
মাত্র ৭ বছর বয়স তার। যে বয়সে বাবার হাত ধরে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা সে বয়সে শিশুটি গরুর গলার রশি ধরে নিয়ে যায় মাঠে। স্কুল থেকে যখন হৈ চৈ করতে করতে বাচ্চারা বাড়ী ফেরে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শিশুটি। নৈশ বিদ্যালয়ে মাত্র ৮ দিন পড়েছে এতে যৎসামন্য অক্ষর জ্ঞান পেয়েছে শিশুটি। কুড়িয়ে পাওয়া ছেড়া কাগজ কিংবা বইয়ের ছেড়া পাতা পড়ার চেষ্টা করে গরু ছড়ানোর অবসরে। পিতামাতার একমাত্র পুত্র সন্তান তিনি। বাকী পাচঁ মেয়ে এবং স্ত্রী নাইয়রজান বিবিকে নিয়ে যখন অভাবের সংসারে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত ইব্রাহিম আলী তখন এ ছোট্ট শিশুটি অন্যের বাড়ীতে রাখাল থেকে বাবার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। শিক্ষার প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল সে শেশবই। কিন্তু অভাবের সংসারে শিক্ষাতো বিলাসিতা। এ ছোট্ট শিশুটিই পরবর্তীতে তার শৈশবের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে গেয়ে উঠেন -
ভরণ-পোষণে তখন অক্ষম ছিলেন।
পিতা-মাতা আমাকে চাকরিতে দিলেন।।
শিক্ষা নয় চাকরি করি পেটে নাই ভাত।
কি করে বেচেঁ থাকা যায় ভাবি দিনরাত।।
দিন যায়, মাঠের গরুগুলো মোটাতাজা হয়ে বেড়ে উঠে। কালনীর কুলে বেড়ে উঠে আমাদের ছোট্টশিশুটি আবদুল করিম। শিশু থেকে কিশোরে পরিণত হন তিনি।আবারো নৈশ বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশুনার ইচ্ছে জাগে। ততদিনে বেজে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যারা লেখাপড়া জানে তাদের জোর করে যুদ্ধে নিয়ে যাবে ব্রিটিশরা। এই গুজবের ভয়ে পড়া হয়না আবদুল করিমরে। ততদিনে একজন ওস্তাদও জুটে যায় তার। নিজগ্রাম উজানধলের করমউদ্দিন। ওস্তাদ তাকে অক্ষর জ্ঞান দিতেন আর দোতারা বাজিয়ে শুনাতেন ভক্তিমূলক গান, বাউল গান প্রভৃতি। জেগে উঠে আবদুল করিমের বাউলমন। সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন ওস্তাদ করমউদ্দিনের কাছে। ওস্তাদ গান গাইতেন আর গানের তালে মাথা দুলিয়ে রপ্ত করতেন আবদুল করিম। গ্রামে রটে যায় এ খবর। মসজিদের ইমাম নিষেধ করেন গান গাইতে। আবদুল করিমের সরল স্বীকারোক্তি - সত্য বলি গান আমি ছাড়ব না।
আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া।
গান গাই আমার মনকে বুঝাই
মন থাকে পাগল পারা।।
গ্রামীন জীবনে ধর্মীয় ও সামাজিক আক্রমনের মুখোমুখি হন আবদুল করিম। ঈদের জামাতে তারঁ উপর আক্রমন হন। যুগে যুগে যেভাবে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে নিগৃহিত হয়েছেন জ্ঞান সাধকেরা। আবদুল করিমই বা তার ব্যাতিক্রম হবে কেন? ঈদের জামাতে নামাজ পড়া হয় না আবদুল করিমের। অপরাধ ? গান গাওয়া। মনের খেদে গেয়ে উঠেন আবদুল করিম....
মনে ভাবি দয়াল যাহা করেন অআমারে।
আমার নৌকা ছেড়ে দিলাম অকূল পাথারে।।
তখন ভাটি বাংলায় বাউল মুর্শিদি, জারী সারি, ভাটিয়ালি গানের জোয়ার বইছে। বিভিন্ন আসরে গান গেয়ে, মুখে মুখে গান রচনা করে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠেন আবদুল করিম। আবদুল করিম থেকে তিনি পরিণত হন শাহ আবদুল করিম-এ। কাগমারী সম্মেলনে যোগ দিয়ে আর্শীবাদ লাভ করেন মৌলানা ভাসানীর। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচনা করেন গান। বঙ্গবন্ধুরই উপস্থিতিতে তাকে নিয়ে তৈরী গান শুনিয়ে মুগ্ধ করেন এ কন্ঠযোদ্ধা। ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদকসহ লাভ করেন বিভিন্ন পুরস্কার। সবচেয়ে বড় যে পুরস্কারটি লাভ করেন বাউল আবদুল করিম তাহলো জনমানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। ভাটির পুরুষ, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের আজ ৯৫ তম জম্মদিন। জম্মদিনে এ মহান সাধকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। বেচেঁ থাকলে এই মরমী কবি আজ আবারো কি গেয়ে উঠতেন সেই সাম্যের গান -
এই সব নিয়ে দ্বন্ধ কেন
কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান
তুমিও মানুষ আমিও মানুষ
সবাই এক মায়ের সন্তান।
করিম বলে কাঙাল বেশে
জম্ম নিয়েছি এই দেশে
মানুষকে ভালবেসে
হোক না জীবন অবসান।