‘মা’– শব্দটাতেই লুকানো রয়েছে জাদু। ‘মা’ আর এক জোড়া জাদুর চশমাকে কেন্দ্র করে এই গল্প আবর্তিত। তবে গল্পটির শুরুর পর্বটি নিতান্তই মামুলি। পারস্য উপসাগর আর বঙ্গোপসাগরের হাওয়া জল গায়ে লাগিয়ে বেড়ে ওঠা দু'টি কিশোরীকে ঘিরে এই গল্পের শুরু। সুখু আর দুখু। নাহ, নামগুলো বড্ড সেকেলে শোনাচ্ছে। অন্য নাম রাখা যাক। লাবণ্য আর বীণা। একাধারে জেমস ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি আর বাগেরহাট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী দু'জনেই। মুখোমুখি দেখা হয়নি কখনও। ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব। ফেইসবুকে পরিচয়। এ পর্যন্ত গল্পে জাদুর রহস্যময়তার নামগন্ধও নেই।
মা দিবসে আজ দু’জনের স্কুলেই রচনা প্রতিযোগিতা ছিলো। রচনার বিষয়বস্তু ‘মা’। লাবণ্য আর বীণা দু’জনেই যার যার স্কুল থেকে প্রতিযোগীদের মধ্যে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে। কাকতালীয় ঘটনা। চোখে পড়ার মত কোন অস্বাভাকিতা নেই ঘটনায়। দুই কিশোরীই নিশ্চিত যে, ত্রিভুবনে তাদের মা-ই সেরা। কাজেই, ‘মা’ কে নিয়ে লেখা রচনা প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার তাদের ঘরে শোভা পাবে, এতে আর আশ্চর্য কীসে!!
রহস্যের শুরু পুরস্কারের মোড়ক খুলবার পর থেকে। ফেনিল রহস্যময়তার ঊর্মিমালা ওদের দু'জনের জীবন-বেলাভূমিতে আছড়ে পড়লো। দেখা গেল, দু'জনে একই পুরস্কার পেয়েছে। দু'টো ক'রে জিরো পাওয়ারের চশমা। প্রথম চশমাটিতে গোলাপ-রঙা টিনটেড প্লাস্টিকের লেন্স বসানো। দ্বিতী্যটিতে ধূসর-রঙা টিন্ট। অবিকল মিলে গেছে দু'জনের পুরস্কার! চশমা-জোড়ার সাথে একটা ইনস্ট্রাকশন নোটে চশমা-জোড়ার ব্যবহারপ্রণালী সম্পর্কে লেখা। ইনস্ট্রাকশন নোটের লেখা এখানে হুবুহু তুলে দেওয়া হল।
"অভিনন্দন বীণা, অভিনন্দন লাবণ্য!! কেবল একটি চশমা ব্যবহার করতে পারবে তোমরা। একটি ব্যবহার করামাত্রই অন্য চশমাটি শূন্যে মিলিয়ে যাবে। কাজেই সাবধানে বেছে নাও কোন রঙের লেন্স পছন্দ তোমাদের। দিনে-দুপুরে কখনোই চশমা পরবে না। পরলে চশমা তার জাদুকরী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। ঘুমুতে যাবে চশমা চোখে। স্বপ্নে তোমাদের মা'কে দেখবে। তোমার মা'র জীবনের গল্প। যদি গোলাপ-রঙা চশমাটি বেছে নাও, তবে স্বপ্নে দেখবে তোমার মায়ের জীবনের সুরভিত গল্প। আর যদি বেছে নাও ধূসর-রঙা লেন্সের চশমাটি, তবে সাবধান! যা দেখবে, তা তোমাদের মায়ের জীবনের ধূসরিত অজানা অধ্যায়।"
তাজ্জব বনে যায় দুই বান্ধবী। ইনস্ট্রাকশন নোটে তাদের নাম লেখা থাকলো কিভাবে?!! তবে কি সব আগে থেকেই ঠিকঠাক করা ছিলো? এই যে ফেইসবুকে দুই বান্ধবীর পরিচয় হল - এই যোগসূত্রও কি ম্যাজিক্যল? ভেবে কোন কূল-কিনারা পায় না। ফেইসবুকে চ্যাট করে দু'জনে ঠিক করে যে লাবণ্য রাত্তিরে ঘুমুতে যাবে গোলাপ-রঙা চশমা চোখে, আর বীণা বেছে নেবে ধূসর-রঙা লেন্সের চশমা। স্বপ্নে কে কি' দেখলো, তা পরদিন দু'জন দু'জনকে সব খুলে বলবে। চশমা-জোড়া আগের মত খুব সাবধানে মোড়কে লুকিয়ে রাখে তারা।
/দুই/
লাবণ্যর বেডরুম। এরিয়েলের দ্য লিটল ম্যরমেইড থীমের শৌখিন আসবাবে সুশোভিত শয়নকক্ষ। গোলাপ-রঙা লেন্সের চশমা চোখে ঘুমে অচেতন লাবণ্যর বালিশে গোঁজা হাসি-হাসি কোমল মুখটা ডিমলাইটের আলোয় আরও সুন্দর, আরও কোমল দেখাচ্ছে।...
