somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যখন সব কিছু সত্যি বলে মনে হয়

২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(১)
দীর্ঘ আর উঁচু একটা দেয়াল। দেয়ালে সারি বেঁধে সাঁটা অজস্র বিজ্ঞাপন। চমৎকার একটা শৃঙ্খলা আছে ব্যাপারটার মধ্যে। জীবন, ব্যস্ততা, আশ্রয়, বেঁচে থাকার আকুতি যেন ঠিকরে পড়ছে দেয়ালটার গা থেকে।
“মেস ভাড়া হবে – ব্যাচেলার। অধূমপায়ী।”
“এক রুম, কিচেন, বারান্দা সহ ছোট ফ্যামিলির জন্য বাসা ভাড়া হবে”
“রুমমেট আবশ্যক। বরিশালের লোক অগ্রগণ্য।”
“নামাজী রুমমেট প্রয়োজন। যোগাযোগ করুন।”
আজ মাসের সাতাশ তারিখ। নতুন মেস খুঁজে বের করার জন্য হাতে আছে আর মাত্র তিন দিন। কিভাবে কি হবে কিছুই বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। আলসেমি করে এই কয়দিন আর বের হওয়া হয়নি। আজ অফিসের উদ্দেশ্যে সকাল সকাল বের হয়েছিলাম। মাস খানেকের জন্য কোন মতে একটা মেস খুঁজে বের করাই ছিল উদ্দেশ্য। শ্যামলীতে যে গলিতে থাকি, সেই গলির শেষ মাথায় একটা দেয়ালে অজস্র খালি মেসের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ে দরকারি নাম্বারগুলো টুকে রাখার বদলে আমি সেই দেয়ালটাই দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে। কিন্তু সবাই যে অধূমপায়ী আর নামাজী মেস মেম্বার চায়। আর ছোট ফ্যামিলি! সে আমি কোথায় পাবো? মুশকিল হল দেখছি!
আগের মেসটা ভালোই ছিল, পরিষ্কার । যাদের সাথে ছিলাম – মেস মেম্বাররাও খুব ভালো ছিল। আন্তরিক, টুকটাক-বড়সড় যে কোন ঝামেলায় একেবারে বুক পেতে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সিগারেট নিয়ে ঝামেলা তো ছিলই না, মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন বিদেশী মদের বোতল চলে আসতো। তবে সেসব নিয়ে হাঙ্গামা হয়নি কখনোই। রান্না ভালো ছিল, পানি পাওয়া যেত সব সময়। কিন্তু সুখটা কপালে সইল না। বাড়িওয়ালা হঠাৎ করে আমাদের তাড়িয়ে দিল। তাঁর ছোট ভাই নাকি এই বাড়িতে এসে উঠবেন। অতএব, নতুন আস্তানা খোঁজ।
গত রাতে খুব নিঃসঙ্গ লাগছিল। আশেপাশের রুমগুলোতে কেউ নেই, চারপাশে সুনসান নীরবতা। অথচ এক সময় কি জমজমাট ছিল মেসটা। আমার রুমটার পাশেই ছিল পলকের সিট। খুব খাতির ছিল আমাদের দুইজনের। কত রাত আড্ডা দিয়ে পার করে সেই ভোরে ঘুমাতে গিয়েছি তাঁর হিসেব নেই। পলক শান্তিনগরের দিকে চলে গেছে। একদিন যেতে হবে ওঁর সাথে দেখা করতে।
হেঁটে হেঁটে পলকের রুমে গিয়ে দেখি ছেলেটা এখনো পড়ার টেবিলটা নিয়ে যায় নি। কাছে গিয়ে দেখি টেবিলের উপর সুনীলের কবিতার একটা বই। পলক বেশ ভালো আবৃত্তি করতে পারতো। কবিতার বইটা নিয়ে আমি নিজের রুমে ফিরে এসেছিলাম। সারারাত আর ঘুম হয়নি।
বাড়িওয়ালার নোটিশ পাওয়ার পর আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম অন্য একটা মেসে একসাথে থাকার। কিন্তু দেখা গেল কাজটা মোটেও সহজ হচ্ছে না। কারণ অনেকের অফিস এখান থেকে অনেক দূরে। মেসটা ভালো ছিল বলে অনেকে কষ্ট করে এখানে থেকে গিয়েছিল। এখন যেহেতু এখানে আর থাকা হচ্ছে না, তাই অফিস থেকে এতদূরে থাকার আর কোন মানে হয় না। সবাই প্রচণ্ড মন খারাপ করে একে একে মেস খুঁজে সটকে পড়ল। আমিই ঝুলে ছিলাম। কোথায় যাবো? যাবার জায়গা আছে?
