা যে শ্রাবণ। সেই একটুকরো আকাশে শশী মনের আনন্দে ইচ্ছে মতন ডানা মেলে উড়বে। শ্রাবণকে শশী হারতে দেবে না, কিছুতেই না!
এখন বৃষ্টিতে ভিজে স্বপ্নভেজা চোখে এক মোহময় দিগন্ত দেখছে শশী। আর অপেক্ষা করছে... একটা কাঙ্খিত ঝড়ের রাতে প্রকৃতির কাছে সঁপে দেবে নিজেকে।
{আরেকটি রিপোষ্ট, আসলে সামহোয়ারইনে নিজের সব লেখাগুলো একজায়গায় রাখার জন্যই এই পদক্ষেপ।}প্রথম প্রকাশঃ ১৯শে অক্টোবর, ২০০৭