ঘরের সব কয়টা লাইট জ্বালিয়ে দরজা জানালা ভাল ভাবে লাগিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের নগ্ন শরীরটা দেখছে রাজিকা। পুরো নাম মামনুন ইফতান চৌধুরী রাজিকা। গলা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একটু একটু করে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সে। কি নেই এই শরীরে! যেমন গড়ন, তেমন রং, যেকোন পুরুষকে মুগ্ধ করার মত সব রকমের যন্ত্রপাতি উপস্থিত। দুচোখ ভরে নিজেই নিজের নগ্নতা দেখে কেমন একটা বিকৃত তৃপ্তি পায় আর মাঝে মাঝে খিলখিলিয়ে হেসেও ওঠে ওই একই ভঙ্গিতে। কিন্তু হঠাৎই কি যেন হয় তার, পরম লোভাতুর চোখ নিয়ে পায়ের নখ থেকে আস্তে আস্তে যখন উপরের দিকে উঠতে থাকে তার দৃষ্টি, এবং সেই দৃষ্টি যখন এসে পরে তার মুখ মন্ডলের উপরে ঠিক তখনই কুঁচকে যায় তার ভ্রু জোড়া, রাগে ক্ষোভে বিষ্ফোরিত হয়ে ওঠে দুই চোখ, ঘনঘন গরম নিশ্বাসে ভারী হয়ে ঘরের বায়ু মন্ডল, কি ভীষণ ঘেন্নায় ঘিনঘিন করে ওঠে সমস্ত শরীর, মূহুর্থেই যেন তার সমস্ত রাগ গিয়ে পরে ওই আয়নার উপর। “ওয়াক থুহ!!” বলে ছুড়ে মারে এক খাবলা থুথু নিজেই নিজের প্রতিবিম্বের মুখে!!!
পরক্ষণেই বিভৎস কান্নায় ভেঙে পরে রাজিকা। ঢলে পরে মেঝেতে, আর স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সেই একই প্রশ্ন ছুড়ে দেয় - “কেন? এত সুন্দর শরীর দিয়ে যখন দুনিয়াতে পাঠালে তখন এত কুৎসিত রূপ কেন দিলে? তোমার ভান্ডারের সব রূপ কি ফুরিয়ে গিয়েছিল?”
ইসস কি বিচ্ছিরি তার চেহারা!! তার নিজেরই ওই চেহারা দেখলে ঘেন্না লাগে, তো অন্য মানুষের কি হয় তা ভাবলে আর একটা মুহুর্থও বেচেঁ থাকতে ইচ্ছা করেনা তার। কি হবে এই শরীর দিয়ে? সবাই যে সুন্দরের পুজারী। যে চেহারায় সৌন্দর্য নেই, আকর্ষণ নেই, সে শরীরের কোনই মূল্য নেই এই বাজারে। অথচ এমন হাজারো সুন্দরী আছে যাদের অভ্যন্তরীণ শরীরের সৌন্দর্য রাজিকার কাছে কিচ্ছু নয়, বরং তারাও যদি রাজিকাকে বিবস্ত্র শরীরে দেখত তবে হিংসায় মরে যেত। দিন শেষে মানব জাতি উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাটে বিশ্বাসে।
শুধু সুন্দর একটা মুখ বাদে আর সব কিছুই আছে রাজিকার। মুখটা যে শুধু অসুন্দর তাও নয়, ওটা একটা কিম্ভুতকিমাকার কুৎসিতও বটে। কোন জিনিস অসুন্দর হলেও তাকে সুন্দর করার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু এমন বিদঘুটে চেহারাকে ঘষা মাজা করতেও রাজি হতে চায়না কোন বিউটি পার্লার। চেহারার বর্ননা দিতে গেলে কোন পশু পাখির বর্ননা দিতে হবে এতটাও খারাপ নয়, কিন্তু একটা মেয়ে হিসাবে তার চেহারায় যেটা থাকা দরকার সেটা অনুপস্থিত, সম্পূর্ণ রূপে অনুপস্থিত। অর্থাৎ তাতে যে এতটুকুও মাধুর্যতা বা আকর্ষণীয়তা নেই সেটা প্রমাণিত। যেমন, জন্মের শুরু থেকে আজ অবধি একটি ছেলেও তাকে প্রপোজ করেনি। প্রপোজ তো দূরের কথা এক বারের বেশি দ্বিতীয়বার ফিরেও তাকাইনি কেউ।
