আঙ্গুল গুনে ৭ বছর ৩ মাস পর খুব অনাকাঙ্খিত ভাবেই আকিলের সাথে দেখা হয়ে গেল জেনিয়ার। এই ৭ বছর ৩ মাস ধরে বিধাতার কাছে আকিল শুধু একটাই প্রার্থনা করেছে - যেন আর কোনদিনও জেনিয়ার সাথে তার দেখা না হয়। কিন্তু স্রষ্টা যে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে খুব মজা পায়। নাহলে কি আর তেলের সাথে জল মেশানোর মত করে জেনিয়ার সাথে তার পরিচয় ঘটতো! আর সেই ঠাট্টা মশকরার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেই যেন আজকের এই হঠাৎ দেখা।
প্রায় চার বছরের টানা প্রেমের ইতি টেনে জেনিয়া তার টানটান চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বিদায় নিয়েছিল আকিলের জীবন থেকে। অপরাধ ছিল একটাই - “বেকারত্ব”। শুধুমাত্র বেকারত্বের দোহাই দিয়ে চলে যাওয়া কোন প্রেমিকাকে দোষ দিতে রাজি নয় আকিল। পাশাপাশি প্রতারণা গোছের কিছু একটার মিশ্রন ব্যপক ভাবে কাঁদিয়ে ছিল তাকে। অর্থাৎ আকিল বাদেও জেনিয়ার আরেকটি বিকল্প ছিল। জেনিয়ার মত মেয়েরা ডিফেন্স খেলতে পছন্দ করে। কোন ভাবেই ঝুঁকি নিতে নারাজ। আপন স্বার্থের প্রশ্ন যখন, তখন এক চুল ছাড় দিতে রাজি নয় তারা। যা বুঝতে অনেক বেশিই সময় লেগে গিয়েছিল আকিলের। ততক্ষণে সে তার হৃদ মাঝারের রক্তকনা বিসর্জন করে বসে ছিল। জীবনের সবটুকু ভালবাসা যেন মুঠো বন্দী করে সপে দিয়েছিল জেনিয়ার পায়ের তলে। কিন্তু জেনিয়া যে শুধু ভালবাসায় তুষ্ট নয়। তার চাই রাজপুত্র সহ রাজ মহল। আকিল রাজপুত্রের মত দেখতে হলেও রাজ প্রাসাদের কোন হদিস ছিলনা। তবে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল আকিল। তাই চার বছর তার পিছনে পরে থেকে রাজ ঠিকানার কোন নিশানা না পেয়ে ঝুলে পরলো তার বিকল্পের গলায়। এক সাথে দুই নৌকায় পা দেয়া যাকে বলে। যে নৌকা আগে তীরে ভিড়বে জেনিয়া তার! আর জেনিয়ার মত সুন্দরীদের মাঝিরও আকাল হয়না কখনো।
আকিলের প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম ছিল শাকিল। জেনিয়ার চাচাতো ভাই। ছোটবেলার ‘পলান টুকটুক’ খেলতে খেলতেই নাকি জেনিয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল সে। কিন্তু জেনিয়া সে কথা গোপণ রেখে কেন আকিলের সাথেই পলান টুকটুক খেললো তার উত্তর আজো পায়নি আকিল।
এসব স্মৃতি যখন আকিলের মনকে ব্যথিত করে তুলেছে তখন সে চিৎকার না দিয়ে বরং গুলশানের একটা অভিজাত রেষ্টুরেন্টের স্মোকিং জোনে বসে বসে সিগারেটে ফুৎকার দেয়াই ব্যস্ত হল। আর ঠিক সেই সময়ই ছোটবোন মুনিয়ার সাথে জেনিয়াও ঢুকলো ওই জোনে। আকিলের সাথে একটু দেখা করার জন্য শুধু স্মোকিং জোন কেন, রীতিমতো স্মোক করতেও প্রস্তুত মুনিয়া। তাও আবার মাত্র ১৫ দিনের ফেইসবুক পরিচয়ে। আর এই ১৫ দিনের অব্যর্থ চেষ্টার ফসল সরূপ আকিলের সাথে দেখা করার শিডিউল পেয়েছে মুনিয়া। শুধু মুনিয়া নয়, আজ আকিলের সাথে একটু কথা বলতে বা ওর ফ্রেন্ড লিস্টে জায়গা পেতে মরিয়া হাজারো মুনিয়া। কিন্তু তাই বলে খোদ জেনিয়ার আপন ছোটবোন!! এবার নিয়তি কার সাথে মশকরা করতে চায় সেটাই দেখার বিষয়! তবে তার আগে মুনিয়া এবং আকিলের পরিচয়টা পরিষ্কার করা জরুরি।
“Vaya, apnak request diyaci, text diyaci onek din holo … plz accept me and reply plz plz plz.”
