ঐ বিশ্বকাপ শুরু থেকেই আমি ব্রাজিলের সমর্থক, যেখানে আমার বাবামা দুজনই ব্রাজিল সমর্থক। তখনকার নিয়মানুযায়ী শেষ বিশ্বকাপ জয়ীরা উদ্বোধনী ম্যাচ খেলে, '৯৪ এর বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ প্রথম ম্যাচেই স্কটল্যান্ড। সেই থেকে শুরু সমর্থনের। '৯৪ এর যুক্তরাস্ট্র বিশ্বকাপের কথা কিছুই মনে নেই, থাকার কথাও না, শুধু এটুক মনে আছে অনেক রাতে ঘুম ভাঙ্গলে উঠে দেখতাম আব্বা মশারির নিচে বসে খেলা দেখছে। বেলায় বেলায় অনেক সময় কেটে গেলো, ব্রাজিলকে বুকে ধরে '০২ এর কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপ দেখতে বসি, রোনালদো-রিভালদো-রোনালদিনহো আশাভঙ্গ করে না ঐ বার। ব্রাজিলীয় ফুটবল দেখতে দেখতে ক্রমেই তাদের পাগুলে সমর্থকে পরিণত হলাম


'১১ তে গত কোপা আমেরিকাতেও ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সমর্থন করে ও খেলা নিয়ে মেসে ব্যাপক হাতাহাতি মারামারি করেছি। এবার '১৪ তে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নাই, তর্কাতর্কি তো বহুত দূরের কথা।
মোহাম্মদপুরে মেসে এক বড় ভাই থাকতেন, উনি মাদ্রিদ সমর্থক আমার মতোই। ক্লাব ফুটবলে সমর্থন এক দল হলেও জাতীয় দল সমর্থনে তিনি আর্জেন্টিনা আর আমি ব্রাজিল। উনার সাথে বসে ফুটবলীয় গবেষণা থেকে শুরু করে তর্কাতর্কি সবই হত। একবার মেসি সংক্রান্ত কোন এক তর্কে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'আচ্ছা, তুমি ব্রাজিল সমর্থক না ফুটবল সমর্থক??'
আমি খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খাই তার কথায়, তখন তিনি বলে, 'অবশ্যই তুমি ফুটবল সমর্থক না, ফুটবল সমর্থক হলে যে ভালো খেলে, যার খেলা সুন্দর তাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে।'
ঐদিন উনার কথায় লজ্জা পাই এবং নিজের এদিক নিয়ে ভাবতে শুরু করি, আমার আর আটদশটা খারাপ দিক শোধরাতে যেমনি করে নিজে নিজে ভাবি। উনার সাথে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে দলকানা নীতি থেকে ফুটবলের সৌন্দর্য্য বুঝতে শিখলাম। এখন যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, 'তুমি কিসের সমর্থক?'
নির্দ্বিধায় উত্তর হবে, 'ফুটবলের।'
আর যদি কোন দল সমর্থনের কথা আসে, নির্দিষ্ট করে যদি বলতেই হয় তবে বলতে 'ব্রাজিল'; ব্রাজিলের পরপরই আসবে 'পর্তুগাল'এর নাম।
২০০৪ সালের ইউরো থেকে পর্তুগাল সমর্থন করে আসছি, রোনালদোর উত্থান তখনই। গুতি ও লুইস ফিগো সেই দলের খেলোয়ার, আর এরাই কিনা রিয়াল মাদ্রিদে খেলে, তাই একটু আলাদা নজর ছিল। বিশেষ নজরটা আবেগে পরিণত হয় তাদের ইউরো'০৪ এ হার এবং ম্যানইউতে রোনালদোর খেলা দেখে, যদিও আমি ম্যানইউ সমর্থক না। আমি রোনালদোর পাগলা সমর্থক, যাকে ইংরেজীতে বলে ডাইহার্ট ফ্যান। রোনালদো সমর্থক হওয়ার কারনে মেসিকে কখনও ভালো বলতাম না, কিন্তু গত দুতিন মৌসুমে মেসির অতিমানবীয় খেলা দেখে বাধ্য আমি তাকে ভালো স্বীকার করতে। হ্যাঁ, মেসি অন্যমানের খেলোয়াড় ঠিকই, সাথে সাথে রোনালদোও অসাধারণ খেলোয়াড়।
আচ্ছা, এবার আমি আমার পছন্দ অপছন্দের কথা বাদ দেই, অনেকের সাথেই আমার মতামত মিলবে না। এবার আসি ব্রাজিল বিশ্বকাপ'১৪ এর কথায়।
বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগ থেকেই আমি সবাইকে বলে আসছি, জার্মানি এবার কাপ নিবে। সবাই আমার এই কথার সাথে সায় দিতো না তেমন, অনেকেই বলেছে, 'ইইইহ! ব্রাজিল নিজের দেশেই কাপ রেখে দিবে' কিংবা লাতিন আমেরিকায় এখন পর্যন্ত কোন ইউরোপিয়ান দল কাপ জিততে পারে নি, পারবেও না'। আমার অবশ্য এই কথা বলার পিছনে একটা যুক্তি আছে।
ব্রাজিল তাদের ৩য় বিশ্বকাপ জেতে '৭০ এ এবং তার ঠিক ২৪ বছর পর ৪র্থ বিশ্বকাপ জেতে, ইতালি তাদের ৩য় বিশ্বকাপ জেতে '৮২ এ এবং তার ঠিক ২৪ বছর পর ৪র্থ বিশ্বকাপ জেতে '০৬ এ। জার্মানি তাদের ৩য় বিশ্বকাপ জেতে '৯০ তে এবং তার ঠিক ২৪ বছর পর '১৪ তে ৪র্থ বিশ্বকাপ জিতবে।
জার্মানি ইতিমধ্যে আমার ভবিষ্যৎবাণী সত্য করার পথে, তার এখন বিশ্বকাপ জেতার চেয়ে এক ম্যাচ দূরে। জার্মানির সামনে '৮৬ ও '৯০ বিশ্বকাপ ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ থাকা আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনা নিয়েও একটা ভবিষ্যৎবাণী করেছিলাম এবার ইরানের সাথে তাদের খেলা দেখার পর যে, "এমনও হতে পারে মেসি এই রকম শেষে গোল দিতে দিতে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে নিয়ে যাবে, কাপও জিততে পারে।"
এই কথাটাও এখন সত্য হয়ে গেছে। আরেকটা মজার ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেছে একেবারে কাকতালীয় ভাবে। এই ভবিষ্যৎবাণীটা করেছিলাম বিশ্বকাপের ফিকচার বিশ্লেষণ করে! সেটা হচ্ছে, "ক্লোসা এবারেই ১৬ গোল করে রেকর্ড গড়বে, এবং তা হবে সেমিতে ব্রাজিলের সাথে। এবং ঐ ম্যাচে রোনালদোর সামনেই সে রেকর্ড ভাংবে!"
কাকতালীয় ভাবে ঐ ম্যাচে দেখলাম রোনালদো ধারাভাষ্য দিচ্ছে :-<