অথচ আজ থেকে ২৯ বছর আগে যখন বাবা মা’র মুখ আলো করে দুনিয়ার বুকে পা রেখেছিল রাজিকা, সেদিন সে দেখতে এতটাই কিউট হয়েছিল যে তখন তাকে তার নিজের মা’ই তার মেয়েকে কাছে পেতেন না ঠিকমত। সবাই যেন কোলে নেবার জন্য, আদর করার জন্য অস্থির থাকত। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকল চিত্রপট। এখন আর কেউ কোলে নিয়ে আদর করতে চায়না তাকে!! যতই দিন যায় ততই যেন একটু একটু করে তার সব সৌন্দর্য কেড়ে নিতে থাকে প্রকৃতি। আর তারই ফলশ্রুতিতে আজ ২৯ টা বসন্ত পেরিয়ে গেলেও স্বামী, সংসার নামক পদার্থ জোটেনি তার জীবনে।
স্বামী সংসার সন্তান ছাড়া একটা মেয়ের জীবনের মূল সার্থকতা প্রশ্নের মুখেই রয়ে যায়। আর সারা জীবন ধরে সেই প্রশ্নের উত্তর খুজে ফেরে রাজিকার মত মেয়েরা।
আজ রাজিকার ছোট বোন তিন্নির বিয়ে। অনেক্ষন থেকেই ঘো ঘো শব্দ তুলে ভাইব্রেট করে চলেছে তার ফোনটা। বাড়ির সবাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে খুজে বেড়াচ্ছে রাজিকা কে। সমস্ত বাড়ি জুড়ে সাজসাজ রব। রাজিকা ফোনটার দিকে তাকিয়েই ঝটপট চোখের পানি মুছতে মুছতে রিসিভ করল কলটা এবং এমন একটা ভাব তৈরি করল যেন বিয়ে বাড়ির সমস্ত আনন্দ তার একার ভিতরে বিরাজ করছে-
“হ্যা রে তিন্নি বল”
“বুবু তুই কই?”
“এইতো একটু ওয়াশ রুমে এসেছিলাম রে বনু …”
“বর পক্ষ চলে এসেছে আর তুই ওয়াশ রুমে? তুই ছাড়া আমি কিন্তু বিয়ে করব না”
“একটা থাপ্পড় লাগাব!! আমি ছাড়া কে তোকে বিয়ে দিবে শুনি? আমি এক্ষুনি আসছি”
বলে ফোনটা রেখে চট জলদি নতুন শাড়িটা পরে আয়নার সামনে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজেকে বলল - “ওয়ান টু থ্রি … হাহাহাহা…. ওয়ান টু থ্রি … হাহাহাহা” করে কিছুক্ষণ হেসে নিজেকে সাভাবিক করল সে। বরের সামনে খুব হাসিখুশি থাকতে হবে, বেচারা খুব অপরাধ বোধে ভুগছে। বড় বোনকে দেখতে এসে ছোট বোনকে পছন্দ করে বসে আছে। বলাই বাহুল্য রাজিকার ছোট বোন তিন্নি অসম্ভব সুন্দরী এবং ছেলে সদ্য ডাক্তারি পাশ করে বেরিয়েছে তাই এমন পাত্র হাত ছাড়া করতে নারাজ সবাই। আর এর পক্ষে রাজিকা নিজেই সব থেকে বেশি সমর্থন দিয়ে এসেছে সব সময়। তার জন্য তারই ছোট বোনের জীবন নষ্ট হবে তা কক্ষনোই মেনে নিতে প্রস্তুত নয় সে। একমাত্র আদরের ছোটবোন টাকে নিজের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে কিনা, জীবন থাকতে ওর কোন অকল্যাণ হতে দিবেনা সে।