হঠাৎ পাবলিক পোষ্টে এহেন কমেন্ট দেখে ইনবক্স চেক করে আকিল। সেখানে একটা দীর্ঘ সিরিয়ালের পরে খুজে পায় মুনিয়া নামের মেয়েটির টেক্সট। লেখা আছে- “হ্যালো ভাইয়া”। আকিল তার মেসেজ রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে এবং রিপ্লে দেয় -
“জী বলুন”
সাথে সাথেই তাকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে মুনিয়ার রিপ্লে আসে। যেন আকিলের টেক্সটের অপেক্ষায় বসে ছিল মুনিয়া।
“Thank you so much”
“For what?”
“এই যে আপনি আমাকে রিপ্লে করলেন।”
“বুঝলাম। কিন্তু আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি সেটা বলুন”
“অনেক ভাবে সাহায্য করতে পারেন”
“মানে?”
“মানে কিছুনা। হিহিহি”
“দেখুন আমি হেয়ালি পছন্দ করিনা”
“আচ্ছা আপনি কি আমার প্রোফাইলের ছবিটা দেখেন নি?”
“কেন?”
“এরকম সুন্দরী মেয়ের হেয়ালি দেখার জন্য কত ছেলে উন্মুখ হয়ে থাকে। আর আপনি বলছেন আপনার ভাল লাগছে না?”
“আমার আসলেই সে সবের সময় নেই। আপনি কি বলতে চান সময় নষ্ট না করে বলে ফেলুন”
“জী জানি”
“কি জানেন?”
“এই যে, আপনার সময় নেই। থাকবেই বা কি করে! আপনি ম্যাজিস্ট্রেট মানুষ, বিচার আচার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।”
“দেখুন, আমার পেশার দিকে কুনজর দিবেন না। কঠোর পরিশ্রম করে বিসিএস ক্যাডার হয়েছি।”
“ছিছি কুনজর কেন দিব!! আপনার যোগ্যতা বলেই আপনি আপনার সফলতা পেয়েছেন। আপনার মত গুনি মানুষের সময় নষ্ট করতে পেরে বরং নিজেকে ধন্য মনে করছি”
“ও আচ্ছা, আর যদি আমি বেকার রাস্তার ফকির হতাম তবে?”
“(চুপ)”
“তবে নিজেকে ধন্য মনে করতেন না বুঝি?”
“(চুপ)”
“ধন্য মনে করা তো দুরের কথা, এভাবে টেক্সটের রিপ্লে দেবার জন্য পাবলিক প্লেসে ‘প্লিজ প্লিজ প্লিজ’ বলে চিল্লাতেন না তাইনা?”
“আপনি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছেন! আমি কিন্তু এবার কেঁদে দিব”
“ভুল না সঠিক টাই বুঝেছি। আর কাঁদতে চাইলে কাঁদতে পারেন। কোন সমস্যা নেই”
“আপনি কি রেগে যাচ্ছেন?”
“জী না।”
“তাহলে একটু হাসুন”
“হাহাহা”
“থ্যাংক ইউ”
“কেন হাসলাম জানেন?”
“কেন?”
“আপনাদের স্বার্থপরতা দেখে হাসলাম। স্বার্থের জন্য সব পারেন আপনারা। ভালবাসা বলে কিচ্ছু নেই আপনাদের ভিতরে। দূরঅবস্থার সময় ছুড়ে ফেলতেও বাধেনা। আবার সুসময়ে তোষামোদ করতেও ওস্তাদ।”
পরক্ষণেই আকিলের মনে হল, কি বলছি এসব! কোথাকার কোন মেয়ে, তাকে এসব বলে কি লাভ। তবুও যে মুখ ফেটে বের হয়ে আসে। কোন মেয়ের তোষামোদ তার একদম সহ্য হয়না। এসব তোষামোদ, তোয়াজ তার কাছে কৃত্রিম মনে হয়। মনেহয় তাকে কেও তোষামোদ করছেনা, করছে তার পদবী কে। আজ যদি তার পদবী চলে যায়, ওমনি মুনিয়ারাও ফুরুত করে উরাল দেবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবুও সে প্রশ্রয় দিল মুনিয়াকে। রক্ত মাংসের মানুষ তো। কাউকে না কাউকে তো প্রশ্রয় দিতেই হবে। কোন এক প্রতারক জেনিয়ার স্মৃতি বুকে চেপে সারাজীবন দেবদাস হয়ে বসে থাকার তো কোন মানে হয়না। এদেরকে অবশ্য প্রতারক না বলে সুবিধাবাদী বললেও চলে।
…
“বসতে পারি?”