(২)
আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ
পরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা
আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা
করে রক্ত...

“অনেক রাত হয়ে গেল নিখিলেশ!” – টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা কাগজপত্র, ফাইলগুলো দ্রুত হাতে গোছগাছ করতে করতে আমি আনমনে কথা বলে উঠি। গতরাত থেকে নিখিলেশ আমার সঙ্গী হয়ে আছে। অবশ্য সে ছাড়া অফিসে এই মুহূর্তে আর কেউ নেই। কিছু কাজ বাকি রয়ে গেল কিন্তু মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিচ্ছিলো, আর পারছিলাম না। সারাটা দিন কাজ নিয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ত ছিলাম। সেই সকাল আটটায় অফিসে ঢুকেছি আর এখন রাত দশটা! মানে হয়? কি সব হাবিজাবি দুনিয়ার হিসেব নিকেশ, যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করছি তো করছিই। মেজারমেন্ট বুকে শুধু খামাখা কাজের হিসেব লিখতে লিখতে আমি বড্ড টায়ার্ড হয়ে গেছি!
“আমি কি এসবের এতো কিছু বুঝি, নিখিলেশ?”
আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার কথা শুনে নিখিলেশ হাসল। হাসুক, ক্ষতি নেই।
অফিসের দরজায় তালা দিয়ে গেট দিয়ে যখন বের হচ্ছি তখন সিকিউরিটি গার্ড ছেলেটা, নাম সজল, মুখে একটা সহানুভূতির হাসি মেখে বলল, “অনেক কষ্ট যাইতেছে আপনার উপর দিয়া স্যার! হেই সকালে আইছেন, আর এখন আন্ধার!”
আমি উদাস গলায় বললাম, “সবাই কপাল, বুঝলে নিখিলেশ!”
“ঠিকই বলছেন স্যার!” - সজল মিষ্টি হেসে বলে। প্রতি উত্তরে আমিও একটু হাসার চেষ্টা করে অফিস থেকে বের হয়ে আসি। সজল আমার পেছন পেছন বের হয়ে আসে, “আপনারে একটা রিকশা ডাইকা দেই স্যার? এখন তো আর বাস পাইবেন না।”
আমি ভেবে দেখলাম বুদ্ধিটা খারাপ না। অনেকদিন রিকশা করে কোথাও যাওয়া হয়না। রিকশায় করে বাতাস খেতে খেতে যাওয়া যাবে। আমার অফিসটা রূপনগরে। সেখান থেকে মিরপুর এক নাম্বার। নিজস্ব বিশটা মিনিট! আহ!

…মৃত গাছটির পাশে উত্তরের
হাওয়ায় কিছুটা মায়া লেগে ভুল নাম, ভুল স্বপ্ন থেকে বাইরে এসে
দেখি উইপোকায় খেয়ে গেছে চিঠির বান্ডিল, তবুও অক্লেশে
হলুদকে হলুদ বলে ডাকতে পারি। আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি ….., ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার;
ইচ্ছে ছিল না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে। …

সজল বেশ করিৎকর্মা ছেলে। আমি ভেবে দেখার আগেই রিকশা হাজির। আমি রিকশায় উঠে সজলের দিকে একটা হাসিমাখা ধন্যবাদ ছুঁড়ে দিলাম। রিকশাটা চলতে শুরু করতেই হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতায় আলোড়ন তুলে বেশ চিৎকার দিয়ে সজল বলে উঠল, “আবার এসো নিখিলেশ!”
আমি চমকে উঠলাম। রিকশা থেকে প্রায় পড়েই গিয়েছিলাম। কি বলল ছেলেটা? ভুল শুনলাম না তো? অদ্ভুত ব্যাপার! আমি কি নিখিলেশ?