এখন মনে হচ্ছে আপনার, আমার এতো ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেলো অথচ আমি কই দিলাম? কার কাছে দিলাম? ভবিষ্যৎবাণীগুলো! আমি ফেসবুকে গত এক মাসে ইচ্ছা করেই কোন পোস্ট দেই নি বিশ্বকাপ নিয়ে। ফেসবুকে আমি ইস্যুভিত্তিক স্ট্যাটাস দেই না, দিতে চাইও না। ইস্যুভিত্তিক স্ট্যাটাস দেয়ার পিছনে অবচেতন মনেও সবার কাজ করে যে আমার স্ট্যাটাসে লাইক পড়বে, ফলোয়ার বাড়বে।


আমার এসব ভবিষ্যৎবাণী সবই দেয়া হয়েছে আমার রুমমেট আর খেলা দেখার সঙ্গীদের কাছে। তা যাই হোক, ব্যাপার না।
বিশ্বকাপ শেষের পথে, আর মাত্র দুই ম্যাচ বাকি। আমি চাই এবারের বিশ্বকাপ মেসি জিতুক। একটা মানুষ তার জীবনে সব কিছুই অর্জন করতে পেরেছে কিন্তু শুধু এই একটা বিশ্বকাপের জন্যে সে অমরত্ব পাবে না ঠিক মতো তা আমি মানতে পারছি না। কালকের পর থেকে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি, মেসির হাতে কাপ, কাপ নিয়ে মেসি উল্লাস করছে। আমি ক্রিকেটে ভারত সমর্থন করি না, তারপরও '১১ তে একমাত্র শচীন টেন্ডুলকারের জন্যে চাইছি যেন ভারত কাপ জিতে যাক, এবারও ঠিক তেমনই।
এবারের বিশ্বকাপে আমার প্রিয় খেলোয়াড় রোনালদোর দল কিংবা তার নিজের ফর্ম খুবই খারপ ছিল, তাই দ্বিতীয় পর্বে উঠতেই পারেনি। রোনালদো অবশ্য ইনজুরির সাথে লড়ে খেলেছে, তবুও পারেনি





ব্রাজিলের কথা কি আর বলবো? সবই আপনার জানেন। বিশ্বকাপে সিনিয়র খেলোয়াড় বাদ দিয়ে তারুণ্যের উপর ভর করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। ব্রাজিলের এই দল বিশ্বকাপ জেতার যোগ্য না, তাই তারা বাদ পড়ে গেছে।
এই বুড়া বয়সে এসে স্কলারির মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, নয়তো লুকাস মউরা, কৌতিনহো এদের মতো উঠতি খেলোয়াড়দের নিতে পারতেন কিন্তু না তিনি নিলেন ব্রাজিলিয়ান লিগে খেলা খেলোয়াড়দের। হাল্ক, ফ্রেড এর চেয়ে অবশ্যই রবিনহো, রোনালদিনহো ভালো চয়েজ হতো। কাকা? তার কথা আর নাইবা বললাম




