এই ধারাবাহিক লেখাটি হল নন-ফিকশন জনরার। এ'কারণেই '১০১' লেবেল এঁটে স্থূল রসিকতার প্রয়াস। এই লেখা স্রেফ স্বগতোক্তি, অনলাইন ডায়েরী। ছোটবেলায় স্কুলপড়ুয়াদের দেখতাম কেমন শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে পড়া মুখস্থ করতে; তারই ছায়ায় এই সরব স্বগতোক্তির আঁকিবুঁকি। ভাগ্যচক্রে যদি এই স্বগতোক্তি কোন বিষণ্ণ প্রাণের আরোগ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ভূমিকা রাখে, তো মন্দ কী!
সুদীর্ঘ রজনী অতন্দ্র কাটাবার পর স্থির করলাম যে, 'বিষণ্ণতা' নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখবো, কীভাবে এই ভয়ঙ্কর অসুখ থেকে নিষ্কৃতি সম্ভব।
এভাবে মাস পেরিয়ে বছর গড়িয়ে গেল, দেখা গেল, লেখা শুরুই হয়না -- লেখিকা নিজেই বিষণ্ণ জড়ভরত। ডিপ্রেশানে যারা ভোগেন, তাঁদের প্রথম আর প্রধান সমস্যাই হল মোটিভেশনের অভাব। দেখা গেল, দিন গড়িয়ে যায়, ডাক্তারের কাছে আর যাওয়াই হয়ে ওঠেনা। কাজেই চিকিৎসা শুরুই হয় না কখনো।
আমাদের সংষ্কৃতিতে আরো ভয়াবহ সমস্যা হল, 'বিষণ্ণতা রোগ' কে 'ঈমানের অভাব' কিংবা কল্পনাপ্রসূত মনে করা। একটা সময় ছিলো, যখন ওলাদেবী (ওলাবিবি), মনসা দেবী, শীতলা দেবী'র রোষানলে পড়লে কলেরা ও বসন্তের প্রকোপ হয় বলে বদ্ধমূল ধারণা ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশে। ধীরে ধীরে কলেরা আর বসন্তের টীকা'র উদ্ভাবন হল, টীকা সহজলভ্য হল। "বিষণ্ণতা", ইংরেজীতে যাকে বলছি "ডিপ্রেশন" - এই অসুখেরও সলিড বায়োলজিক্যল রুট আছে। পশ্চিমা বিশ্বে এই তথ্য সুবিদিত এবং সর্বজনগৃহীত হলেও, আমাদের সংষ্কৃতিতে খানিক সন্দিহান দৃষ্টি এর উপর নিবদ্ধ। আমার তথ্য-উপাত্ত সবই অস্ট্রেলিয়া-নির্ভর, আমার নীড় ওখানেই যে!
* প্রতি পাঁচজনে একজন জীবনের কোন না কোন সময়ে বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগের তীব্রতা এবং সময়কাল রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেদে বদলায়।
* প্রতি বিশজনে একজন (ক্রনিক) "ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার"-এর স্বীকার হয়।
* বিষণ্ণতা রোগের জেনেটিক ফ্যাক্টর আছে। জেনেটিক সূত্রে কেউ কেউ বিষণ্ণতাপ্রবণ হয়ে থাকেন।
* শরীরে হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে বিষণ্ণতা রোগ দেখা দিতে পারে।
* সঠিক চিকিৎসায় বিষণ্ণতা রোগ থেকে পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
* জীবনে নানা প্রতিকূলতায় মনে বেদনা, সংশয়, যাতনা দানা বাঁধতেই পারে। "বিষণ্ণতা রোগ" আর "বিষণ্ণতা" এক এবং অভিন্ন নয়। চিকিৎসা শাস্ত্রে এটাকে তখনই *রোগ* হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যখন এর স্থায়ীত্বকাল হয় মিনিমাম একটানা দু'সপ্তাহ। দু'সপ্তাহ যাবৎ একনাগাড়ে বিষন্ন থাকলে - কোন কাজে আনন্দ, উদ্দীপনা না থাকলে; দৈনন্দিন কাজকর্ম করাটাও কষ্টকর মনে হলে; যে সব কাজ শখের বশে করা, সেগুলোও বিরক্তিকর মনে হলে, চিকিৎসা শাস্ত্র মতে তবেই কেউ "বিষণ্ণতা রোগে" আক্রান্ত বলে বিবেচিত হবেন।
আমার সরব স্বগতোক্তিতে তথ্য-উপাত্তের রেফারেন্সের তালিকা দেবার পরিশ্রমে যাচ্ছি না। তথ্য-বিস্ফোরণের যুগে রেফারেন্স মিলবে আঙুলের ডগার এক গুঁতোতেই!