রিকশাটা ততোক্ষণে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। আমার হাতে ছিল অফিসের ব্যাগটা। সজলের চিৎকারে আমি এতই চমকে গিয়েছিলাম যে ব্যাগটা হাত থেকে প্রায় ফসকে গিয়েছিল। ব্যাগটাকে সামলাতে গিয়ে চশমাটা আমার চোখ থেকে খুলে নিচে পড়ে গেল। রিকশার চাকার নিচে কড়মড় করে চশমাটা ভাঙ্গার আওয়াজ পেলাম।
যাক, ভালোই হল। চশমাটা তোলার জন্য আর রিকশাটা থামাতে হবে না। রিকশা চলুক অবারিত মন্থর গতিতে। সমস্যা নেই। ব্যাগে আরেকটা চশমা আছে। আপাতত এসো নিখিলেশ, তুমি আর আমি কিছুক্ষণ এই ঝাপসা পৃথিবী দেখি।
(২)
মিরপুর এক নাম্বার পর্যন্ত সময়টা ভালোই কাটলো। অনেক কিছুই ভাবলাম, চশমা না থাকলেও অনেক কিছু দেখলাম। রাতের বেলা হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোতে নীরব হয়ে আসা এই নগরীকে আমার বেশ রহস্যময় লাগে। রূপনগর থেকে মিরপুর এক নাম্বার যাওয়ার পথে কমার্স কলেজটা পড়ে। উঁচু ঢাল বেয়ে উঠতে হয় বলে রিকশাওয়ালারা সাধারণত এই রাস্তায় আসতে চায় না।
এদিকে এই রাতেও অনেক তরুণ তরুণী হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছে। ছেলে-মেয়েগুলো এই কলেজেই পড়ে হয়তো। এদের আমি গত পাঁচ বছর ধরেই দেখছি। আমার বয়স বেড়ে গেছে, অথচ এদের বয়স একদিনও বাড়েনি! কি আশ্চর্য! ওদের জন্য কি টাইম ডায়লেশন হচ্ছে? আলোর গতিতে ছুটছে কি ওরা? নাকি আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, নিখিলেশ?

…নিখিলেশ, আমি এই-রকমভাবে বেঁচে আছি, তোর সঙ্গে
জীবনবদল করে কোনো লাভ হলো না আমার -একি নদীর তরঙ্গে
ছেলেবেলার মতো ডুব সাঁতার?

জবাব এলো না। নিখিলেশ অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত। থাক। কাউকে বিরক্ত করতে এখন আর ভালো লাগে না।
কমার্স কলেজের সামনে এমনিতেই সারাক্ষণ ভিড় থাকে। এখন লোকজন তেমন নেই। দু’তিনটে কুকুর এলাকা পাহারা দিচ্ছে। এদিক ওদিক ফুটপাথের ওপর বসে বন্ধুবান্ধব নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে কয়েকজন। ওখানে চার-পাঁচটা ছেলের সামনে ছেঁড়া লুঙ্গী আর শার্ট পড়া বয়স্ক একটা ভিখিরি অনেকক্ষণ হাত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। জানে, ওদের কাছ থেকে কোন টাকা পাবে না। তারপরও লোকটা কেন যেন দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেগুলো পাত্তা দ্যায় না। একসময় হতাশ হয়ে লোকটা চলে গেল আরেক পাশে। চলে যাবার সময় ছেলেগুলোর দিকে স্নেহার্দ দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা। চা-সিগারেট খেতে খেতে তুমুল আড্ডা চালিয়ে যাওয়া ছেলেগুলো বিষয়টা লক্ষই করলো না।
কি ভাবলো লোকটা? ওঁর কি এদের বয়সী কোন ছেলে ছিল? নাকি আছে? সে হয়তো এখন আর বাবার খবর রাখে না। হয়তো সে এখন নেশাগ্রস্থ, বখে গিয়েছিল, পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে কিংবা হয়তো মরেই গেছে। বৃদ্ধ লোকটা হয়তো আমার মতো যার কোথাও কেউ নেই।
রিকশা থেকে নেমে ওঁকে কি আমার সাথে তুলে নেব নিখিলেশ? আমার যে খুব মায়া লাগে! ওই বৃদ্ধ ভিখারির মধ্যে আমি কেন যেন নিজের ছায়া দেখতে পাই। নিজের ওই ছায়াটাকে একটু আশ্রয় দিতে পারবো না?
নাহ! আমার বড় ক্লান্তি লাগে! বাড়ি পৌছাতে হবে। বাড়ি পৌঁছে জামা ছাড়তে হবে, গোসল করতে হবে, খেতে হবে। আর একটু বিশ্রাম দরকার। নরম বিছানায় শুয়ে আলস্যে গা এলিয়ে দেয়া খুব দরকার...
এই বিশ মিনিটের মধ্যেই মন খারাপ হল, ভালও হল। একটা কবিতা লিখলাম, সেটা কমার্স কলেজের মোড়ে যে বটগাছটা আছে তাঁর ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে, ব্যাগ থেকে স্পেয়ার চশমাটা বের করে স্পষ্ট জগতে ফিরে এলাম। রাতের বেলা ঝাপসা থাকা ভালো না। ওতে অমঙ্গল হতে পারে।
চশমাটা ভাঙ্গা ছিল। একটা ডাঁটি ভেঙ্গে গিয়েছিল যেন কবে। ঠিক করা হয়নি। খাতা সেলাই করার মোটা লাল রঙের সূতা দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম কোন এক বিপদের দিনের আশংকায়। আজ সেটা কাজে লেগে গেল। চশমার পাশ দিয়ে সূতার একটা অংশ বিশ্রীভাবে ঝুলে আছে। থাক। কি এসে যায়?