পেছন থেকে বলে উঠলো মুনিয়া। চেয়ারটা ঘুরিয়ে সামনে ফিরতেই ধাক্কা খেল আকিল। তার থেকেও বড় ধাক্কা খেল মুনিয়ার পাশে দাড়িয়ে থাকা জেনিয়া। চেয়ারে বসতে বসতে মুনিয়া তার বোনের সাথে আকিলের পরিচয় করিয়ে দিল -
“আমার বড় বোন। ওকে আপনার কথা অনেক বলেছি। তাই ও নিজেই চলে এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে”
“নাইচ টু মিট ইউ”
খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে ফেলল আকিল। জেনিয়া একটা শব্দও করলনা মুখ দিয়ে। আস্তে করে বসে পরল বোনের পাশে।
“কি খাবেন বলুন?”
বলল আকিল।
“আপনাকে দেখেই পেট ভরে গেছে”
বলে খিলখিলিয়ে হেসে দিল মুনিয়া। আড় চোখে মাঝে মাঝে আকিলের দিকে তাকাচ্ছে জেনিয়া। আকিল বলল -
“হাহা তাই বুঝি! চোখে দেখেই যদি পেটের খিদে মিটত তবে বাঘ আর হরিণ এক সাথেই বসবাস করত। যাইহোক, দেখা করার জন্য এত এত অনুরোধ করলেন, এখন বলুন কি বলতে চান”
“কিছু বলতে চাইনা। আপনার মত মহান মানুষের দেখা পেলাম এতেই খুশি”
“বাহ!! মাত্র ১৫ দিনেই মহান হয়ে গেলাম? অথচ ১৫ যুগেও কেউ কেউ মহান হতে পারেনা।”
“যে মহান তাকে এক দিনেই মহান বলা যায়, বুঝলেন”
“ঠিক আছে, তবে বলুন দেখি, আমার ভিতরে কি এমন মহানুভবতা পেলেন?”
“বলব, তবে আজ না। হিহিহি”
আর সহ্য হলনা আকিলের। এসব নাটকীয় আদিক্ষেতা প্রচন্ড বিরক্ত লাগে তার। তবে তার মনে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে … প্রতিশোধের আগুন। ওসব কৃত্রিমতার পথ না মাড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল আকিল। এবার যেন ভাগ্যের সাথেই মশকরা করল সে। মুনিয়ার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলল -
“বিয়ে করবেন আমাকে? তিন দিনের ভিতরে আপনার পরিবার কে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে বলবেন।”
বলে চোখে সানগ্লাসটা পরে গটগট করে হাটতে হাটতে বেরিয়ে গেল আকিল। মুনিয়া যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। হা করে তাকিয়ে থাকল আকিলের চলে যাওয়ার পথে। চোখ বেয়ে তার আনন্দ ছড়িয়ে পরছে সমস্ত শরীরে। আর জেনিয়া!! তার কথা নাহয় বাদই দিলাম।
তবে জেদের বশে করলেও কোন ভুল করেনি আকিল। সে মেনেই নিয়েছে এটাই দুনিয়ার নিয়ম। সাদার প্রতি সাদার প্রেম, আর কালোর প্রতি কালো। সাদাকে তোষামোদ আর কালোকে ধিক্কার। শতভাগ খাটি ভালবাসা আর কই!! দুয়েকটা সাদাকালোর প্রেম ইতিহাসে যা হয়েছিল তাদের নাম - লাইলি মজনু, শিরি ফরহাদ। তার কপাল এতটা ভালো নয় যে লাইলি বা শিরির দেখা মিলবে। নাহলে আর এত বছর পর কাকতালীয় ভাবে ওই জেনিয়ার ছোটবোনই তার প্রেমে হাবুডুবু খেত না।
তবে কাটা দিয়ে কাটা তোলার মত করে একটা সূক্ষ্ম আনন্দ তার গোঁফের নিচ দিয়ে বয়ে যায় এটা ভেবে যে - জেনিয়ার সামনে তারই ছোট বোনকে নিয়ে ঘরের ছিটকিনি দিতে পারবে সে।