"তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি মরে গিয়ে আবার বেঁচে ফিরে এসেছেন?"
"জী না, ব্যপারটা ঠিক তা নয়। আমি বলতে চাচ্ছি, আমি মরে গিয়ে ফিরে এসেছি ঠিকই কিন্তু বেচেঁ নয়, ভুত হয়ে!!”
“ও আচ্ছা”
“বিশ্বাস করছেন না বুঝি?”
“জী বিশ্বাস করেছি, আপনি এখন আসতে পারেন”
“জী আচ্ছা”
বলে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বারান্দা দিয়ে ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা কাকরাইল মোড়ের পাশেই অবস্থিত রাজমনি সিনেমা হলের ইয়া বড় পোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছি। নায়ক সকিব খান নায়িকা অফু বিশ্বাসের মেদ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন দেখে আফসোস হল। যেখানে বিশ্ব চলচ্চিত্র পইপই করে তাদের ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে সেখানে এখোনো এদেশের নায়ক নায়কাদের দিয়ে ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিকের তালে তালে ফুল বাগানে লাফ ঝাপ করানো হয়। কিভাবে তারা এগুলো পারে তা আমার বোধগম্য নয় বা এই মূহুর্থে তা বোঝার চেষ্টাও করছিনা, কারণ রাত তিনটার সময় নিজেকে ভুত বলে দাবী করা এই ছেলেটি আমার বারান্দায় আসলো কিভাবে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি অনেক্ষণ ধরে।
আমার আবার রাত বিরাতে কফি খাওয়ার বাতিক আছে। তাও আবার সব দিন খাইনা, যেদিন একটু বেশি পরিমাণে মদ্যপান করে বাসায় ফিরি সেদিনই কফি খেয়ে নেশা টাকে একটু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। নাপা এক্সট্রা বা এইচ প্লাস এ আছে ৫০০ মিলিগ্রাম প্যারাসিটামল এবং ৬৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন, যেখানে প্যারাসিটামল শরীরের তাপমাত্রা কমায় আর ক্যাফেইন শরীরের ব্যথা, দূর্বলতা ও ক্লান্তিভাব দুর করে সতেজতা আনার চেষ্টা করে। আর কফি থেকেই তৈরী হয় ক্যাফেইন, সুতরাং এক মগ কফিতে বিপুল পরিমাণ ক্যাফেইন পাওয়া যায়, ফলে নেশা বা টালটাল ভাবটা দ্রুত কাটে বলেই আমার ধারণা।
আমি ভুত সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বারান্দা থেকে হাক পাড়লাম -
“ভুত সাহেব, আপনি কি আছেন নাকি চলে গেছেন?”
ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করা জরুরি, সে কিভাবে এত এত সিকিউরিটি ভেঙে ১৭ তলা বিশিষ্ট এই ফ্লাটের বারান্দায় এসে বসে ছিল!! তাও আবার যে ফ্লাটের মালিক স্বয়ং আমি নিজে এবং যার চাবি একমাত্র আমার কাছেই থাকে।
কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলনা, ডাকার প্রায় সাথে সাথেই সে বারান্দায় এসে হাজির হল! যেন আমার ডাকের অপেক্ষায় সে দাড়িয়ে ছিল দরজার ওপাশে।
“আমায় ডেকেছেন স্যার?”
“তাইতো মনে হয়! এখানে আমার পাশে এসে বসুন”
“স্যার আমি আপনার বয়সে অনেক ছোট, আমাকে তুমি করে বলবেন প্লিজ”
“ভুতের আবার ছোট বড় আছে নাকি? তাদের মৃত্যু হবার সাথে সাথে তাদের বয়সও থেমে যাওয়ার কথা। আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার নামটা যেন কি?”
“রজত”
“হুম … কতদিন হল তুমি মারা গেছ?”