আ য় স্ব প্ন ঝেঁ পে, আ য়!...
"সম্ভ্রান্ত বংশের বা্চ্চা দত্তক দেওয়া হবে। যোগাযোগ করুন "অমুক" নম্বরে।"
অনন্যা (লাবণ্যর মা): হ্যালো, শুনছো? প্রথম আলোর একটা আ্যাড তোমাকে ফরওয়ার্ড করসিলাম। দেখবা একটু?
(লাবণ্যর বাবা): (অ্যাডে চোখ বুলিয়ে) তুমি কি ওদেরকে ফোন করার কথা ভাবতেসো?
- হুমম।
- মাথা খারাপ হইসে তোমার??! বাংলাদেশের দালালের চক্করে পড়তে চাও?
- আরে, ফোন করলেই কি দত্তক নেওয়া হয়ে গেল না কি? ফোন করতে তো ক্ষতি নাই।
- শোন ১৫ মিনিট পর আমার একটা মিটিং। মিটিং শেষ করে তোমারে ফোন দিতেসি, ওকে?
- আচ্ছা।
- (মিটিং শেষে) ফোন করসিলা? প্রথম আলোর অ্যাড?
- হুম।
- কি বললো?
- জেনুইন কেইস বলেই তো মনে হচ্ছে।
- ক্যামনে বুঝলা?
- ইনট্যুইশন।
- ইনট্যুইশন!
- আরে না। খোঁজ-খবর তো নিবই। পুরা sure না হয়ে কি আর দত্তক নিবো?
- কোন বিপদে যে পড়বা! ঝামেলায় না জড়ালে ভালো লাগতেসে না?
- তুমি আমার প্রমিজের কথা জানো না? তুমি কিন্তু বলসিলা সব রকমের হেল্প করবা।
- হেল্প কি করি নাই?
- তা করসো।
- কত রকমের ট্রেনিং নিলা, সব সময়েই তো সাপোর্ট করলাম। কিন্তু এখন এই অ্যাডটা - এটা ভীষণ রিস্কি।
- খোঁজ খবর করে দেখি।
- ঘটনা কি?
- স্বামী-স্ত্রী অল্পবয়সী। বৌটার নাম বীথি। এটা ওর চার নম্বর প্রেগনেন্সি। বা্চ্চা পালার সামর্থ নাই। তাই দত্তক দিতে চা্য়।
- কার না কার বাচ্চা!
- কার বাচ্চা, তা' তো ভেরিফাই করা খুবই সহজ। এখনও ডেলিভারী হয়নি।
- স্বামী-স্ত্রী?
- তাইতো বললো।
- "সম্ভ্রান্ত বংশের" স্বামী-স্ত্রী বাচ্চা দত্তক দিতে চায়, শুনসো জীবনে?
- স্বামী-স্ত্রী না হলেই বা কী আসে যায়। বাচ্চা তো বাচ্চাই - নিষ্পাপ। আমাদের তো এতিমখানা থেকেই অ্যাডপশনের প্ল্যান ছিলো, তাই না?
- তারপর বাচ্চা বড় হয়ে যখন জানবে আমরা আসল বাপ-মা না, তখন তো অঘটন ঘটাবে।
- তা কেন ঘটাবে? আমি তো শুরু থেকেই কিচ্ছু লুকাবো না। মিথ্যা বলবো কেন?
- অনেক সমস্যা। ধর, লাবণ্যই যদি বড় হয়ে ওকে উঠতে বসতে কথা শোনায়, যে ও নিজে বায়োলজিক্যল চাইল্ড, আর ঐ বাচ্চা পালক। তখন বিরাট সাইকোলজিক্যল সমস্যার শুরু দেখবা।
- মায়ের পেটের ভাইবোনের হাতে খুনের খবর পড় নাই? ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? আমাদের মেয়ে হয়ে লাবণ্য এত নোংরা মনের হবে বলে তোমার মনে হয়? এই শিক্ষা দিয়ে বড় করতেসি ওকে?
