*১*
ক’দিন যাবৎ আইরিন বেশ অস্বস্তিতে আছে। শেষ বিকেলের এই সময়টায় আইরিন বাসা থেকে বের হয়। রাস্তায় হাটা-হাটি করে, আশা অফিসে গিয়ে গল্প করে আর, সবশেষে পুকর পাড়ে শান বাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসে। পুকুর পাড়ে যে জায়গাটায় তার গোধুলীর সময়টা কাটে, সেখানে গত তিনদিন যাবৎ একটা কিশোর ছেলে এসে সন্ধ্যা অবধি বসে থাকে। পুকুরের ওপারের মাঠের পানে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ছেলেটা। আইরিন রোজ এসে ফিরে যায়। ছেলেটার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
পাশাপাশি দুটি দ্বীতল পাকা বাড়ী। মাঝখানে ছোট্ট একটা বাগান। বাগানে ফুল আছে, আছে কিছু সবজিও। পেছনে পুকুর। পুকুরের ওপারে ফসলের মাঠ। সামনে রাস্তাটা সোজা পূর্ব-পশ্চিমে চলে গেছে। রাস্তাটা পশ্চিমে গিয়ে অনতিদুরে যেখানে উত্তরে বাঁক নিয়েছে সেখানে শহীদ স্মৃতি স্কুল এন্ড কলেজ। আইরিনদের বাসার ছাদ থেকে কলেজটা স্পষ্ট দেখা যায়। পাশের বাসাটাও আইরিনদের। আশা নামে একটা এনজিও ওটা অফিসের জন্য ভাড়া নিয়েছে। প্রায় দশ বছর হলো এই আশা অফিসের লোকজনই আইরিনদের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী।
আইরিন; আশরাফ ও নার্গিস দম্পত্তির একমাত্র মেয়ে। আশরাফ সাহেব জুটমিলের ব্যাবস্থাপকের চাকরী ছেড়ে দিয়ে এখন পুরোদস্তর কাঠ ব্যবসায়ী। নার্গিস বেগম বাড়ীর কাছের শহীদ স্মৃতি স্কুল এন্ড কলেজের টিচার। আইরিনের আর একটি ছোট ভাই রয়েছে, বেশ দুরন্ত। নাম জয়, ক্লাশ টুতে পড়ে।
আইরিন রোজ এসে ফিরে গেলেও, আজ সে সোজা ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়-
-হ্যাল্লো?
ছেলেটি চমকে উঠে আইরিনের দিকে তাকায়? আইরিনও চমকে যায়। ছেলেটা যে দেখতে এত সুন্দর! আইরিন ধারনা করেনি। চোখে-মুখে কেমন একটা মায়াবী ভাব। আইরিন মনে মনে ভাবে, “যাহ্ বাবা! এ যে দেখছি উত্তম কুমার!”
-হা করে কি দেখছেন? আমি আইরিন।
-জ্বী, আমি অরিন।
-(ও মাই গড! এ যে দেখছি আমার নামেও ভাগ বসিয়েছে)। কোথায় থাকেন?
-এই অফিসে।নতুন এসেছি।
-ও আচ্ছা! তুমিই বুঝি এই অফিসের নতুন পিয়ন?
ছেলেটি হ্যা সুচক মাথা নাড়ায়।
ধ্যাত্! মেজাজটা আরো বিগড়ে যায় তার। এতক্ষণ সে কিনা পিয়নটাকেই চিনতে পারেনি।
-শোন তুমি এখানে আর বসবে না। এটা আমার বসার জায়গা।
আইরিন হনহন করে চলে যায়।
*২*
অফিসের স্যাররা সবাই সকাল আটটার ভিতরে ফিল্ডে চলে যায়। প্রতিদিন সকালের এই সময়টা অরিন জানালায় এসে দাঁড়ায়। অফিসের সামনে দিয়ে কতশত ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যায়, কলেজে যায়। অরিন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, আর স্মৃতিকাতর হয়। একদিন সেও স্কুলে যেত, কলেজেও গিয়েছিল, তারপর...? অরিন আর ভাবতে পারেনা, তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
স্কুলের উদ্দেশ্যে আইরিন এইমাত্র বেড়িয়েছে। অরিনের সাথে চোখাচোখি হয় তার। আইরিনের আরও একটি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে অরিন। সে কলেজে যাওয়ার সময় রোজ দেখে অরিনকে জানালায় দাড়িয়ে থাকতে। কি দেখে ছেলেটা ওখানে দাড়িয়ে? সে কি তার জন্যই ওখানে দাড়িয়ে থাকে? ছি ছি! এই অফিসের কোন অফিসার তার দিকে এভাবে তাকায়না, শেষে কিনা একটা পিয়ন ছেলে? না না, তা কি করে হয়? ও নিশ্চয় অন্য কারণে দাড়ায়। এইসব হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে আইরিন স্কুলের দিকে এগিয়ে যায়। অরিনের মেঘলা চোখ তার দৃষ্টির অন্তরালেই থেকে যায়।
*৩*
বিরক্তিকর বিষয়গুলোতেও কখনো কখনো মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায়। ইদানিং স্কুলে যাওয়ার সময় আইরিনের বুকে ধুকপুকানি বেড়ে যায়। বেশ ক’দিন হল অরিনকে সে জানালায় দেখেনা। সে’দিন থেকে ছেলেটি পুকুর ঘাটেও আসেনা। আজ কি সে থাকবে জানালায়? ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে আইরিন । ভয়ে ভয়ে তাকায় জানালায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মনটা খারাপ হয়ে যায়। জানালায় কেউ নেই! ওর কি কিছু হলো? আইরিন ভেবে পায়না, তার নিজেরই বা কি হল? যাকে দেখলে বিরক্তি বেড়ে যায়; তার জন্য এমন দুঃশ্চিন্তার কারন আইরিন খুজে পায়না।
আইরিনের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি অরিনের চোখ এড়ায়না। জানালায় অমন করে কি খোজে মেয়েটি? তবে কি তাকেই খুজে ফেরে সে? কিন্তু কেন? ছাদের কিনারে বসে ইদানিং বেশ অবাক হয় ছেলেটি। অরিন এখন আর জানালায় দাড়ায়না। রোজ আইরিনের সাথে চোখাচোখি হওয়াটা তার কাছেও বিরক্তকর। ছাদের কিনারে, ছাদ ঘেষে নারিকেল গাছটার পাতার আড়ালে বসে থাকে সে। কিন্তু ছাদে বসে সে যা আবিস্কার করল তা রিতীমত বিষ্ময়কর! তার মনের মধ্যে কি এক অজানা শঙ্কা আর, সেই সাথে মুখে অস্পস্ট হাসির রেখা ফুটে ওঠে। অরিনের ডায়রী লেখার অভ্যাস আছে। এই মুহুর্তে তার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে। সে তার বেডরুমে ফিরে আসে। ডায়রী এবং কলম হাতে তুলে নেয়।(চলবে)
(উপন্যাস কিভাবে লেখে? চেষ্টা করছি। গল্পটাকে টেনে বড় করার ইচ্ছা আছে। সর্বস্বত্ত সংরক্ষিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৯