“তা তো স্যার মনে নেই!! মরার পর বোধহয় সময় জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে স্থান, চরিত্র আর স্মৃতি গুলো ঠিক থাকে। যেমন কোথায় এবং কিভাবে মরেছিলাম তা বলতে পারবো”
“ঠিক আছে তাই নাহয় বল”
“মহাখালী রেল ক্রসিংয়ে সোজা মাথা দিয়ে শুয়ে পরলাম, আর মরে ভুত হয়ে গেলাম। পুরো প্রক্রিয়া ঘটতে পাঁচ সেকেন্ডের মত লেগেছিল।”
স্ট্রেন্জ!!! ছেলেটা আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য সব ধরনের উপায় অবলম্বন করছে। এ ধরনের কর্ম সাধনে যে ধরনের চিকন বুদ্ধি আর সাহসের প্রয়োজন হয় তা এই রজতের ভিতরে বিদ্যমান। আমার ধারণা প্রথমে আমি যখন বার থেকে মদ খেয়ে ফিরছিলাম তখন সে টুক করে আমার গাড়ির পেছনের ডালায় উঠে বসে। তারপর আমার সাথে আমার বাড়ি পর্যন্ত আসে এবং খুব সাবধানে আমার পিছন পিছন লিফ্টে ওঠে ও আমার ঘরে প্রবেশ করে। যেহেতু আমি একা মানুষ এবং মাঝে মধ্যেই আমার কোন না কোন বন্ধু বান্ধব থাকতে আসে আমার সাথে, তাই সিকিউরিটি গার্ড বিষয়টাকে পাত্তাই দেয়নি। আর এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে আমি অত্যন্ত ড্রাংক্ড থাকার কারনেই। যাক, কফিতে কাজ করছে এবং নেশার তার কাটতে শুরু করেছে ভেবে মনে মনে মিটমিট করে হাসলাম রহস্য ভেদ করতে পারার আনন্দ নিয়ে। এবং সরু চোখে ছেলেটার দিকে তাকালাম। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে এবং বুক ওঠানামা করছে। পৃথিবীর কোন ভুতেরই নিশ্চয়ই অক্সিজেন নেয়ার প্রয়োজন হয়না। অক্সিজেন লাগে কেবল রক্ত মাংসের মানুষের। সুতরাং তার ওই ভুত ভুত খেলা বাদ। যদি ভুত ভুত খেলা বাদ দিতে হয় তবে আসল খেলা কি? তার মোটিভ কি? আমাকে খুন করে আমার টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়া? দেখা যাক কি হয়। আমি বললাম -
“মরার সময় তোমার কেমন লেগেছিল রজত?”
“কিছুই লাগেনি স্যার। মাছের পিত্তি চটকে খেলে যেমন তিতা লাগে তেমনি ট্রেনের চাকা গলার উপর দিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই কেমন যেন একটা তিতা তিতা স্বাদ লাগছিল আর সব কিছু সাদা দেখছিলাম।”
“তার মানে আমরা বলতে পারি মৃত্যুর স্বাদ তিতা আর মৃত্যুর রং সাদা তাইতো?”
“হ্যাঁ স্যার … তা বলতে পারি। আমি নিজে সাক্ষী।”
“তিতা” আর “সাদা” এই শব্দ দুইটা থেকে কি কোন অর্থ বের হয়? যেমন দুইটা শব্দের প্রথম দুই অক্ষর নিলে দাড়ায় “তিসা”। তিসা নামের কোন মেয়ে কি আছে, যার সাথে রজত নামের এই ছেলের কোন সম্পর্ক আছে? আমি বললাম -
“তিসা নামের কোন মেয়ের জন্যই কি আত্মহত্যা করেছিলে?”
রজতের চোখে মুখে আনন্দ খেলে গেল, আমার প্রতি তার সম্মান আগের চেয়েও দিগুন হয়ে গেল এবং বিনিত ভঙ্গিতে সে বলল -
“সত্যি স্যার আপনার কোন জবাব নেই। কি অসাধারণ বুদ্ধি আপনার।”
মনে হচ্ছে এটাও তার ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশ। আমি যাই বলিনা কেন আমাকে ইম্প্রেস করার জন্য তালে তাল মেলানো। তিসা নামটার জায়গায় আমি যদি “নিসা” বলতাম তবেও সে একই কথা বলত। এমনকি আমি যদি বলতাম “গাব্বার সিং কি তোমার শশুর ছিলেন?” তবে সে এই একই ভঙ্গিতে বিনিত স্বরে বলত “লা জবাব স্যার। আপনার মত জ্ঞানী মানুষ আমি আমার জীবনেও দেখিনি, ওই গাব্বার সিংয়ের কন্যা তিসার জন্যই তো আত্মহত্যাটা করেছিলাম”। এবার একটা পরীক্ষা করা যেতে পারে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম -
“তিসা নামের মেয়েটার বাবার নাম কি?”