নীল রঙের শাড়িটার সাথে নীল রঙের চুড়িটা হাতে পরতেই বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠল রাজিকার। এক মূহুর্থ কি যেন ভেবে ঝটকা মেরে চুড়ি গুলো ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। এই চুড়ি গুলোর সাথে জড়িয়ে আছে আরো কিছু যন্ত্রণা … বিচ্ছিরি যন্ত্রণা।
নীল রঙের এই কাচের চুড়ি আর নীল রঙের নেইল পালিশে খুব সুন্দর লাগে তার হাত জোড়া। ফেইসবুকে সে কোনদিন তার নিজের ছবি আপলোড না করলেও নীল চুড়ি পরা হাতের ছবি একবার আপলোড করেছিল তার প্রোফাইল পিকচারে, আর তার পরেই হল এক বিপত্তি। এস.এম রেজা নামের এক সুদর্শন যুবক তার ওই হাতের প্রেমে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে বসেছিল। তার জীবনে নাকি এত সুন্দর হাত সে চোখে দেখেনি। এমন আকর্ষনীয় হাতের জন্য নাকি আজীবন না ঘুমিয়ে পার করে দেয়া সম্ভব!! রাজিকা অবশ্য এসব ভন্ডামী বুঝেও না বোঝার ভান করত। প্রত্যক্ষ ভাবে না পারলেও পরক্ষ ভাবে প্রেম প্রেম স্বাদটা তো পাওয়া যাচ্ছে … আর তা পাবার আকাঙ্খা ভিষণ ভাবে পেয়ে বসেছিল তাকে। আর সে জন্যই ছেলেটাকে প্রশ্রয়ও দিয়েছিল অনেকটা এভাবে -
“এক্সকিউজ মি প্লিজ”
“ইয়েস”
“আমি কি আপনার ৫টা মিনিট নষ্ট করতে পারি? যদি অনুমতি দেন।”
“জী, নষ্ট করুন। ফেইসবুক তো সময় নষ্ট করারই জায়গা”
“হাহাহা, ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনি কি আমার কথায় রাগ করলেন?”
“জী না, রাগ করিনি, আপনি বলুন”
“না মানে একটা প্রশ্ন ছিল, যদি কিছু না মনে করেন…”
“জী প্রশ্নটা বলুন”
“ধন্যবাদ। আসলে আমি জানতে চাচ্ছিলাম প্রোফাইল পিকচারে নীল চুড়ি পরা যে হাত জোড়া দেখতে পাচ্ছি ওটা কি আপনার হাত?”
“জী আমার হাত, কেন বলুন তো?”
“না, ঠিক আছে ধন্যবাদ।”
“কিন্তু কেন সেটা তো বলবেন!!”
“না, পাচ মিনিট হয়ে গেছে তো, তাই …”
“আমিও জানি পাচ মিনিট হয়ে গেছে, সমস্যা নেই আপনার সময় আরো বর্ধিত করা হল। এখন বলুন ওটা আমার হাত কিনা জানতে চাচ্ছিলেন কেন?”
“ভয়ে বলব, নাকি নির্ভয়ে বলব?”
“অবশ্যই নির্ভয়ে বলবেন”
“আমি রীতিমত আপনার হাতের প্রেমে পরে গেছি…”
“হাহাহা … ও আচ্ছা”
“আম নট জোকিং … বিলিভ মি … এত্তো সুন্দর, কমল আকর্ষণীয় হাত আমি আমার জীবনেও দেখিনি”
“হুম বুঝলাম”
“কি বুঝলেন?”
“যা বোঝালেন তাই বুঝলাম”
“কিচ্ছু বোঝেননি”
“তাই?”
“হুম”
“ওকে, তাহলে বুঝিনি”
“বুঝতে কি চান না?”
“কি বোঝাতে চান?”
“আপনার হাত জোড়া আমার খুব ভাল লেগেছে এটা বোঝাতে চাই”
“তাই!!”
“সত্যি বলছি … আরো অনেক কিছু বোঝাতে চাই আপনাকে …”
“কিন্তু আমার হাত ভাল লেগেছে, আমাকে তো ভাল লাগেনি!!!”
“যার হাত এত সুন্দর, তার রূপ যদি আগুনে ঝলসানোও হয় তবুও আমার ভাল লাগবে”
“হাহাহা…”
“হাসছেন কেন?”
“বিয়ে করবেন আমাকে?”
“বিয়ে!!!”
“হুম বিয়ে … দাড়ান আপনাকে আমার ছবি দিচ্ছি … আমার সুন্দর হাতের ছবি দেখলেন, আমাকে দেখবেন না!!! জাস্ট এ মিনিট”...