- তারপর সেই পালক বাচ্চা বড় হলে ওর বিয়ে ক্যামনে দিবা?
- যেই শ্যালো মানুষ জন্ম-পরিচয়ের কারণে ওকে বিয়ে করতে চাবে না, সেই শ্যালো মানুষের সাথে আমার বাচ্চার বিয়ে না হওয়ার খুশীতে আমি একশো সেজদা দিবো। ফকির খাওয়াবো।
- দুনিয়াটা এত সোজা?
- দুনিয়ায় কি তোমার-আমার মত আর মানুষ নাই?
- হুমমম, এখন ফার্স্ট থিং ফার্স্ট। আগে খোঁজ খবর নিতে হবে যত রকমের সম্ভব।
- নেওয়া শুরু করেছি অলরেডি। স্কাইপে মুখোমুখি কথা বলারও প্ল্যান করছি। তুমিও হেল্পাও।
- ওকে। ওদের পার্টিক্যুলার্স আমাকে ই-মেইল করে দাও।
- আচ্ছা।
/তিন/
বাড়িতে বীণা ও তার ছোট দুই ভাইবোনের একই খাটে আঁটাআঁটি করে ঘুমোবার নিয়ম। রাত গভীর হলে সবাইকে লুকিয়ে চুপিচুপি মোড়ক খুলে ধুসর লেন্সের চশমা চোখে দেয় বীণা। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।...
আ য় স্ব প্ন ঝেঁ পে, আ য়!...
বীথি।
বাইশ বছরের তরুণী। বীণার মা। সন্তান-সম্ভবা।
গায়ের তামাটে রঙের আড়ালে এককালের দুধে-আলতা চেহারার আভাস মেলে। অসম্ভব মেধাবী ছাত্রী ছিলো। এই তো সেদিনের কথা। বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান পাবার পর ঢাকা মেডিক্যল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় আনন্দের ধুম পড়ে গেল বাড়ীতে। কিন্তু বীথির বুকটা প্রিয় মানুষটার জন্য হু-হু করে উঠছিলো থেকে থেকে। এত বছরের প্রেম! সে-ও বীথিকে বাগেরহাট ছেড়ে ডি.এম.সি.-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে দিতে একেবারেই রাজী নয়। বীথি যতই বোঝা্য় প্রিয় মানুষটার মুখে ঐ একই কথা, "আমাকে ফেলে চলে যাবে? পারবে তুমি? ভালবাসো আমাকে? ভালোবাসলে প্রমাণ দাও!" পাড়ার মেসে থাকা অবুঝ প্রেমিককে আশ্বস্ত করতেই বীথি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলার। ডি.এম.সি. তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। সে তো রইলোই। কয়েক বছরের মধ্যেই পাশ করে ডাক্তার হয়ে বেরুবে। সেদিন বীথি বুঝতে পারেনি জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ, জীবনের মোড়ঘুরানো সিদ্ধান্ত ছিলো সেটি।
পালিয়ে বিয়ে করায় বাবা-মা বীথির সাথে সব রকমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। বিয়ের পরপরই একের পর এক সন্তানের জন্ম হল - বীণা, তারপর আরও দুই ছেলেমেয়ে। ডাক্তারী পড়ায় গ্যাপ পড়ে গেছে শুরু থেকেই।
যেদিন জরায়ুতে চতুর্থতম প্রাণসঞ্চারের আভাস পায়, সেদিন বীথির কাঁচের পৃথিবীটা ভেঙে চৌচির হয়ে পড়ে। বারবার ব্যবসায় মার খেয়ে স্বামীর আর সংসার টানার সামর্থ নেই - অ্যাবরশনের জন্য পীড়াপিড়ি করে বীথিকে। মেডিক্যলের ছাত্রী বীথি কোনক্রমেই অ্যাবরশনের প্রস্তাবনা মেনে নিতে পারে না। বারবার স্বামীর মুখপানে চেয়ে পুরানো প্রেমিকের চোখ-জোড়ায় মুগ্ধতার রেশ খুঁজে ফেরে - মর্চে ধরা সম্পর্কের গহীনে, চাই পরমাণুসমই হোক না কেন, কোমলতা আর শ্রদ্ধাবোধের যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, সেই আশায়। অনেক কাকুতি-মিনতির পর স্বামী রাজী হয় অ্যাবরশন না করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেবার জন্য। অনাগত সন্তানের জন্য পালক বাবা-মা'র খোঁজ করে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি।