প্রিন্স হোটেলের সামনে রিকশা থেকে নামার পর আমি যখন ভাড়া দিচ্ছিলাম তখন রিকশাওয়ালা রাগী রাগী চোখে আমাকে দেখছিল। দেখতেই পারে। আফটার অল, সে রাতের রিকশাওয়ালা। এরা অনেক কিছুই দেখতে পায়। আমি যে এখন আর আমি নেই, আমি যে এখন নিখিলেশ হয়ে গেছি সেটা বোধহয় সে বুঝতে পেরেছিল।
(৩)
আশ্চর্য ব্যাপার। রাত বেশী হয়নি। মাত্র সাড়ে দশ। রাতের ঢাকার মাত্র ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠার সময় হয়েছে। অথচ বাস স্ট্যান্ডে একটাও বাস নেই। ওহ নিখিলেশ! আমার বড্ড ক্লান্ত লাগে। জীবনটা নির্ঝঞ্ঝাট হয় না কেন? বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখবো লাইন দিয়ে বাস দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কাড়াকাড়ি করবে আমাকে বাসে তুলে নিতে। বাসে এসি থাকবে। নরম চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই কেউ একজন ঠাণ্ডা একটা স্প্রাইট দিয়ে যাবে। আহ!
হঠাৎ আমার পাশ দিয়ে একটা রিকশাওয়ালা ডাক দিয়ে যায়- “শ্যামলী...শ্যামলী...যাইবেন শ্যামলীইইই...”
আমার মনের ভেতরে নিখিলেশের সাথে কথোপকথন চলতে থাকে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা-টা ধরে গেল আমার। আমি তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে রিকশাটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “একটা রিকশা।”
নিখিলেশঃ আবার রিকশা?
আমি প্রায় নিশিগ্রস্থের মতো বলে উঠলাম, “হ্যাঁ নিখিলেশ!...”

হাঁক দিয়ে রিকশাওয়ালাকে ডাক দিলাম, “ওই মামা! শ্যামলী কত?”
- “এক দাম আশি ট্যাকা।”
- “ধুৎ! অতো ভাড়া হয় নাকি? পঞ্চাশ।”
রিকশাওয়ালা আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল, “মজনু আজাইরা ভাড়ায় রিশকা টানে না। সত্তুর ট্যাকায় যাইবেন?”
আমি গাঢ় স্বরে বলি – “যাবো নিখিলেশ!”
- “কি কইলেন?”
শেষ কথাটা আমি মনে মনে ভেবেছিলাম, রিকশাওয়ালা সেটা শুনল কিভাবে বুঝলাম না। আমি থতমত খেয়ে বলি – “কিছু না। একশ টাকার ভাংতি লাগবে। রাস্তায় একটা সিগারেটের দোকানে থামায়েন।” বলে আর দেরী করি না, রিকশায় উঠে পড়ি। বহুদূর যেতে হবে।
মিরপুর রোড ধরে রিকশাটা উড়ে যেতে থাকে। শীত এসে গেছে প্রায়। বাতাসে কোমল শীতলতা। ভালো লাগে বছরের এই সময়টা। অনর্থক শরীর ঘেমে ওঠে না বলে মনে হয় যেন ক্লান্তি এই শরীরে আর কখনও বাসা বাঁধবে না।

…তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত, রাত্রে
এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেতো না, রোজ অন্ধকার হাত্‌ড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক? তা হলে কি প্রতীক্ষায়
আছে অদুরেই সংস্কৃত শ্লোক? পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না।…

কিছুদূর যাওয়ার পর রিকশাটা সাঁই করে বামে সাইড কেটে একটা টং দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। দোকানে লোকজন কেউ নেই। বুড়ো দোকানদার আমাকে সিগারেট দেয়ার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “চা খাইবেন কাকা?”
রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে কেউ যে চা খাওয়ার জন্য থামে না এটা এই বুড়া চাচাকে কি বোঝাবে? কিন্তু আমি না করতে পারি না। চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানের পাশে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে একটা সিগারেট ধরাই, রিকশাওয়ালাকে ডাক দেই চা খাওয়ার জন্য। ছেলেটা যেন জানতোই আমি চা খাব। রিকশা থেকে নেমে গামছা দিয়ে মুখ মুছে ও আমার সামনের বেঞ্চটাতে বসল। আহারে, কি ক্লান্ত চেহারা! মজনু উল্টা করে একটা টুপি পড়ে আছে মাথায়। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। বেশ স্মার্ট তো ছেলেটা! থুঁতনিতে যেটুকু দাঁড়ি গজিয়েছে সেটাকে অনায়াসে ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি বলে চালিয়ে দেয়া যায়। মজনুর চেহারার কোথায় যেন আল পাচিনোর একটা ছাপ আছে। সেই নিমগ্ন নিঃস্পৃহ অথচ অর্থপূর্ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি...
আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়ে মুখটা হাসি হাসি করে মজনু বলল – “মামা, আপনে এই রাইতের বেলায় ভাঙ্গা চশমা পইড়া আছেন। বিষয়টা কি? আপনারে তো আজব দেখাইতেছে। হা হা হা!”
(৪)
মজনু এখন দুরন্ত গতিতে রিকশা চালাচ্ছে। কিভাবে চালাচ্ছে সেটা ও-ই ভালো জানে কারণ আমার দেখাদেখি সেও চোখে একটা হলুদ পোলারাইজড চশমা পড়েছে। দেখেই বোঝা যায় বেশ দামী চশমা। এই চশমা ও কোথায় পেল সেটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিল। করলাম না। থাক। রাতের বেলা পাগল না হলে কেউ চশমা পড়ে না। মজনু এখন নিখিলেশ হয়ে গেছে। নিখিলেশদের এতো প্রশ্ন করতে নেই।
আর আমার চোখে নিয়ন লাইটের আলোতে ধরা পড়ে কুয়াশাচ্ছন্ন এক প্রাচীন রাজধানী। আমার আর চশমার প্রয়োজন নেই। আমি চশমা ছাড়াই আরও ভালো দেখতে পাচ্ছি এখন। ঐ যে, সামনেই মোড়ে একটা বিশাল কৃষ্ণচূড়া পাখা মেলে আছে। তাঁর নিচেই র্যাইবের গাড়ি। ওরা এই রাতেও সানগ্লাস পড়ে আছে! আর একটু সামনে এগিয়ে যেতেই আকাশ ঢেকে রেখেছে বিশাল একটা বিলবোর্ড। ওই বিলবোর্ডের ভেতর থেকে বের হয়ে এক লাস্যময়ী নারী। আমাকে আঙুলের ইশারায় ডাকছে! আমার ভেতরে কে যেন নড়ে চড়ে বসে। লোভী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে:- “আমি কি যাবো নিখিলেশ?”
- “মামা, আপনি মাঝে মাঝে কি কন? বুঝি নাতো!”
- “কিছু না মজনু। কথা বলি।“
- “কার লগে কথা কন?”
- “আমার এক বন্ধুর সাথে।“
- “মুবাইলে?”
- “না, মনে মনে।”
মজনু কি বুঝল কে জানে? চুপ করে গেল। মজনু গান গাইতে পারলে ভাল হত। মজনুর বদলে আমিই গান গাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ কে যেন রুক্ষ স্বরে ডেকে উঠলো- “অ্যাই রিকশা দাঁড়া!”
র্যা ব!!
আগেই সন্দেহ করেছিলাম। এতো রাতে সানগ্লাস পড়া রিকশাওয়ালা আর গাতক যাত্রী দেখে ওরা যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। মজনু রিকশা থামালো র্যাাবের গাড়ির ঠিক সামনে। মজনুকে ওরা কিছু বলল না। ও রিকশার ওপর বসে বসে পা দোলাতে লাগলো। আমাকে রিকশা থেকে নামিয়ে আপাদমস্তক হাতড়ে হাতড়ে দেখলো একজন। ব্যাগে অনেক খোঁজা খুঁজি করেও কিছু না পেয়ে ওরা বেশ বিরক্ত হল বুঝলাম। হওয়ারই কথা। আমার একটু ভয় ভয় করছিল। র্যা ব-পুলিশ সম্পর্কে অনেক আজেবাজে কথাবার্তা শুনি। হঠাৎ চড় থাপ্পড় দেয়া শুরু করলে ঝামেলা।
ওদের দেখলেই আমার পুরনো এক দিনের কথা মনে পড়ে যায়। অপারেশন ক্লিন হার্ট চলছিল সেই সময়কার কথা। মোটর সাইকেলে করে এক যুবক তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ- এর চওড়া রাস্তা ধরে খুব উড়ে বেড়াচ্ছিল। ছেলেটা বেশ লম্বা চওড়া, দেখলেই বোঝা যায় মাস্তানি করে বেড়ায়। কিন্তু মেয়েটা ছিল অদ্ভুত সুন্দরী। খুব ফর্সা, কাটা কাটা চোখ, একটু লম্বাটে মুখ। আর মেয়েটা পড়েছিলও এমন টকটকে লাল রঙের একটা সালোয়ার-কামিজ যে দেখলেই চোখ আটকে যাচ্ছিল সবার। ওরা বাইকে চলছিল আর রাস্তার সব কয়টা চোখ ওদের অনুসরণ করছিল। দৃশ্যটা সুন্দর। এক তাগড়া যুবক মোটর সাইকেলে করে তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে ঘুরছে। যেন সত্যিকারের একটা সিনেমা! আমাদের ভালোও লাগছিল আবার হিংসাও হচ্ছিল খুব।
হঠাৎ কি কারণে যেন দুই মিলিটারি ওদের দাঁড় করালো। জিজ্ঞেস করলো - হেলমেট ছাড়া বাইক চালাচ্ছে কেন?