বলে রাজিকা তার জীবনের তোলা শ্রেষ্ঠ ছবিটা দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ছবিটা সিন হওয়ার পর তাদের কথপোকথন ছিল এক পক্ষীয়, ঠিক এরকম-
“কি জনাব, ছবি দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলেন নাকি আমার সৌন্দর্যে?”
“(চুপ)”
“চুপ করে আছেন কেন? আর কিছু বোঝাবেন না আমাকে? আরো কি কি যেন বোঝাতে চাইলেন?
“(চুপ)”
“যার হাত দেখে আগুনে ঝলসানো রূপের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন সেই আমি বলছি, ভাল করে চেয়ে দেখুন, এটাই আামি। এক চুলও আগুনে পোড়া নয়, তবুও আপনি চুপ করে আছেন?”
“(চুপ)”
“আপনার প্রেমে ফেলার চেষ্টা করবেন না আমাকে?জানেন, আমি উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছি আপনার প্রেমে পরার, আপনার কথার জালে নিজেকে হারিয়ে ফেলার, আপনার নতুন নতুন উপায়ে আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টাকে উপভোগ করার।”
“(চুপ)”
“কি হল? প্রেমের সখ মিটে গেল? আমাকে আপনার প্রেমের ফাঁদে ফেলার নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করবেন না? আমাকে ইম্প্রেস করবেন না? আমাকে হাসানোর জন্য, অবাক করার জন্য, প্রতি মূহুর্থে নতুন নতুন উপায়ে মুগ্ধ করার চেষ্টা করবেন না? কি হল চুপ করে আছেন কেন? কথার জবাব দিন।”
“(চুপ)”
“হাহাহা বুঝেছি। যে হাত জোড়ার প্রেমে পরেছিলেন সে হাত জোড়ার মালিক কে পছন্দ হয়নি বুঝি? হাত জোড়া দেখে ভেবেছিলেন, না জানি কোন অপ্সরী হবে, তাই তো? তাই আর শুধু শুধু সময় নষ্ট করতে চাচ্ছেন না বুঝি? আচ্ছা, আপনাদের যত সময়, ভালবাসা, সম্মান, আহ্লাদ, লুতুপুতু, প্রশংসা ইত্যাদি সব কিছু অপ্সরী সুন্দরীদের জন্য তাইনা? অসুন্দরীদের জন্য আপনাদের মনে কোন স্থান নেই, মায়া নেই, ভালবাসা নেই, করুণা নেই???”
“(চুপ)”
“আচ্ছা, তবে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন, আপনারা তো মেয়েদের পিছনে লাগেন তাদেরকে ছলেবলে কৌশলে বিছানায় ফেলার জন্য, কিন্তু আমি কি এতটাই অসুন্দর যে আমাকে একদিন এক বেলা বিছানায়ও ফেলা যায় না?”
“(চুপ)”
হঠাৎ রাজিকা সম্বিত ফিরে পায় এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। নিজের প্রতি প্রচন্ড লজ্জা আর ঘৃণা নিয়ে ব্লক করে দেয় রেজা নামের ওই আইডি টাকে। এর পরেও অবশ্য বহু প্রেমিক ধারাবাহিক ভাবে প্রেমে পরেছে তার ওই নীল চুড়ি ওয়ালা হাত জোড়ার। আর তারপর থেকে ঘৃণা ধরে গেছে ওই চুড়ি গুলোর উপরে।