“ওর বাবার নাম গাব্বার আলী। কিন্তু আমার বন্ধুরা ক্ষেপিয়ে ডাকত গাব্বার সিং”
এবার একটু বিব্রত না হয়ে পারলাম না। যুক্তি তর্ক দিয়ে যে সব সময় বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়না এটা তারই একটা প্রমাণ। এটাকে আমি কোন ভাবেই কাকতালীয় ঘটনা বলতে নারাজ।
আমি রজত কে বারান্দায় বসতে বলে আরেক কাপ কফি বানাতে গেলাম। কিন্তু তার আগে একবার ইন্টারকমে সিকিউরিটি গার্ডকে টেলিফোন করার দরকার -
“আসসালামু আলাইকুম স্যার”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, আমি 17-C থেকে ফয়সাল বলছি।”
“জী স্যার, বলুন।”
“আচ্ছা, আমি যখন লিফ্টে উঠলাম তখন কি আমার সাথে আর কেউ ছিল?”
“না স্যার, আপনি একাই ছিলেন।”
“আপনি কি নিশ্চিত?”
“জ্বী স্যার, আমি নিশ্চিত”
“তবুও আপনি একটু সিসিটিভি চেক করে বলবেন প্লিজ?”
“জী স্যার অবশ্যই, ৩০ মিনিটের ভিতরেই আপনাকে জানাচ্ছি।”
“ধন্যবাদ”
আমি এক কাপের জায়গায় দুই কাপ কফি নিয়ে ঢুকলাম বারান্দায়। ভুত বাবাজী কফি খায় কিনা সেটাও একটু পরীক্ষা করার দরকার আছে। আমার সন্দেহকে আবারো ভুল প্রমাণ করে দিব্যি কফির কাপটা হাতে নিয়ে সরাৎ সরাৎ শব্দে কফি খেতে খেতে রজত বলল -
“যদি কিছু মনে না করেন, একটা সিগারেট পেতে পারি স্যার? আসলে চা বা কফির সাথে সিগারেটটা জমে ভাল। মনেহয় সিগারেটের ধোঁয়া গুলো কামড়ে কামড়ে খাই।”
আমি একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে, এবং নিজেও একটা ধরালাম। সারাজীবন শুনে এসেছি ভুত প্রেত সিগারেটের আগুন দেখলে পালাবার পথ খুজে পায়না। অথচ আমার সামনে অবস্থিত জনাব রজত আলীর ভুত দিব্যি সিগারেট ফুকে চলেছে।
ঘরিতে রাত ৩ টা বেজে ৪৫ মিনিট। অন্যান্য দিন এতক্ষণে ২য় স্তরের ঘুম কমপ্লিট হয়ে যাবার কথা। কিন্তু রজতের ভুত আমাকে রীতিমতো সম্মোহিত করে রেখেছে। এখোনো পর্যন্ত তার উদ্যেশ্য অনুমান করতে পারছি না। কি হতে পারে...
“স্যার, আপনি কি বিশ্বাস করছেন না যে আমি একটা ভুত?”
আমার চিন্তার ভিতরে বাধ সাধলো রজত। আমি বললাম -
“তোমাকে ভুত ভাবার কোন কারণ আছে কি?”
“অবশ্যই নেই, কেননা আমি আপনার সামনে সাধারণ মানুষের ন্যায় অভিনয় করে চলেছি। ফলে আপনি কনফিউশানে ভুগছেন”
“মানে?”