উত্তর নাই। কেউ যদি না বোঝে যে হেলমেট কেন নাই – তাঁকে আসলে কিছু বলার নাই। ছেলেটা আর লাল সালোয়ার-কামিজ পড়া মেয়েটা বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো। ছেলেটা তাঁর চওড়া কাঁধ দিয়ে মেয়েটাকে আড়াল করে রেখেছে। সামনে দুই মিলিটারি। ওদের কাছ থেকে একটু দূরে মিলিটারি পিক আপ দাঁড়িয়ে আছে। অসভ্য বাঙালীগুলোর জন্য চূড়ান্ত আমোদপুর্ণ দৃশ্য। কিন্তু তারপরও ভিড় জমে ওঠেনি। আমিও অনেকের সাথে দূর থেকেই দৃশ্যটা দেখছিলাম। মিলিটারিকে বাঙ্গালী ভয় পায়। অবশ্য ভয় কেটে গেলেই সমস্যা। বাঙ্গালী তখন আর কিছুকেই ভয় করে না। মেয়েটাও বোধহয় প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ মেয়েটা কি যেন মনে করে হেসে ফেললো। আমি দূরে দাঁড়িয়েছিলাম বলে ঘটনা বুঝতে পারিনি। ওদিক দিয়ে হেঁটে আসা এক পথচারীর কাছ থেকে শুনলাম হেলমেট নেই বলে শাস্তিস্বরূপ মিলিটারি ছেলেটাকে কানেধরে একশবার উঠবস করতে বলেছে। সেটা শুনেই সম্ভবত মেয়েটা হেসে ফেলেছিল।
হা হা হা! অভিনব শাস্তি সন্দেহ নেই। মিলিটারিও যে রসিকতা করতে পারে সেটা নিয়ে আমাদের সন্দেহ ছিল। মেয়েটার সাথে দূর থেকে আমরাও হাসতে লাগলাম। দারুণ দৃশ্য। ছেলেটার হাত ধরে মেয়েটা খিল খিল করে হাসছে। দূর থেকে আমরাও হাসছি। যে দুইজন মিলিটারি ওদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের তুলনায় ছেলেটা অনেক লম্বা চওড়া। মেয়েটা সাহস করে হাসতেই পারে। মেয়েটা আমার সাথে থাকলে হয়তো হাসতো না। ছেলেটা কিন্তু হাসছিল না। ওঁর মুখ অপমানে থমথম করছিল। ছেলেটা নিচু গলায় মিলিটারিকে কি যেন বলল। ঠিক তখনই পেছনে শান্ত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারিটা এগিয়ে এসে ছেলেটার গালে ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিল।
সেই চড়ের শব্দে সমস্ত ঢাকা শহর যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। এরপর ওই হ্যাংলা পাতলা দুই মিলিটারি ছেলেটাকে বেদম পেটাল। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। আমরা আর সেই দৃশ্য দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকিনি। যে যার রাস্তায় সরে গিয়েছিলাম। হয়তো মেয়েটার ভয়ার্ত চোখ আমরা দেখতে চাইনি। সুন্দরী একটা মেয়ে আমাদের কাপুরুষ ভাবুক আমরা সেটা কখনোই চাই না। তাছাড়া মেয়েটা তো আর আমার সাথে ছিল না। থাকলে এতসব হতো না। আমরা অনেক চালাক। হয়তো কাপুরুষ, কিন্তু খুব চালাক। ছেলেটাকে বাঁচাতে তাই আমাদের একজনও এগিয়ে গেলাম না। মেয়েটা কাঁদল, ছেলেটা মার খেল। কি এসে যায়?
- “এতো রাতে কোই যান?”
- “বাসায়।“
- “বাসা কোই?”