চুড়ি বাদেই বিয়ের মঞ্চের দিকে অগ্রসর হল রাজিকা। শতশত মানুষের চঞ্চল আনাগোনায় মুখরিত চারিদিক। পাশেই আরেকটি মঞ্চে গান বাজনার হিড়িক, মাইক্রোফোনে চেচামেচি। সেসব ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেল মঞ্চের দিকে এবং ছোট বোনের পাশে গিয়ে বসে পরল সে। পরীদের মত লাগছে তার বোনটাকে। পাশেই বসে থাকা ছোট বোনের হবু বরের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে ছোট্ট করে সালাম দিল রাজিকা। কিন্তু বর সাহেব লজ্জায় মাথা নিচু করে আছেন। এই লজ্জা গুলো দেখলে ভিষণ রাগ হয় রাজিকার। সত্য কে স্বিকার না করা লোক গুলোর মত ভয়ঙ্কর প্রাণী আর কেউ হতে পারেনা। এরা সত্যটা স্বিকারও করবেনা আবার লজ্জায় লাল হয়ে যাবার মিথ্যা নাটক করতেও ওস্তাদ। এরাই এসিডে দগ্ধ কোন নারীর পাসে বসে সারাদিন বক্তৃতা, সেমিনার করে আর সারাদেশ ঘুটে ঘুটে সবথেকে সুন্দরী মেয়েটা নিজের ঘরে নিয়ে আসে বউ হিসাবে। অসুন্দরদের প্রতি এদের সমিহ শুধু কাগজে কলমে, জনসভায়।
আচ্ছা রাজিকা নিজে অসুন্দর বলেই কি তার এসব চিন্তা হচ্ছে? এসব অভিযোগ আসছে? এত মাথা ব্যথা? কই তিন্নি তো এসব নিয়ে ভাবেনা!! আজ যদি সে তিন্নর মত সুন্দরী হত তবে কি সে এসব নিয়ে ভাবত? হয়তো ভাবত, হয়তো ভাবত না। জ্বালা যার ব্যথা তার। তার ব্যথা যেমন দুনিয়ার কেউ বোঝার চেষ্টা করেনা, তেমনি দুনিয়ার মানুষের সুখও রাজিকার বুঝতে ইচ্ছা করেনা।
বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা যখন শুরু হবে ঠিক তখনই হঠাৎ পাল্টে গেল তিন্নি। বিয়ের সমস্ত প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন, বাবা, মা এবং এত এত আত্মীয় স্বজনদের উপস্থিতিতে কাজী সাহেব যখন বিয়ের কার্যক্রম শুরু করবে ঠিক তখনই শুরু হল তিন্নির পাগলামি। হঠাৎ করেই চিৎকার করে কাজী সাহেবকে উদ্দেশ্য করে সে বলল -
“থামুন!!!”
সবাই অবাক হয়ে তাকাল তিন্নির দিকে। তিন্নি আবারো বলল -
“আমার বড় বোনের আগে আমি কক্ষনোই বিয়ে করব না। আমার বুবুর যেদিন বিয়ে হবে সেদিনই বিয়ে করব আমি, তার আগে না।”
বলে বিয়ের পিড়ি ছেড়ে তিন্নি যখন উঠতে যাবে এমন সময় ওকে চেপে ধরল রাজিকা। বোনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে ফেলল তিন্নি। বর সাহেব মুখে রুমাল চাপা অবস্থায় হা করে তাকিয়ে থাকল সেদিকে। কাজী সহ সমস্ত মানুষ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ এ ধরনের নাটকীয় পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলনা কেউই। কিন্তু তখনো মূল নাটকের বিশেষ অংশ বাকি। যে নাটকের আকষ্মিকতায় বিষ্মিত হয়েছিল রাজিকা এবং তিন্নি দুজনেই। যেন কোন ডিরেক্টরের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী ঘটে চলেছে একের পর এক নাটকের দৃশ্য।
দুই বোন যখন কান্নাকাটিতে ব্যস্ত, ঠিক এমন সময় মাইক্রোফোন হাতে কোন এক পুরুষ কন্ঠ বলে উঠল -
“রাজিকা, উইল ইউ মেরি মি?”