“মানে আপনার যুক্তি বলছে একটা ভুতের কখোনোই শ্বাসপ্রশ্বাস নেবার কথা নয়, অথচ আমি শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছি, এবং যেখানে একটা ভুতের আগুন দেখলে ভয় পাবার কথা সেখানে আমি দিব্যি জ্বলন্ত সিগারেট মুখে নিয়ে বসে আছি”
“আমার অনুমান বা যুক্তি কি ভুল?”
“জ্বী না ভুল না। আমিই আপনার ভিতরে এই অনুমান তৈরী করেছি। আপনার সামনে এই বেশে এসেছি যেন আপনি আমার সাথে সাভাবিক ভাবে কথা বলেন এবং আমাকে সাহায্যে করতে পারেন। কেননা আমার আসল চেহারা সহ্য করার ক্ষমতা নেই আপনার। তবে আপনি চাইলে আমার আসল রূপ দেখাতে পারি। যাইহোক আসল কথায় আসি - আসলে কিন্তু আমার অক্সিজেন এর কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি অক্সিজেন বা শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার ভান করছি যাতে আপনি আমাকে আপনার মতই একজন মানুষ মনে করেন, এবং আগুন দেখে ভয় পাচ্ছিনা কারণ একমাত্র খারাপ ভুতেরাই আগুনে ভয় পায়। আপনাকে জানিয়ে রাখি, মরার আগে আমি ছিলাম খুবই ভাল ও পরউপকারী ছেলে। আর আপনি এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে খারাপ মানুষেরা কখনোই আত্মহত্যা করেনা”
আমি প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করতে করতে বললাম -
“হমম, বুঝলাম। তো এখন বল তিসা কে? কেন তুমি আত্মহত্যা করেছিলে আর আমার কাছেই বা কি সাহায্য চাও?”
“আমি আপনার কাছে কি সাহায্য চাই এটা জানলেই আপনি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন”
“ঠিক আছে শুরু কর”
“তার আগে কি স্যার আরেকটি সিগারেট পেতে পারি?”
“তুমিই না বললে এসব তোমার ভান? আমি যেহেতু জেনেই গেছি সেহেতু আর ভান করে লাভ কি? এমনকি তুমি চাইলে তোমার আসল রূপে আবির্ভূত হতে পার”
“হিহিহি, ঠিক আছে স্যার সিগারেট লাগবেনা। আসলে ধুমপানের সাথে গল্প বলার একটা গভীর সম্পর্ক আছে। মনেহয় যেন গল্পের তাল, লয়, ছন্দ গুলো সব চোখের সামনেই ঘোরাঘুরি করছে, তাদেরকে শুধু ধরে ধরে এক সুতোয় গাঁথতে হবে। যদিও আমি এই রাত দুপুরে আপনার ঘুম নষ্ট করে রূপকথার কোন বানোয়াট গল্প নিয়ে হাজির হইনি”
আমি রজতের দিকে আরেকটা সিগারেট বাড়িয়ে দিতে দিতে বললাম -
“আচ্ছা, আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি সেটা বল”
“আসলে আমার একজন লেখকের সাহায্য প্রয়োজন”
“দেশে এত লেখক থাকতে আমি কেন?”