- “শ্যামলী।“
- “আইডি কার্ড আছে সাথে?”
- “নাহ!”
- “কি করেন?”
- “আমি কবিতা লিখি। শুনবেন একটা কবিতা?...”
নিজের উত্তর শুনে আমি নিজেই চমকে উঠলাম। এ কি করলে নিখিলেশ?
আমার সামনে দুইজন র্যানব সদস্য দাঁড়িয়ে ছিল। তারা একজন আরেকজনের দিকে তাদের বিস্মিত দৃষ্টি বিনিময় করল। হয়তো বুঝে নিল আমাকে সাইজ না করে ছাড়া যাবে না। ওরা আমাকে কিভাবে সাইজ করার কথা ভাবছিল সেটা আমি জানি না। হয়তো দুই একটা চড় থাপ্পড় দিয়েই ছেড়ে দিত। কিন্তু তাঁর আগেই রিকশায় পা দোলাতে দোলাতে মজনু ইয়ার্কির সুরে বলল, “মামা, ইনারে ছাইড়া দ্যান। কিছু খায় নাই। মাথার ইস্কুরুপ ঢিলা আছে। মানুষ খারাপ না।”
দুইজনের মধ্যে একজন ধমকে উঠলো:-
- “অ্যাই হারামজাদা, তুই এই রাতের বেলা চশমা পইড়া আছিস ক্যান?”
- “কালা চশমা তো আপনেরাও পইড়া আছেন। আমি পড়লেই দোষ?”
মজনুর কথা শুনে র্যামবের দুইজন আবারও তাদের দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপর আর কিছু না বলে সোজা গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িটাও আর দাঁড়ালো না। গাড়ি স্টার্ট দেয়াই ছিল, ধীর গতিতে পিছলে বের হয়ে গেল।
- “মামা, খাড়ায়া আছেন ক্যান? উঠেন , রাস্তা এখনো ম্যালা দূর।“
এতো দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমি বেশ ভালো রকমের ধাক্কা খেয়েছি। কি হয়ে গেল আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। র্যা বের গাড়িটা চলে যাওয়ার পরও আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। মজনুর কথায় হুশ ফিরে পেয়ে আবার রিকশায় উঠলাম।
এখনো অনেকটা পথ বাকি।
(৫)
টেকনিক্যালের মোড়ে হঠাৎ যাত্রা বিরতি। মিরপুরের নির্জন শান্ত পরিবেশ থেকে আমরা ততোক্ষণে শহুরে বিশৃঙ্খলার মধ্যে চলে এসেছি। রাস্তায় দুনিয়ার হৈচৈ, তীক্ষ্ণ হাইড্রলিক হর্ন বাজিয়ে হুসহাস করে ট্রাক আর আন্তঃনগর বাস ছুটে চলছে। এর মধ্যেই রাস্তার পাশে একটা ঘুপচির আড়ালে লুঙ্গিটা কায়দা করে ধরে মজনু মূত্র বিসর্জন করতে বসে গেল। এতো রাতেও টেকনিক্যালে লোকজনের বেশ ভিড়। আমার রিকশার সামনেই পুরুষালী ভিড় থেকে গা বাঁচিয়ে এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে, একা। আমার সাথে একবার চোখাচোখি হতেই মেয়েটা আর একটু দূরে সরে গেল।
খুব সাধারণ কালো একটা কামিজেও মেয়েটাকে বেশ সুন্দর লাগছে। গোলগাল মুখে আকর্ষণের চাইতে মায়াটাই বেশী করে ধরা পড়ে। চুলগুলো টানটান করে পেছনে নিয়ে বাঁধা। বড় বড় স্বচ্ছ চোখে ভরসা হারানো দৃষ্টি।
- “আপা কোই যাইবেন?” কাজ শেষ করে, লুঙ্গীতে হাত মুছতে মুছতে মজনু মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল। (“মজনু কি আমার কথা ভুলে গেছে?”)