ছোট দুই ভাইবোনের ঘুমে-বিভোর শান্ত, সমাহিত মুখচ্ছবির পাশাপাশি বীণার যন্ত্রণাক্লিষ্টতার সুস্পষ্ট ছাপ-পড়া রেখার ভাঁজ-তোলা ঘুমন্ত মুখখানি বড্ড বেমানান দেখাচ্ছে। কিন্তু ওর স্বপ্নের দৃশ্যপটগুলো এমনই হবার কথা ছিলো, অলঙ্ঘনীয় নিয়মে। কারণ বীণা বেছে নিয়েছিলো ধুসর-রঙা চশমা। কাজেই, বীণার এই দুঃসহ দুঃস্বপ্নের রাত।
/চার/
জীবন নামক মঞ্চের দৃশ্যপট কী বদলানো সম্ভব? টাইম-মেশিনে কালাতিক্রমণে যদি সব বদলানো যেত, গোড়া থেকে শুরু করা যেত সবকিছু, তবে কী সব ভুলগুলো এড়ানো যেত? না-কি একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হত? ভুলের সাত-পাকে-বাঁধা পঙ্কিল জীবনের পুনরাবৃত্তি? কপালের লিখন? মায়ের জরায়ুতে নবজাত প্রাণীকোষের জেনেটিক কোডে কী কী তথ্য খচিত থাকে? জেনেটেসিস্টদের হাতে গবেষণার ভার চাপিয়ে আপাততঃ ফিরে যাওয়া যাক লাবণ্যর শয়নকক্ষে, যেখানে লাবণ্য এখনও ঘুমিয়ে।
রা ত এ খ ন ও বা কী - সে ই সা থে স্ব প্নে র গ ল্প গাঁ থা...।
আ য় স্ব প্ন আ য়...।
অবশেষে সুদীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, অধ্যবসায় আর প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে। অনন্যার গর্ভে যখন লাবণ্য, তখনই সে প্রতিজ্ঞাটা করেছিলো। অনাথ অসহায় কোন শিশুর ভুবন ভালোবাসায় ভরে দেবার প্রতিজ্ঞা। ওর বর প্রথম প্রথম মৃদু আপত্তি করে জানিয়েছিলো যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই তো হয়, কিন্তু অনন্যা যখন 'ভরণ-পোষণ' আর 'লালন-পালন'-এর মধ্যেকার বিস্তর ব্যবধানটুকু ব্যাখ্যা করলো, তখন দত্তক নেবার প্রস্তাবে সে সম্মতি জানিয়েছিলো। কর্তব্যবিমুখ সরকারের যতদিন না শুভবুদ্ধির উদয় হয়, অনাথ শিশু দত্তক নেবার মাধ্যমে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উত্তরসুরীদের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দেবার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে অনন্যা বিভিন্ন সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতো দত্তক নেবার মেসেজ প্রোমোট করে। নিজের কথা আর কাজে যেন ফাঁক না থাকে, নিজের কাছে নিজে যেন ভণ্ড সাব্যস্ত হয়ে না যায়, সে জন্য শিশুসন্তান দত্তক নেবার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর ছিলো সে। ওদের জানা ছিলো না কতখানি দুর্গম আর কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে ঐ প্রতিজ্ঞা রাখতে! অনন্যা ভেবে পায়নি মহতী উদ্যোগে প্রতি পদে এত বাধা-বিপত্তি আসে কেন! অথচ স্খলনের চোরাবালিতে তলিয়ে যাবার প্রক্রিয়া কত সোজা! সমীকরণ মেলে না। তবুও জীবনের পরীক্ষায় হারেনি ওরা। ওদের প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়িত হতে চলেছে অবশেষে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রচেষ্টা - তারপরও মানুষ হিসেবে, পৃথিবীর অধিবাসী হিসেবে, পৃথিবীর জন্য কিছু তো একটা করা হবে! পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় কোন প্রাণের জন্য ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। অযুত ঝরে-পড়া পথকলির ভীড়ে অন্ততঃ একটি কলি যেন অকালে ঝরে না গিয়ে প্রস্ফুটিত হতে পারে তার প্রতিশ্রুতি! অবশেষে তারা সফলকাম হতে চলেছে। বীথির অনাগত সন্তানকে দত্তক নেবার আইনী পদক্ষেপ নেওয়া সহ সব রকমের প্রস্তুতি সমাপ্ত হবার পথে।
- হ্যালো, অণু। বীথির বরের সাথে ফোনে কথা হল। কালকে বীথির অপারেশনের তারিখ পড়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার দেখসো? আগামীকাল লাবণ্যরও জন্মদিন।
- হুঁ, আমিও এটাই চিন্তা করছিলাম। ভাবাই যায় না!