তাহলে হয়তো নেইমার আহত হওয়ার পরও কোন ভয় থাকতো না ব্রাজিলের।


যাই হোক এবারের বিশ্বকাপে অনেকের খেলা দেখে মন ভরেছে, আমি একটা একাদশ তৈরি করেছি এবারের বিশ্বকাপে যাদের খেলা ভালো লেগেছে এবং যারা পারফর্ম করতে পেরেছে ভালো তাদের নিয়ে।
আমার বিশ্বকাপ একাদশঃ
গোলকিপারঃ
কেইলর নাভাস (কোস্টারিকা)
বিশ্বকাপে একা দলকে কোয়ার্টার পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, অসাধারণ দেয়াল হয়ে ছিল প্রতিটা ম্যাচে।
রাইট ব্যাকঃ
ফিলিপ লাম (জার্মানি)
জার্মানির খেলায় তার কি পরিমান অবদান তা লিখে বুঝানো যাবে না।
সেন্টার ব্যাকঃ
ম্যাট হ্যামেলস (জার্মানি)
দুর্দান্ত ডিফেন্ডার এবং দুইটা হেডে গোলও আছে।
সেন্টার ব্যাকঃ
ভিনসেন্ট কোম্পানি (বেলজিয়াম)
অসাধারণ খেলেছে এবারের বিশ্বকাপে, বেলজিয়ামের ডিফেন্সের দেয়াল।
লেফট ব্যাকঃ
মার্সেলো (ব্রাজিল)
ব্রাজিলের অধিকাংশ আক্রমনই বাম পাশ দিয়ে হয়েছে যার পিছনে কিনা মার্সেলো ছিল। মাঝে মাঝে ড্রিবল করে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে ঢুকে পড়তে দেখা গেছে।
ডিফেন্সিভ মিড ফিল্ডারঃ
হ্যাভিয়ার মাশ্চেরানো (আর্জেন্টিনা)
ভাষায় প্রকাশ করার মতো না তার এবারের খেলা, যদিও তাকে পছন্দ করি না এতটুকুও, তারপরও মুগ্ধ তার খেলায়।
টনি ক্রুজ (জার্মানি)
ক্রুজ জার্মানির অনেক আক্রমনের মূলে ছিল, বেশ ভালো খেলেছে।
রাইট আউটঃ
আরিয়ান রোবেন (হল্যান্ড)
তার কথা বলে লাভ নাই, বলার দরকার দেখি না আপনারাই জানেন।
সেন্টার এট্যাকিং মিড ফিল্ডারঃ
লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা)
আশা করি তার সম্পর্কে কিওছু বলতে হবে না

লেফট আউটঃ
হামেস রড্রিগেজ (কলম্বিয়া)
পিচ্চি পোলা পাঁচ ম্যাচে ছয় গোল কিভাবে দিয়েছে তা আশা করিউ জানেনই।
স্ট্রাইকারঃ
টমাস মুলার (জার্মানি)
পাঁচ গোল নিয়ে জার্মানিকে ফাইনালে তোলার পিছনে তার কৃতিত্ব অনেক। তবে তাকে আমি দেখতে পারি না

স্ট্যান্ড বাইঃ
নেইমার জুনিয়র (ব্রাজিল)
তার কথা আশা করি বলে লাভ নাই নতুন করে, সে তার নামের সুবিচার করেছে এবারের বিশ্বকাপে।
আমার একাদশ হয়তো অন্যের সাথে মিলবে না, আপনার যদি কোন অল্টারনেট থাকে হাতে তাহলে আমাকে সাজেস্ট করতে পারেন। সবাই আশা করি উপভোগ করেছেন পির্য দলের খেলা, খেলা প্রায় শেষের পথে, ফাইনালে যাদের প্রিয় দল জিতবে জানি তার পৃথিবীতেই স্বর্গের স্বাদ পাবেন।
আর্জেন্টিনা সমর্থকরা দীর্ঘ ২৪ বছর পর তাদের দলকে পেলো ফাইনালে, এতো দিন খারাপ খেলার পরও তারা ঠিকই সমর্থন দিয়ে গেছে তাদের প্রিয় দল আর্জেন্টিনাকে। আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা আসলেই সম্মান পাওয়ার যোগ্য, আশা করি এবার তার নিরাশ হবে না '৯০ এর বিশ্বকাপের মতো।
আমি চাই আর্জেন্টিনা কাপ জিতুক, মেসির জন্যে জিতুক, মেসির মতো খেলোয়াড় আর আসবে কিনা কে জানে! পেলে-ম্যারাডোনা বিতর্ক বন্ধ হয়ে যাক, মেসিই যেন সবার চেয়ে উপরে যেতে পারে। ১৩ তারিখে মেসির হাতেই সব চেয়ে বেশি মানাবে বিশ্বকাপ, যদি কাপ মেসির হাতে না উঠে তবে সেক্ষেত্রে বিশ্বকাপ তার যোগ্য লোক পাবে না, ধন্য হবে না।
ভিভা আর্হেন্তিনা
ভিভা মেসি
[পরিমার্জিত]
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:১৩