মজনুর চোখে হলুদ চশমা। মাথায় উল্টো করে পড়া ক্যাপ। গায়ে একটা হাওয়াই শার্ট সাথে লুঙ্গী। বিচিত্র সাজ পোশাক সন্দেহ নেই। রাতের বেলা কিম্ভুত এই ছেলেটার প্রশ্ন শুনে মেয়েটার ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখলাম মেয়েটা ব্যাকুল হয়ে জবাব দিল, “জিগাতলা।”
চট করে আমাকে একবার দেখে নিয়ে আবার বলল, “কিভাবে যাব কিছুই বুঝতে পারছি না। বাসে উঠতেই পারছি না। একটা রিকশাও নাই।”
- “মজনুর রিশকায় উইঠঠা পড়েন। ভাইজানরে শিমুলি নামায় দিয়া আপনারে বাড়ি পৌছায় দিয়া আসুম নে।“
মেয়েটা ইতস্তত করল। রাত প্রায় এগারোটা বাজে। তবে মেয়েটা রিকশায় উঠে বসলো।
পাশাপাশি দুইজন। মাঝে বিস্তর তফাৎ।
(৬)
রিকশায় পেডেল মারতে মারতে মজনু বলে ওঠে, “আপা, এতো রাইত কইরা বাসার বাইরে থাকন ঠিক না। দিন কাল ভালা না।”
-“বাবার খুব অসুখ। হাসপাতালে নিতে হবে রাতেই। বাসায় টাকা ছিল না। এক স্টুডেন্টের বাসা থেকে ধার করে কিছু টাকা নিয়ে আসলাম। সেজন্য দেরী হয়ে গেল।” কথাগুলো বলতে গিয়ে শেষের দিকে মেয়েটার গলাটা একটু কেঁপে উঠলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে উনার?”
ভয়াবহ বিপদে পড়েই বোধহয় মেয়েটার সমস্ত জড়তা কেটে গেছে, বলল,“বাবার অ্যাজমা আছে। আজকে দুপুর থেকেই খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারপরও কি যেন একটা কাজে কোর্টে গেল কাউকে কিছু না বলে।”
“তারপর?
“সন্ধ্যার পর দুইজন লোক বাবাকে ধরাধরি করে বাসায় দিয়ে গেল। বাবা তখন সম্পূর্ণ অচেতন। তাছাড়া বাসাতেও তখন ছোটবোনটা ছাড়া আর কেউ নেই।”
“বাসার আশেপাশে পরিচিত কেউ নেই?”
মেয়েটা থেমে থেমে বলল, “বাড়িওয়ালা থাকে দোতলায়, আশে পাশে সব মেস বাড়ি...কাউকেই তেমন চিনি না...তাছাড়া চার মাসের ভাড়া বাকি...গত মাসেই আমাদের উঠে যেতে বলেছিল...ব্যবহার খুব খারাপ...”
“ডাক্তারের কাছে নেন নি কেন?”
মেয়েটা মাথা নিচু করে থাকে। জবাব আসে না।
মজনু জোরে জোরে প্যাডেল মারতে মারতে জিজ্ঞেস করে, “বাড়িত ব্যাডা মানুষ কেউ নাই?”
“ভাই নেই। মা মারা গেছেন। ছোট একটা বোন আছে। ওকেই বাবার সাথে রেখে এসেছি।”
আমি কল্পনায় যেন সেই দৃশ্যটা দেখতে পেলাম। অন্ধকার ঘুপচি একটা ঘরে হলুদ রঙের একশ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে। জানালার ধারে পেতে রাখা একটা খাট। খাটে শুয়ে আছে শ্বাস কষ্ট আর বুকের ব্যথায় অচেতন মৃত্যু পথযাত্রী এক বৃদ্ধ,, জীবনের বেশীরভাগ হিসেবই যিনি মেলাতে পারেননি। অনেকটা আমারই মত। খাটের পাশে ফ্রক পড়া কিশোরী মেয়েটা বাবার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বারবার জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে দেখছে – কখন তার বোন, এই পৃথিবীতে তাঁর একমাত্র আপনজন, যার কোলে মাথা রাখলে হয়তো সে সব দুঃস্বপ্ন ভুলে যেতে পারে – সেই অন্ধকার গলির পথ দিয়ে ঘরে আলো হয়ে ঘরে ফিরবে।
- “শুনছেন?”
মেয়েটা ঘুরে তাকালো। চোখের কোলে শুকিয়ে আসা অশ্রুজল। হলুদ নিয়ন বাতির আলো-ছায়াতে আমি ওই গাঢ় চোখে দেখলাম এক গহীন জীবনের অতল পথ, ঠিক আমারই মত।
- “বলুন।”
- “একটা কবিতা শুনবেন?”
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। রাস্তায় কর্কশ হর্ন বাজিয়ে দৌড়ে চলা বাস-ট্রাকের সমস্ত শব্দ নিস্তব্ধ হয়ে গেল সেই কয়েক মুহূর্তের জন্য। আমি তখন শুধু দু’টো চোখ দেখছিলাম। নিষ্প্রাণ আর বেদনার্ত চোখে, বিস্ময়ের খুব সূক্ষ্ম একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। জবাব এলো, “হ্যাঁ।”

“নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।।”

Painting by Robert Carter
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:১৮
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×