- ওরা তোমাকে বাচ্চার নাম ঠিক করে দিতে বলসে।
- ঠিক করে রাখসি তো। আরণ্যক।
- বাব্বাহ! বড় মেয়ে, ছোট ছেলে দু'জনেই দেখি জগদ্বিখ্যাত উপন্যাসের পাতা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে! এখন তোমার পোয়াবারো ঠেকায় কে!
- ভাল হবে না কিন্তু! সবার নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখলাম! তুমি কী করতেসো অফিসে বসে বসে?
- আমাদের তিনজনের বাংলাদেশে ফ্লাইটের বুকিং কনফার্ম করতেসি এই রোববারে। আর ডেলিভারীর সময়ে আমাদের পক্ষের কাউকে হাসপাতালে রেখে পুরো ব্যাপারটা মনিটর করাটাও খুব জরুরী। ব্যবস্থা করা লাগবে এক্ষুণি। ওরা তো পারলে আগামীকালই বাচ্চা আমাদের দিয়ে দ্যায়। অস্থির হয়ে গেসে একদম।
- হুম, তা তো হবেই। মায়া বাড়াতে চায় না। আচ্ছা, আমি রাখি। লাবণ্যকে স্কুল থেকে পিক-আপ করে জন্মদিনের কেক দোকান থেকে আনা লাগবে।
- দেখ তো, একটা pram কিনতে পারো কী না আজকে। আর তো সময় বের করতে পারবা না ফ্লাইটের আগে আগে।
- আহাহা! শুধু আমার পোয়াবারো? নিজে যে আহ্লাদে আটখানা, বাচ্চা এখনও বিদেশ পাড়িই দিলো না, তার আগেই pram কিনার পাঁয়তারা।
- হা হা হা। এখন রাখি, অণু। বাসায় ফিরে কথা হবে। বাই।
- টাটা।
/পাঁচ/
লাবণ্য'র জন্মদিনে শুকরিয়ার নামাজ আদায় করার বহুদিনের অভ্যাস অনন্যার। আজকে থেকে আলাদা করে আরণ্যকের জন্যও শুকরিয়ার নামাজ যোগ হল। আজ ডেলিভারীর দিন। লাবণ্য আর আরণ্যকের জন্মদিন একই দিনে হল! এটা কি কাকতাল, না-কি পূর্ব নির্ধারিত? ক'দিন পরেই অনন্যা সপরিবারে দেশে যাবে বাচ্চাটাকে লিগ্যালি অ্যাডপ্ট করবার জন্য। জায়নামাজে বসে কল্পনায় তন্ময় হয়ে পড়ে সে। সেদিনটা কেমন হবে যেদিন বীথি তার নবজাত শিশুকে চিরতরে অনন্যার কোলে সমর্পণ করবে? মা'র নাড়ী-ছেঁড়া ধন কিভাবে ছিনিয়ে নেবে সে? সেই দৃশ্য অন্যনার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব! অনন্যা কী বীথি'র পা স্পর্শ করে ক্ষমা চাইবে? কিন্তু অনন্যা দত্তক না নিলেও, ওরা বাচ্চাটাকে অন্য কারো কাছ সমর্পণ করবে।
আরণ্যক বড় হয়ে যখন জানবে, ওর বড় তিন ভাইবোন আছে যারা বাবা-মা'র ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছে, তখন ওর মনের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করে অনন্যা। একটা খাটে তিন ভাইবোনের সাথে ঘুমুতে আর কতখানি বাড়তি জায়গা লাগতো ওর? আর কয় মুঠো বাড়তি চালের ভাত খেত সে? নিষ্ঠুর ধরায় ছোট্ট, নিষ্পাপ আগন্তুকের নিজের বাবা-মার ঘরেও ঠাঁই মিললো না! এসে পৌঁছাতেই পারলো না - ভূমিষ্ট হবার আগেই ওকে তাড়িয়ে দেবার জন্য চারদিকে এত আইনী ষড়যন্ত্র!