বরঞ্চ অন্দরমহলের কিসসা শোনাই। বুঝতে পারছিলাম আমি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তারের কাছে যাওয়া খুব প্রয়োজন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে তো বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে কোন লেনদেন নাই। তার অর্থ দাঁড়ালো, টেলিফোন করে প্রথমে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। কিন্তু বাসার বাইরে যে-কারো সাথে কথা বলতেই অসহ্য লাগতো তখন! বাসার স্বজন যখন আমার হয়ে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করে রাখলেন, তাতেও খুব একটা লাভ হল না। ঘুম ভেঙে তখন চোখ মেলতে অসহ্য লাগে, বিছানা থেকে নামতে গেলে ঘেমে-নেয়ে উঠি, এরপর আবার হাত-মুখ ধোয়া, জামা-কাপড় বদলানো! পায়ে জুতো কিংবা স্যান্ডেল গলিয়ে সিঁড়ি ভাঙা! তারপর ট্যাক্সির খোঁজ করা! এত কিছু করার মানসিক শক্তি থাকলে তো আর ডাক্তারের কাছে যাবার দরকারই পড়তো না - এমনিতেই দিব্যি থাকতাম! এটাই হল বিষণ্ণতা নামক অসুখের ভয়াবহ চক্র। এভাবেই গড়াতে থাকলো প্রহর, গড়াতে গড়াতে বছর আসে, বছর যায়।
তারপর সিডনীতে একটা অভিনব আঙ্গিক চালু হল বিষণ্ণতা রোগের চিকিৎসায়। অনলাইন হেল্প ডেস্ক। সিডনীর Macquarie ইউনিভার্সিটির প্রফেসর নিক তিতভ এবং ডঃ ব্লেইক ডিয়ারের পরিচালনায় বিষণ্ণতা রোগের নিরাময়ের লক্ষ্যে ই-ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠা। আমি সেই বিটা টেস্টিং সাগ্রহে অংশগ্রহণ করলাম।
আমার দ্বারা ঘরের বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। নিঃশ্বাস নেওয়াতেই সমস্ত মানসিক শক্তি খরচ হয়ে যেত। অনলাইন বিটা টেস্টিংয়ের গিনিপিগ হবার সুযোগ আমি লুফে নিলাম। আমার ধারাবাহিক লেখায় বিষণ্ণতা থেকে বাঁচবার মূলমন্ত্রগুলো ঐ অনলাইন শিক্ষাসফর থেকেই সংগৃহীত হবে, আঁকিবুঁকির প্রলেপ একান্তই আমার।
ধারাবাহিকে যা থাকছে -
* প্রতি পর্বে বিষণ্ণতার সাথে লড়বার জন্য জীবনযাপনের অভিনব কৌশল সংক্রান্ত আলোচনা,
* 'এসো নিজে করি' গাইডলাইন,
* 'জীবন থেকে নেওয়া' - বাস্তবে-ঘটা গপ্পো
* সাপ্লিমেন্টারী নোটস।
শরীর ও মন সুস্থ থাকলে ফের দেখা হবে আগামী সপ্তাহে, ইনশাল্লাহ!
==
উৎসর্গপত্র:: অনুজপ্রতিম (শুধু বয়সের বিবেচনায়) ও বন্ধু, সুহৃদ, সুলেখক ফারুক আব্দুল্লাহ, যিনি বিষণ্ণতার দিনগুলিতে গভীর মমতায় পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন।
==
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ভোর ৫:১০