“কারন আপনি দেশের উদ্বিয়মান নতুন লেখক। আপনি যতটা মন দিয়ে আমার কথা শুনবেন ততটা গুরুত্ব দেবেনা দেশের প্রতিষ্ঠিত লেখকরা। সেজন্যই আপনাকে বেছে নিয়েছি”
“হুম ... এবার বল কিভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি”
“এটাকে সাহায্য বললেও ভুল হবে স্যার, বলুন অনুরোধ। আমার এই অনুরোধটা আপনাকে রাখতেই হবে স্যার”
“আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব, তুমি বল”
“অনুরোধ টা পরে বলব, আগে আমার জীবনের সংক্ষিপ্ত ঘটনা শুনুন”
আমি চুপ করে রজতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু থেমে সে আবারো শুরু করল -
“গল্পটা আর দশটা গল্পের মতই সাদামাটা, কিন্তু উপলব্ধি টা আলাদা। গল্পের থেকে আমি উপলব্ধিটার দিকেই বেশি ফোকাস করব। যে উপলব্ধিটা আমার মৃত্যুর আগে খুব প্রয়োজন ছিল। আমি চাই আমার মত বোকা মানব সম্প্রদায়ের ভিতরে এই উপলব্ধি ছড়িয়ে দিতে। তারা যেন আমার মত এমন গু খাওয়া কাজ না করে।”
বলে আবার একটু থামল রজত। আমি একই ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে বলতে শুরু করল -
“আমি এসএসসি, এইসএসসি তে জোড়া এ প্লাস প্রাপ্ত ছাত্র ছিলাম। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হওয়ায় কোনদিন কোন কিছুর অভাববোধ করিনি। বাবা মায়ের কাছ থেকে এত বেশি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভালবাসা পেয়েগেছিলাম যে বিনিময়ে বাবা মাকেও যে একটু ভালবাসতে হবে বা ভালবাসা উচিত তা ভুলতেই বসেছিলাম। আসলে ভালবাসা পাওয়ার ভিতরেও বিরক্তি আছে। প্রয়োজনের বেশি কাউকেই ভালবাসতে নেই বা মাত্রার অতিরিক্ত কাউকে অবহেলাও করতে নেই। দুটোই ভয়ঙ্কর জিনিস। আর এই দুই ভয়ঙ্কর জিনিসই সমান ভাবে প্রভাবিত করে আমার জীবনকে। বাবার প্রচুর টাকা ছিল তাই ইচ্ছা করেই দেশের সব থেকে স্বনামধন্য ব্যয়বহুল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। এবং তারপরেই ঘটল যত বিপত্তি। আমার ধারণা দেশের সব সুন্দরীদের হাট হল এই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি গুলো। তিসা নামের মেয়েটার সাথে পরিচয় হল প্রথম দিনেই প্রথম ক্লাসে। তারপর পরিচয় পালা শেষ করে আর দশটা প্রেমিকের মত প্রেম প্রেম ঝড় বয়ে গেল জীবনের উপর দিয়ে। দিন রাত শুধু তিসা আর তিসা… মনে হত আহা জীবন ওহো জীবন … জীবন তুমি কত মধুর। আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে জানি তবুও বলছি, মাত্র ৯ দিনের পরিচয় ও সম্পর্কে ও আমাকে ওর বিছানায় ডাকে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও আমার সামনে ওর ব্রা পরে বসে থাকা দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ও আসলে কি চাইছে। যদিও আমাদের দেশের কিছু সুশীল নারীবাদীরা মনে করেন পোশাক কখনোই সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ নয়। অর্থাৎ তাদের মতে নারীরা ব্রা, পেন্টি পরে ঘুরবে অথচ সেদিকে কুনজরে তাকানো যাবেনা, কেউ কুনজরে তাকালেই হবে তার মনে পাপ। সেদিন বোধহয় ঘনিয়ে এসেছে যেদিন তারা ব্রা হাতে রাস্তায় নামবে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে।
যাইহোক, আমি যেহেতু পুরুষ, এবং রক্ত মাংসের তৈরি, তাই তিসার আবেদনে সারা না দিয়ে পারিনি। বরং একবার নয়, দুইবার নয়, বার বার অসংখ্য বার ওর যেকোন আবেদনে বিনা শর্তে সাক্ষর করেছি…
এবার আসি আসল কথায়, হঠাৎ একদিন তিসার শরীরে অন্য পুরুষের গন্ধ আবিষ্কার করলাম এবং হাতেনাতে তা ধরতেও সক্ষম হলাম। বুকের বাম পাশটাতে খুব ব্যথা করছিল জানেন … মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে এমনিতেই মরে যাব … তাই দম বন্ধের অপেক্ষা না করে সোজা গিয়ে শুয়ে পরলাম রেললাইন কে বালিশ বানিয়ে … এ যন্ত্রণার থেকে মুক্তির আর কোন পথ ছিলনা আমার সামনে … ব্যস...সব শেষ হয়ে গেল ...
