[নীচে মুখবন্ধ** সংযোজন করা হল]
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তবে তখনও তন্দ্রা পুরোপুরি কাটেনি।
ঘুমঘুম ভাবের মধ্যেই বেশ আশ্চর্যবোধ করলাম। দরজা তো লক্ করে ঘুমিয়েছি, বাইরে থেকে খোলার প্রশ্নই আসে না। হঠাত্ মনে হল, কেউ আমার লেপের ভেতর ঢুকে পড়ল। প্রচন্ড আতংকিত হয়ে পড়লাম। তবু কি আশ্চর্য - ঘুমের রেশ চোখে জড়িয়ে, চোখ খুলতেই পারছি না। কোনমতে চোখ দুটো আধো খুলে দেখলুম, না কেউ নেই। দরজাটাও লক্ড্ রয়েছে। সাথে সাথে চোখের পাতা ভারি হয়ে গেল।
কিছু মুহুর্ত কাটল চুপচাপ। তারপর আবার দরজার ক্যাঁচক্যাঁচানি। কেউ আমার লেপ ধরে টানছে। স্পষ্ট তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি - লেপের কুঞ্চন অনুভব করছি শরীরে। আমি তো বিস্ময়ে ও ভয়ে অভিভূত। হচ্ছে কি এসব!
মাস তিনেক হল অস্ট্রেলিয়াতে এসেছি, মেলবোর্ণে। এখনও কোনকিছুর সঙ্গেই ভালভাবে খাপ খাওয়াতে পারিনি নিজেকে। প্রতিদিনই ঘুম ভেঙ্গে কোথায় রয়েছি বুঝে উঠতে বেশ কিছু সময় পেরিয়ে যায়।
বাবা ইমিগ্রেশান নিয়ে এসেছেন, সাথে মা, শ্যামল আর আমি। শ্যামল আমার সাত বছরের ছোট। বাংলাদেশে এখন ক্লাস সেভেনে পড়বার কথা। এখানে ওর স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল কিছুতেই সেভেনে ভর্তি করতে রাজী নয়। তাঁর মতে নাকি "তৃতীয় বিশ্বের" দেশগুলিতে শিক্ষার মান এত পিছিয়ে যে, এখানে এখন ক্লাস সেভেনে পড়াশোনা শ্যামলের জন্য ভয়াবহ এক মানসিক চাপের সৃষ্টি করবে; এতে করে নাকি শ্যামলের সুকুমার বৃত্তিগুলো সুস্থ স্বচ্ছন্দগতিতে বিকশিত হতে পারবে না। অতএব, এখন সে ক্লাস সিক্সের ছাত্র। আমি এক ফাঁকে শ্যামলের সিলেবাস ও বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখলুম -- হ্যাঁ, সুকুমার বৃত্তিই বটে, ঐসব ক্লাস ফোরের স্ট্যান্ডার্ডের অংকগুলো কষতে থাকলে শ্যামলের যে সহজাত গণিতপ্রতিভা ছিল, তা' লুপ্ত হতে বেশীদিন লাগবার কথা নয়।
অস্ট্রেলিয়ায় আসবার আগে দেশে শেষের কটি দিন যে কি' ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। প্রতিদিন শপিং-য়ে দৌড়াদৌড়ি। নভেম্বারের পঁচিশ তারিখে ফ্লাইট। মণিখালা একবার চিঠিতে লিখেছিল, মেলবোর্নে না কি' প্রচন্ড শীত পড়ে। নিউমার্কেট ছুটলাম - প্রায় দু'হাজার টাকার মত খরচ হয়ে গেল শুধু আমার স্যোয়েটারের জন্যই। মা, বাবার জন্য কেনা প্যান্টের কাপড় দিয়ে গাওছিয়া থেকে আমার জন্য মোটা মোটা সব সালোয়ার বানিয়ে নিয়ে এলেন। এখন ভাবতে গেলেই হাসি পেয়ে যায়, 'সাত সমুদ্র তেরো নদী' পাড়ি দেবার চাপা উত্তেজনায় বেমালুম ভুলে গিয়েছিলুম যে, দক্ষিণ গোলার্ধের যে কোন দেশে এখন গ্রীষ্মকাল। আমার ভূগোল টীচার জানতে পারলে কি' বকাটাই না খেতে হত!
