জানুয়ারীর শেষের দিকে শীত একটু বেশিই জেঁকে বসে। বিশেষ করে রাত বারোটার পর তো কোন কথাই নাই। রাস্তার পাশে যারা ঘুমায় তারা আগুন পাশে জ্বেলে ঘুমায় নয়ত ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে ছেঁড়া কাঁথার নিচে। ঐরাতটা ছিল ঠিক এরকমই, প্রচন্ড শীতের রাত। কুয়াশায় পুরো এলাকা ঢাকা। স্ট্রীটলাইটের আলো কুয়াশা ভেদ না করতে পেরে অদ্ভূত এক রহস্যময়তায় ডুবিয়ে রেখেছিল চারপাশ। সে রাতে সিগারেটখেকো মুরাদের প্যাকেট হঠাত্ করে শেষ হয়ে যায়। প্রেমিকার সাথে বনিবনা আর শয্যাশায়ী মা, এই দুটো সমস্যার সমধানের চিন্তায় মগ্ন থেকে কখন যে প্যাকেট শেষ হয়ে গিয়েছিল তার খবরই ছিল না মুরাদের। অগত্যা এই শীতের রাতে সে গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে আটতলা থেকে নিচে নামল যদি কোন আধখোলা দোকান পাওয়া যায়। তবেই তার সিগার তৃষ্ণা মোচন হবে।
সিগারেট ঠোঁটে চাপিয়ে লম্বা একটা দম নিল, কয়েক সেকেন্ড পর চারপাশে ধূসর ধোঁয়ার কুন্ডলী ছড়িয়ে দিল। এই ধূসর ধোঁয়ার মাঝে মিশে অসীমের দিকে উড়ে গেল শীতের রাতে কষ্ট করে নিচে নামার আক্ষেপ। সিগারেটের প্রতিটা টানই যেন তৃপ্তির নিঃশ্বাস বের করে আনছে তার ভিতর থেকে।
মূহুর্তের মধ্যে খান খান হয়ে গেল রাত্রির নিঃস্তব্ধতা। একটা পুলিশ জীপ সাইরেন বাজিয়ে ছুটছে, কয়েকশ হাত আগেই একটা যুবক ছুটছে। ঘ্যাসঘ্যাস করে ব্রেইক করতেই কয়েকটা পুলিশ নেমে পড়ল জীপ থেকে। তারা সমানে ছুটছে ঐ যুবকের পিছন পিছন। যুবকটি পিছন ফিরে দৌড়াতে থাকায় ধাক্কা খেল সামনের ল্যাম্পপোস্টের সাথে। টাং করে একটা আওয়াজ, সাথে কিছু অকথ্য গালাগাল যুবকের মুখ থেকে। ল্যাম্পপোস্টের নিচের ঘোলা আলোয় যুবকটিকে দেখে নিল মুরাদ। চাদরমোড়া সেই যুবককে সে চিনতে না পারলেও তার হাতে যে একটা বড় ব্যাগ আছে তা টের পেল। হয়তো বড় ব্যাগটার কারনে যুবকের দৌড়ের গতি কিছুটা শ্লথ। কি এমন আছে ব্যাগটার মাঝে যা নিয়ে এমন প্রাণপন ছুটতে হচ্ছে তাকে, মুরাদের কৌতূহল জাগে। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে লাগল শঙ্কা, কৌতূহল ও ভয়ংকর কিছু ঘটার উত্তেজনায়। যুবকটা নিজেকে সামলে নিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল মুরাদের পাশ দিয়ে গলির ভিতর। লক্ষ্য করল আড়চোখে, ব্যাগটাকে দুটো বাসার মধ্যে রয়ে যাওয়া এক চিলতে ফাঁকের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিল। কয়েক সেকেন্ড পর পুলিশেরাও দৌড়ে মুরাদকে পাশ কাটিয়ে গলির ভিতর ঢুকল। মুরাদ লক্ষ্য করল, পুলিশেরা ব্যাগ দেখতে না পেয়ে অন্ধের মতো ছুটছে যুবকের পিছনে। এতক্ষনে হুঁশ ফিরল তার। সিগারেটটা ঠোঁটের কাছে গোঁজতে যাবে যেমনি, দেখে ছাই সরু হয়ে আছে আর প্রায় নিভু নিভু সিগারেট। উত্তেজনায় সে ভুলেই গিয়েছিল টান দেওয়ার কথা। সিগারেটকে টোকা মেরে সে পা বাড়াল ব্যাগের উদ্দেশ্যে।
ব্যাগটা খুলে তখন মুরাদ বিস্ময়ে হতবাক, কি করা উচিত তার সে বুঝে উঠতে পারছে না। চোখের সামনে এতগুলো টাকা সে কেন খুব কম মানুষই হয়তো দেখেছে। বেকারত্বের কারনে বহু ভালো পাত্রের বিয়ের প্রস্তাবে জর্জরিত প্রেমিকার বাবার সামনে দাঁড়াতে না ব্যর্থতা, টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় হাঁপানিতে ধুঁকতে থাকা শয্যাশায়ী মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো তার। আর কোন ভুল নয় জীবনে, শেষ সুযোগটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করা বুদ্ধিমানের কাজ। আশপাশটা আবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো। কোথাও কেউ নেই।