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রিংটোন বেজে উঠলো সেলফোনের। এত ভোরে ফোন! নিশ্চয়ই বীথির খবর! জায়নামাজ থেকে অনন্যা উঠে দাঁড়াবার আগেই পাশের ঘর থেকে অধীর পদক্ষেপে দৌড়ে এসে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডফোন নিয়ে কানে চেপে ধরলো ওর বর।
/ছয়/
জরায়ুর আঁধার ঘরে নয় মাস একাকী প্রতীক্ষার শেষে ছোট্ট আগুন্তুক সেদিন ভোরে কড়া নাড়লো পৃথিবীর। মাত্র কয়েক ঘন্টার অতিথি হয়েই এসেছিলো, না-কি অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে চলে গেল, বোঝা গেল না। শ্রবণেন্দ্রিয়ে সুমধুর আজানের ধ্বনি পৌঁছাবার আগেই শ্বাসকষ্ট শুরু হল - অক্সিজেনে ভরপুর পৃথিবীও কার্পণ্য শুরু করলো ছোট্ট ফুসফুস-জোড়ায় বাড়তি অক্সিজেনের ভাগ দিতে। মসজিদের লাগোয়া গোরস্থানে যখন শিশু আরণ্যকের আশ্রয় মিললো, তখন পৃথিবীর কাছ থেকে ভালোবাসার উপহারস্বরূপ অনন্যার পছন্দে রাখা নামটাই কেবল সাথে নিয়ে গেল।
লাবণ্য আর বীণার স্বপ্নের এখানেই শেষ। একটি রাতের স্বপ্নের গল্প। বীণার জন্য ঐ রাতটা ছিলো দুঃসহ দুঃস্বপ্নের রাত। সে যে ধূসর-রঙা চশমাটি বেছে নিয়েছিলো! ঘুম ভাঙতেই অন্য চশমাটো শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ায় লাবণ্য কখনই দুঃস্বপ্ন দেখেনি মা'কে নিয়ে। মা'কে নিয়ে ওর ছোট্ট জগৎটা সবসময়েই সুরভিত।
অতীত জীবনের দৃশ্যপট কদাচ পরিবর্তন করা সম্ভব না গেলেও, এই গল্পটির দৃশ্যপট খুব সহজেই পাল্টানো যা্য়। লেখক সেই অর্থে ঈশ্বরের চাইতেও বেশী শক্তিশালী।
কাজেই লাবণ্য'র স্বপ্নের দৃশ্যপট পাল্টিয়ে দেওয়া যাক। ওকে ধূসর-রঙা চশমা পরানো হোক ঘুমুতে যাবার সময়।
আ য় স্ব প্ন ঝেঁ পে, আ য়!...
/সাত/
অনন্যার মুখোমুখি অনন্যা। দৃষ্টি নিবদ্ধ আয়নায়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পেরিয়ে গেছে অনন্যার এভাবে নিভৃতে একাকী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিবেকের সাথে সংলাপ চালিয়ে। মৃত্যুর ওপারে কী তার ছোট্ট শিশুটির সাথে আবারো দেখা হবে, ভূমিষ্ট হবার আগেই যাকে সে নিজ হাতে হত্যা করেছে? কুমারী জীবনে গর্ভে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা ভ্রুণ, অনন্যার আত্মজা। মানুষের বেশে মামণি'র মুখোমুখি হবার ঔদ্ধত্য দেখাতে পারবে না সে। অন্য ভুবনে ডানায় ভর করে পাখির বেশে দূর থেকে মেঘের ফাঁক দিয়ে তার নাড়ী-ছেঁড়া ধনের নিষ্পাপ কোমল মুখাবয়ব পানে অতন্দ্র চেয়ে থাকবার আমৃত্যু প্রার্থনা অনন্যার। 'মা' সম্বোধন করে কোনদিনও বুকে জড়িয়ে ধরবার স্পর্ধা দেখাবে না অনন্যা, কিছুতেই না।
===== সমাপ্ত =====
* গল্পের শিরোনাম: 'মেইট্রিক্স' শব্দটির উৎস ল্যাটিন ভাষা থেকে, যার একটি অর্থ 'জরায়ু' বা 'গর্ভ'। তা'ছাড়া ১৯৯৯-এর চলচ্চিত্র 'মেইট্রিক্স'-এর জনপ্রিয় "রেড পিল, ব্লু পিল" কনসেপ্ট এই গল্পে ধার করা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৭