ফ্লাইটের সাতদিন আগে থেকেই কারো চোখে ঘুম নেই। বাবা প্রতিদিন অফিস সেরে বিষন্নমুখে ঘরে ফেরেন। কেনাকাটার ব্যস্ততায় মা'র নিঃশ্বাস নেবার অবসরটুকুও মেলে না। শ্যামল প্রতিদিন টি.ভি. খুলে ইংলিশ সিরিয়্যালগুলো চলবার সময়ে টি.ভি.র পাশে কান লাগিয়ে বসে থাকে। ইদানীং সে ইংলিশে ছাড়া কথাই বলে না। তার স্ফূর্তি দেখবার মত। মণিখালা চিঠিতে লিখেছেন, মেলবোর্ণে প্রচুর খোলা মাঠ আর পার্ক। ইচ্ছেমত সাইকেল চালাতে পারবে শ্যামল। আর হরেক রকমের খাবারের না কি' শেষ নেই। Porridge, cereal, vegemite কি' না নেই – wheat bix, তা'ও আছে! “Aussie kids” দের পরিচয়ই না কি', যে তারা “wheat bix” kids। শ্যামল কবিতার মত অবিকল গড়গড় করে আবৃত্তি করে যাবে মণিখালার চিঠি। তার দৌলতে আমাদের সকলেরই চিঠিটা মুখস্থ হয়ে গেল। Christmas-এর সময়ে city-এর skyscrapers গুলো না কি অপূর্ব মনোরম হয়ে ওঠে। শ্যামল মেলবোর্নের সুউচ্চ দালানগুলো (ওর ভাষায় "প্রাসাদ") দেখবার জন্য আমাদের প্রায় অতিষ্ট করে তুলল। আমি চুপচাপ বসে থাকি, আর অয়নের প্রতীক্ষায় দিন গুনি। ও এখন দিল্লীতে, ভার্সিটি খোলা ওর। হুট করে ফ্লাইটের তারিখ ঠিক করে ফেল্লেন বাবা। মাত্র সাতদিনের মধ্যে। এখন কিভাবে যে খবর পাঠাই! সংকোচে কখনও ওর দিল্লীর ঠিকানা চাইতে পারিনি, সেও কখনও মুখ ফুটে বলেনি। কত আত্মীয়-স্বজন দেখা করতে আসলেন; আমার সব বান্ধবীরা একযোগে দেখা করতে আসল একদিন, কিন্তু অয়নের দেখা নেই। ও কি কারো কাছ থেকেই কোন খবর পায়নি? বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
বান্ধবীরা সকলে যেদিন এলো, সেদিন একটু শান্তি ও স্বস্তি পেলুম মনে। রাকা, লিপি, নাহিদা, মুনিয়া, তাসনীম, সুবর্ণা সকলেই এসেছে - শুধু সাব্রিনাটা আসতে পারেনি। লিপি ড্রয়িংরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল, "আমাদের আন্মনার তো ফেভারিট কালার নীল -- নীল সমুদ্রে ঘেরা স্বপ্নময় দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবি, দেখিস্, আবার যেন ডুবে ডুবে নীলনয়নের অবাক জলপান না শুরু করিস্।" সবাই সমস্বরে হেসে উঠল। দেখলাম সকলেই আমার জন্য স্যুভেনিয়ার নিয়ে এসেছে। মুনিয়া তার দেওয়া উপহারের প্যাকেট খুলতে লাগল। দেখলুম এক জোড়া রাবার ব্যান্ড - তা'তে প্লাস্টিকের নীল অপরাজিতা আঠা দিয়ে সাঁটা। "নীলনয়নের ভাবীবধূর জন্যে কেনা", আবার হাসির উতরোল। ভালভাবে জমে উঠল আড্ডা। "এই আন্মনা, বিদেশে গিয়ে তুই কি' আমাদের ভুলে যাবি?" রাকা হঠাত্ প্রশ্ন করে উঠল। "তোদের ভুলে গেলে তো নিজের জীবনের বড় একটা অংশকেই ভুলে যেতে হয় - তা কি সম্ভব বল্!" "নারে, তুই অনেক বদলে যাবি, আমি জানি, সকলেই তো বদলে যায় - আর তুই তো দু'বছরের মধ্যেই সিটিজেনশীপ পেয়ে “Pure Australian”-এ' পরিণত হয়ে যাবি; তা'ছাড়া নীলনয়নের জলপান করলে তো কথাই নেই - কি বলিস্ তোরা?" ওদের সাথে আমিও হাসিতে যোগ দিলাম। তাস্নীম আরও এক কাঠি সরেস, "দু'দশ বছর পরপর কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশে একবারটি বেড়িয়ে যাস্ ভাই!" হাসি-কৌতুকের এই উত্সবে যোগ দিলেও মনের কোথায় যেন একটা অদৃশ্য কাঁটা বিঁধে রইল। অতঃপর পঁচিশ তারিখের কাক-ডাকা ভোরে তল্পিতল্পা ও স্যোয়েটারের বান্ডিলসহ বাবা, মা, শ্যামল আর আমি "উলের-দেশ" অস্ট্রেলিয়ার পথে যাত্রা শুরু করলাম।
-- চলবে --
**মুখবন্ধ: ইচ্ছে করেই মুখবন্ধটুকু নীচে সংযোজিত করা হল। 'বাদুড়' ১৯৯২ তে লেখা হয়েছিল এবং মেলবোর্ণের স্থানীয় একটা বাংলা পত্রিকায় (নাম মনে না থাকায় আন্তরিক ভাবে লজ্জিত) একই সালে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে কখন যে ইয়ারা (Yarra River) নদীতে জল গড়িয়ে গেছে প্রায় কুড়ি বছর, টেরই পাইনি একদম। কুড়িটা বছর! এর মধ্যে পৃথিবী তার অক্ষপথে ঘুরেছে সাত সহস্র বার। পৃথিবী ঘুরেছে, পৃথিবী বদলেছে। বদলেছি আমি নিজে। কুড়ি বছরের পথ পরিক্রমায় অসংখ্যবার জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আবর্তিত হয়েছি 'আমি'। তাই, ১৯৯২ -এর 'আমি'-র সম্মানার্থে হুবুহু একইভাবে লেখাটাকে upload করলাম সামুতে, যদিও ২০১১ এর 'আমি' চাইছিল লেখাটার কিছু কিছু অংশে কাঁচি চালনা করতে। এই যেমন:- "করলুম", "খেলুম" শব্দগুলো (এখন হাস্যকর শোনাচ্ছে), কিংবা টাকার হিসেবগুলো। কিন্তু প্রত্যেকটা লেখকেরই বাক্-স্বাধীনতা আছে। তাই, ২০১১ -এর 'আমি'-র কোন অধিকার নেই ১৯৯২ -এর 'আমি'র লেখায় কাঁচি চালাবার। সম্মানিত পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম মন্তব্যের ভারটুকু।