চমকিয়ে উঠল রাজিকা, ভিষণ পরিচিত কন্ঠস্বর। কিন্তু চিনতে পারলনা। সাথে সাথে অবাক, বিষ্ময় আর প্রশ্নবিদ্ধ চোখ নিয়ে মঞ্চের দিকে তাকাল সবাই। কিন্তু একি!! এ তো সাঈদ ভাই!!! কালো একটা চশমা আর সাদা লাঠি হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বসে আছে মঞ্চের উপরে। রাজিকার ইউনিভার্সিটির তিন বছরের সিনিয়র ছিল সাঈদ ভাই। সেই কবে শেষ দেখা হয়েছিল তাদের, মনেই নেই। অসম্ভব ভাল একজন মানুষ তিনি। যে কয়দিন রাজিকা একসাথে পড়াশোনা করেছে, সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে এই সাঈদ ভাই তাকে। কিন্তু এত বছর পর হঠাৎ এখানে, কিভাবে, কেন, এসব প্রশ্ন যখন রাজিকার মাথার শিরা উপশিরায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঠিক তখনই সাঈদ ভাই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর সহ বলতে শুরু করলেন -
“পড়াশুনা শেষ করে লন্ডনে যাওয়ার পর একটা কার এক্সিডেন্টে আমি আমার চোখ দুটো হারাই। তারপর থেকেই তোমার মত জীবন অতিবাহিত করছি। অর্থাৎ কেউ এই অন্ধকে বিয়ে করতে চায়না, হাহাহা। তারপর দেশে এসে তোমার সম্পর্কে জানতে পারলাম। জানতে পারলাম এ যাবৎ ২০ টা পাত্র কতৃক অপমানিত হয়েছ তুমি, অথচ এ অপরাধের জন্য তুমি দ্বায়ী নও, দ্বায়ী যদি কেউ হয়ে থাকে তবে সে তোমার স্রষ্টা, যিনি তোমাকে আমাকে সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, অথবা আমাদের এই সমাজ। কিন্তু আমি দৃঢ় ভাবে বলছি তিনি (স্রষ্টা) কখনো কোন ভুল করেননা। তার প্রত্যেক সৃষ্টির ভিতরেই লুকিয়ে আছে অতুলনীয় সৌন্দর্য, যা সাধু সমাজের দৃষ্টিগোচর হয়নি কখনো আর হবেও না কোনদিন। আমি আজো চোখ বন্ধ করলে তোমার সেই হাসি দেখতে পাই, যে হাসি হাজার চেষ্টা করেও হাসতে পারবেনা তথাকথিত সুন্দরীরা!! যাইহোক, আমার দিকে তাকিয়ে দেখ, আমি অন্ধ। অর্থাৎ আমি এই সমাজের সকল সৌন্দর্য অসৌন্দর্যের উর্ধ্বে চলে গেছি। তোমার সৌন্দর্য নিয়ে দুনিয়ার সবাই মাথা ঘামালেও আমার কোন মাথা ব্যথা থাকবেনা। আমাকে খুশি করার জন্য রোজ নকল সাজে সজ্জিত হতে হবেনা তোমাকে…”
বলে কিছুক্ষণ থামলেন সাঈদ ভাই। বিয়ে বাড়ির এত এত মানুষ সবাই চুপ হয়ে থাকলেও কোন এক কোনায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে গোপনে কথাগুলো শুনছেন আর নিরবে চোখের পানি ফেলছেন রাজিকার বাবা। মেয়েদের সবথেকে কাছের মানুষ তাদের মা হলেও, মেয়ের কষ্টগুলো কেবল বাবা’রাই সবথেকে বেশি উপলব্ধি করেন বোধহয়। রাজিকা মাথা নিচু করে তিন্নিকে শক্ত করে ধরে বসে আছে। তিন্নি সাঈদ ভাইয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে। সাঈদ ভাই লম্বা একটা দম নিয়ে চোখের চশমাটা খুলতে খুলতে বললেন -
“তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই রাজিকা … ভেবনা আমি তোমাকে করুনা করছি, কেননা আমি নিজেও করুনার পাত্র। একজন অসহায় আরেকজন অসহায় কে করুনা করতে পারেনা।”
হাত থেকে মাইকটা ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ রূপে থামলেন সাঈদ ভাই। এর ভিতরেই ঘটলো আরেক নাটকীয় ঘটনা। তিন্নির হবু বর মশাই বিয়ের মঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন সাঈদ ভাইয়ের দিকে। তারপর তার মাথা থেকে বিয়ের পাগড়ীটা খুলে সেটা পরিয়ে দিলেন সাঈদ ভাইয়ের মাথায়, এবং স্যালুট জানালেন তাকে! আর এদিকে সাথে সাথে চারিদিকে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল, করতালিতে মুখোরিত হয়ে উঠল পুরো বিয়ে বাড়ি। আনন্দ যেন আর ধরছিলনা কোথাও। এক সাথে দুই বোনের বিয়ের আনন্দ তো আর এত কোম নয়!!
#সৃষ্টিকর্তা মহান। তিনি সকল ক্ষমতার অধিকারী। ভয়ঙ্কর আগুনের ভিতরে তিনি যেমন সুখ লুকিয়ে রাখতে পারেন তেমনি সুন্দর রূপ বা ঐশ্বর্যের ভিতরেও দূঃখ লুকিয়ে রাখেন। ধৈর্যশীল রাই কেবল সুখের সন্ধান পায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:১৬