কিন্তু মজার ব্যপার কি জানেন, মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরে যখন আবিষ্কার করলাম যে আমি মারা গেছি তখন বুঝলাম কতবড় ভুল আমি করেছি … আসলে তিসার কাছ থেকে পাওয়া ওই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির হাজারো পথ আমার সামনে খোলা ছিল … কিন্তু ফালতু প্রেমে এতটাই মশগুল হয়ে গেছিলাম যে সেসব পথ খোজার কথা একবারও ভেবে দেখিনি। আরো মজার ব্যপার কি জানেন, ভুত হবার পর আমি জানতে পেরেছি এখন শুধু ছেলেরাই নয় বরং মেয়েরাও নতুন নতুন পুংলিঙ্গের পিছনে ছোটে নতুন স্বাদের সন্ধানে, আর আমি সেরকমই এক মেয়ের পাল্লায় পরেছিলাম এবং বৃথাই মহামূল্য এই জীবন নষ্ট করলাম”
বলে একটা দীর্ঘশ্বাসের মত করে থামল রজত। আমি একটু বললাম -
“আমি কিন্তু এখোনো বুঝতে পারছিনা আমার প্রতি তোমার অনুরোধটা কি”
“জ্বী স্যার, এবার সেই প্রসঙ্গেই বলব। আমি চাই আপনি এমন একটি বই লিখুন যেখানে এই প্রেম প্রেম খেলা নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ থাকবে। যেমন, প্রেমে পরলে মানুষ কিভাবে অন্ধ হয়ে যায়, কোনটা সঠিক প্রেম কোনটা শুধুই আবেগ, কোন ধরনের প্রেমের পরিনতি কি হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। সব থেকে বড় কথা দুই দিনের প্রেমের থেকেও যে বেশি মূল্যবান আমাদের বাবা মায়ের ভালবাসা, তা যুক্তিসহ প্রমাণ করতে হবে আপনাকে। এমন ভাবে তরুণ তরুণীদের সহ তাদের বাবা মায়ের মগজ ধোলাই করবেন যেন আমার মত ভুল করার পর কেউ অন্তত আর আফসোস না করে।”
রজত বোধহয় ফুল স্টপ দিয়ে থামল। যাক অবশেষে ভুত সাহেবের উদ্দেশ্য জানতে পারলাম বটে কিন্তু তা বিশ্বাস করাটা কতটুকু যৌক্তিক হবে ভেবে পাচ্ছিনা। কারণ সে যে একটা ভুত আমি এখন অব্দি সেটাই বিশ্বাস করতে পারিনি। সে এমন একটা গল্প ফেঁদেছে যেন আমি তার প্রতি দয়াশীল হই এবং তাকে বিশ্বাস করে একটা সময় ঘুমিয়ে পরলেই শুরু হবে তার ডাকাতি। এগুলো তো এখন ঢাকা শহরে হর হামেশাই হচ্ছে। যাক ওসব ভেবে কাজ নেই। ছেলেটার কাছ থেকে একটা চমকপ্রদ গল্প আশা করেছিলাম যে প্লটে লিখলে পাবলিক প্রচুর খাবে। কিন্তু এই প্রেম এর বিপক্ষে কিছু লিখলে আমাকে পথে বসতে হবে। প্রেমিক প্রেমিকারা কখনোই প্রেমের বিষদগার শুনতে রাজি নয়। আর দেশের নারীবাদীরা! তাদের কথা তো বাদই দিলাম, তারা তো আমাকে নেংটি ইদুরের মত বাশ বাগানে ঝুলিয়ে মারবে। যদিও আমি কখনোই নারীবিদ্ধেষী নই। সত্যি কথা বলতে, প্রেম ছিল, আছে, থাকবে। প্রেমে প্রতারণা ছিল, আছে, থাকবে। প্রেম থেকে ৯৯ শতাংশ মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করেনি, করছেনা বা ভবিষ্যতেও করবেনা। প্রেমের জন্য বলদ সম্প্রদায় অতীতেও জীবন দিয়েছে, বর্তমানেও দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে। প্রেমের শুরু গোলাপ ফুল দিয়ে হলেও এর শেষটা রচিত হয় নর্দমায় পরে থাকা কনডমের ভিতরে নাহয় ডাস্টবিনের কোন খোলা বাক্সে। আর এতেই অভ্যস্ত তারা। এ বিষয়ে একটা কেন, হাজারটা বই লিখে বা গুলিয়ে খাওয়ালেও কোন ফল আসবেনা সে ব্যপারে আমি নিশ্চিত। এটুকু ভবিষ্যতবানী যদি নাই করতে পারলাম তবে আর নিজেকে লেখক বলে দাবি করছি কেন!!!
