মোবাইলে ফেসবুকিং করতে করতে অন্যমনষ্ক ভাবে এক রিকশায় উঠে বসলাম, রিকশাওয়ালা অদৌ যাবে কিনা বা ভাড়া দরদাম না করেই। বললাম অমুক জায়গায় চলেন তো। রিকশাওয়ালাও কিছু না বলে রিকশায় দিল টান। আধবুড়ো রিকশাওয়ালার প্যাডেলের যা জোর দেখলাম তাতে যেন তা ব্যাটারি চালিত রিকশার গতিকেও ছাড়িয়ে গেল। এক সিএনজিকে ওভারটেক করে তার মুখে ফরমুলা ওয়ান রেসিং এর বিজয়ীর হাসি দেখলাম। চলতে চলতে মনে হল এটিএম থেকে কিছু টাকা তোলা দরকার। তাই রিকশা দাড় করিয়ে জাস্ট দু মিনিটের কথা বলে নানা জটিলতায় প্রায় দশ মিনিট রিকশা দাড় করিয়ে রেখে টাকা তুলে আবার রিকশায় উঠলাম। রিকশাওয়ালা গান গাইতে গাইতে আবার টান দিল। পথে যেতে যেতে কোথা থেকে যেন গরম গরম পিঁয়াজু ভাজার ঘ্রান নাকে এসে লাগল। বলেই ফেললাম, ইস খুব মজার পিঁয়াজু ভাজা হচ্ছে মনে হয়। কথাটা রিকশাওয়ালার কানে গেল। সে বল্ল, আপনি পিঁয়াজু খাবেন? খাইলে কিনে নেন, বলে রিকশা স্লো করল। আমি বললাম, না থাক লাগবে না, আপনার দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু সে রিকসা থামিয়ে দিল, বলল না সমস্যা নাই যান কিনেন। আমি কিছুক্ষন ইতঃস্তত করে অগত্যা নেমে পড়লাম। পিঁয়াজু কিনে উঠে বসলাম। গন্ত্যব্যে পৌছে ভাড়া মেটালাম। তাকে পাঁচ টাকা বেশি দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কি মনে করে আর দিলাম না। ভালো লোকদের লোভ দেখানো উচিত নয়, আর আমারও পাচ টাকা বেশি দিয়ে হাজি মুহসিন ভাব দেখানোর অধিকার নেই। রিকশাওয়ালাও আমি যা দিলাম তাই না দেখেই খুশিমনে পকেটে ভরে নিল। বাসায় গিয়ে হটাৎ মনে হল, নাহ ঠিক হয়নি, তাকে আমার এট লিস্ট দুটো পিঁয়াজু অফার করা উচিত ছিল।
আচ্ছা এই রিকশাওয়ালা মানুষটি কি আলাদা ধাতুতে গড়া? তার কাছে কি টাইম ইজ মানি বলে কোনো ব্যাপার নেই? তার মনে এত কিসের আনন্দ? সে কি এই পৃথীবির বিত্তশালী লোকদের পেছনে উঠিয়ে টানতে টানতে বিরক্ত হয় না? ওভাবের কারনে ডিপ্রেশনে ভুগে না? এক নবাবের ব্যাটা যে এটিএম থেকে ক্যাশ তোলে, দামি মোবাইল গুতাতে গুতাতে দরদাম না করেই রিকশায় উঠে। যেখানে সেখানে থামিয়ে টাইম লস করালো। আবার কিনা পিঁয়াজু খাবে। সে তো ভাড়া বেশিও দাবি করতে পারত। আমাকে এক্সট্রা খাতির দেখিয়ে তার কি লাভ? তার তো দিন শেষে ঠিকানা ওই বস্তির ঝুপড়ি।
আজ কোনো কারনে এই রিকশাওয়ালার মন ভালো ছিল। মেজাজ ফুরফুরে ছিল। এবং বেশ তুচ্ছ কারনেই তার মন ভালো ছিল। সে নিশ্চই লটারিতে লাখ টাকা জিতেনি।
কোনো একদিন এই রিকশাওয়ালার মন খারাপ থাকবে। সেদিন সে রিকশায় পা তুলে বসে বিড়ি ফুকতে থাকবে। কোথাও যেতে চাইলে বলবে যামু না। আমি হয়ত বিরক্ত হয়ে বলব, নবাবের ব্যাটা টাকা বেশি হয়ে গেছে তাই মন চাইলেই বলে যামু না। হয়ত সে ১০ টা ভাড়া বাড়িয়ে বলবে, আমিও হয়ত পাচ টাকার জন্য রীতিমত তাকে মারতে বাকি রাখব। তার আচরনের পরিবর্তনের পেছনের কারনটি আমার অজানাই থেকে যাবে।
সুখ কিংবা দুঃখ শুধুই মনের দুই প্রকার অনুভুতি। এই অনুভুতি ধনী কিংবা গরিব নির্বিশেষে একই রকম। এই অনুভুতির তীব্রতা বা লঘুতা মানুষের সোশিয়াল ক্লাসের উপর নির্ভর করে না। এই অনুভুতিগুলো সময়ের সাথে আবর্তিত হয়, সুখের পরে দুঃখ দুখের পরে সুখ। টাকা পয়সা, পেশা শুধুমাত্র সামাজিক অবস্থান নির্ধারন করে, তা কারো অনুভুতির তীব্রতা নির্ধারন করতে পারে না। ফার্মগেটের ওভার ব্রীজ বা রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা খোড়া, চর্ম রোগাক্রান্ত ভিক্ষুকের মনেও মাঝে মাঝে চরম আনন্দ আসে। বেশ তুচ্ছ কারনেই তার মনে আনন্দ হয়। কড়া রোদ পড়ে গিয়ে যখন ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করে, কিংবা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ফোটাও তার মনে অপার্থিব আনন্দ দিতে পারে।
তার পরেও আমরা অর্থ বিত্তের পেছনে ছুটি। এর পেছনেও আমাদের অকাট্য যুক্তি আছে। দুঃখ যেহেতু আসবেই, কান্নাকাটি যেহেতু করতেই হবে তাই ছেড়া কাঁথায় শুয়ে কান্নার চেয়ে মার্সিডিজ বেঞ্জে বসে কাঁদা উত্তম।
আমরা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে চেলেঞ্জের দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ন হই কোনো সুখ স্বর্গে পৌছানোর জন্য নয়, বরং জিতে গিয়ে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। স্বর্গে পৌছানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে মারা যাওয়া। যতই জোরে দৌড়াবেন ততই জটিল গোলকধাঁধায় পৌছবেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১:০৫