রজত উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল -
“আজ তাহলে উঠি স্যার”
আমিও উঠে দাড়ালাম। এবং তাকে বিদায় জানানোর জন্য হ্যান্ডসেক করতে গেলাম আর তখনই ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। যেটা আমার জীবনের সব থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হ্যান্ডসেক করতে গিয়ে হঠাৎ রজতের মাথাটা খুলে পরে গেল মাটিতে!! এবং ফুটবলের মত গড়াতে গড়াতে বারান্দার কোনায় গোলাপ ফুলের টপের সাথে গিয়ে বারি খেল। দেখলাম রজত তার দুই হাত দিয়ে মাথা খুজতে থাকল। কিন্তু মাথার জায়গায় তো মাথা নেই!! তাই অন্ধের মত এদিক সেদিক হাতরাতে থাকল। এমন সময় ফুল গাছটার গোড়া থেকে রজতের মাথাটা বলে উঠল -
"স্যার, একটু সাহায্য করবেন? আমার মাথাটা আমার হাতে পৌঁছে দিবেন প্লিজ"
কথাটা সে এতটাই অসহায়ের মত বলল যে আমার খুব মায়া হল বেচারির প্রতি। আমি ছুটে গিয়ে তার মাথা তার হাতে পৌঁছে দিলাম। সে তার মাথাটা আবারো জায়গা মত সেট করতে করতে বলল -
"এইটা খুবই বিরক্তিকর একটা ব্যপার। ট্রেনে কাটা পরাতে গলাটা খুব ঢিলে হয়ে গেছে স্যার!! তাই যখন তখন যেখানে সেখানে এভাবে মাটিতে খুলে পরে।"
আমি একটু ভেবে বললাম -
"আমার ধারণা তুমি ইচ্ছা করেই মাথাটা খুলে ফেলেছ যেন যাবার আগে শেষ বারের মত আমাকে এটা বিশ্বাস করাতে পার যে তুমি আসলেই ভুত"
রজত হিহিহি করে হেসে দিল -
"আপনার অনেক বুদ্ধি স্যার। সেজন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। আজ তাহলে যাই স্যার"
বলে ফস করে আমার চোখের সামনেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল রজত। এবং সাথে সাথেই বেজে উঠল টেলিফোনটা -
"হ্যালো"
"আসসালামু আলাইকুম স্যার"
"ওয়ালাইকুম আসসালাম"
"স্যার আমি সিকিউরিটি গার্ড বলছি"
"জ্বী বলুন"
"স্যার, আমি এতক্ষণ সবগুলো সিসিটিভি চেক করলাম, কিন্তু কোথাও আপনাকে দেখতে পেলাম না। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে রাত তিনটার দিকে ২ মিনিট ৪ সেকেন্ড এর জন্য সবগুলো সিসিটিভি অকার্যকর হয়ে ছিল। আমার ধারণা ওই সময়েই আপনি ঢুকেছিলেন তাই আপনার কোন ডেটা সিসিটিভিতে নেই"
"ও আচ্ছা ঠিক আছে, ধন্যবাদ আপনাকে"
বলে রেখে দিলাম রিসিভারটা। প্রচুর ঘুম আসছে। মদ্যপান করতে করতে লিভার কিডনির কি অবস্থা তা তো জানিনা!! মরার আগে অন্তত একটা বই বের করতে চাই। তাই ঘুম ঘুম চোখেই একটা নতুন ডায়েরী বের করলাম আলমারি থেকে, যার উপরে নীল রঙের মার্কার কলম দিয়ে মোটা মোটা অক্ষরে লিখলাম -
"রজতের উপলব্ধি"
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৪১