সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ জুড়ে ঘোলাটে মেঘ। মেঘের গর্জন নেই, হালকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাথায় দিলেও চলে, আবার না দিলেও চলে। এই বৃষ্টি শরীর ভিজিয়ে দিতে পারে না, কিন্তু চশমা ঘোলা হয়ে আসবে। মন হুহু করে উঠবে ঠিকই। অদ্ভুত উদাসিন অবস্থা। গত রাতে আকাশের মেঘগুলোকে খুব ব্যস্ততায় উড়ে যেতে দেখেছি দক্ষিণে। তখন বুঝিনি এই ব্যস্ততার মধ্যেও উদাসিন হওয়ার তাড়না ছিল।
কেমন অদ্ভুত একটা দিন! রবি ঠাকুরের একটা গান আছে না -"এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়"। আজকে ঘনঘোর বর্ষণ নেই। তবে আমি নিশ্চিত, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল আজই ফুটেছে! এইসব দিনে মনের মধ্যে কথা জমা হয়। এইসব দিনে কাউকে মনের কথা বলতে ইচ্ছা করে। কাকে বলা যায়? কেউ তো কাছে নেই!
অনেক দিন সমুদ্র দেখি না। পাহাড় দেখি না। দেখি না বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ, নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ, প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ...খারাপ লাগে। খুব মন খারাপ লাগে। অদ্ভুত এক শূন্যতা ভর করে। আসলে প্রকৃতি নিজের মধ্যে একটা বিশালতা ধারণ করে থাকে সব সময়। আমরা সেই বিশালতার কাছাকাছি যখনই চলে আসি - তখন ঠিক টের পাই – হ্যাঁ! কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে চোখের আড়ালে! কোথাও যেন একটা শুন্যপাত্র পূর্ণ হচ্ছে!
সম্ভব হবে না জেনেও এই অসীম পাত্র পূর্ণ করতে চাওয়ার মধ্যেই একটা তীব্র কৌতুকময় বেদনাবোধ আছে বলে আমার মনে হয়। অনেক অনেক দিন আগে, কেউ যেন হাসতে হাসতে আমাদের মনের ভেতরে শূন্যতার একটা চারাগাছ রোপন করে দিয়েছিল কেউ। না, আমাদের কিছুই করার ছিল না। আমাদের ঘাড়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সেই চারাগাছের যত্ন নিতে। আমরা নিষ্ঠার সাথে তাঁর যত্ন নিয়েছি। গাছ বড় হয়েছে। আমরা সেই গাছের ছায়ায় বেড়ে উঠেছি। গান গাইতে শিখেছি, কথা বলতে শিখেছি, ভালবাসতে শিখেছি। তারপর হঠাৎ এই রকম এক বৃষ্টির দিনের আমরা অবাক হয়ে দেখলাম – আশ্চর্য! এই শূন্যতায় তো সঙ্গী হাওয়ার মতো কেউ নেই! ওখানে কেউ ছিল না কখনও, হয়তো থাকেও না কোনোদিন! এইসব বৃষ্টির দিন এমন কিছু মুহূর্ত তৈরি করে যখন আমাদের মনে কথা জমা হয়, বদল দিনের প্রথম কদম ফোটে, প্রচন্ড আবেগে ভেসে যায় মন প্রাণ, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে অথচ সেই কান্না শোনার মতো আশেপাশে কেউ নেই! আমার কেন যেন মনে হয় – আমাদের যে শেষ পর্যন্ত এভাবেই এই অভিশপ্ত জীবনের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে - কেউ একজন আমাকে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিল। অবশ্য এতদিনে আমি জেনে গেছি –কেউ আসলে আমার বিষণ্ণতার সাক্ষী হতে চায় না।
তবে তাতে আমার সমস্যা হচ্ছিল না। কারণ আমার একজন সঙ্গী আছে যে অনেকটা আমার মতোই। শ্যামলীতে আমার মতোই বিষণ্ণ এক কড়ই গাছ আছে তিন নাম্বার রোডে। সে এক বিরাট গাছ, প্রায় মহীরুহ বলা যায়। যে বাসাতে গাছটা বেড়ে উঠেছিল সেই বাড়িটাও ছিল অদ্ভুত। এক বিঘার মতো জায়গা দখল করে আছে বাড়িটা, চতুর্দিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সামনের দিকে পুরোটাই উঠোন, সদর দরজার একপাশে দেয়াল ফুঁড়ে হেলান দিয়ে আছে একটা সজনে গাছ। আর আরেক পাশে সটান দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশাল কড়ই গাছ। ভেতর দিকে একটা ছোট্ট একতলা ইটের বাড়ি, বাড়িটার আশেপাশে বেশ গাছগাছালি লাগানো আছে – বাড়ির মালিক শৌখিন ছিল বোঝা যায়। একতলা হলেও বাড়ির ছাদে যাবার সিঁড়ি আছে, বাইরে থেকে উঁকি দিলে দেখা যায়। সন্ধ্যার পর সিঁড়ি ঘরে একশ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বেলে রাখে কেউ। কেয়ারটেকার বোধহয়। বাড়িটার ভেতরে আরও গাছপালা আছে, আমি দেখেছি। মোট কথা,থাকার জন্য চমৎকার একটা শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশ, অথচ বাসাটা খালি পড়ে থাকে। কেন?
বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভাবলাম। বাস স্ট্যান্ড থেকে নেমে বাসা পর্যন্ত আমি সব সময় হেঁটে যাই। এই সময়টা একান্ত আমার। অদ্ভুত সব চিন্তা খেলে যায় আমার মনে কেবল এইটুকু পথ পার হতে। আমি ভেবে দেখলাম শ্যামলীর মত একটা জায়গায় এই রকম একটা জায়গা পড়ে থাকার কথা না। ডেভেলপাররা আছেই এই কাজে। খোলা জায়গাগুলোতে দিনরাত বিল্ডিং বানাচ্ছে এরা। ডেভেলপাররা তাহলে এই বাড়িটা ভেঙে ফেলতে পারছে না কেন?
লোভ। ডেভেলপার আর জমির মালিকের লোভ সমানে সমান হচ্ছে না বলেই কনক্রিটের জঞ্জাল তৈরীর পথ সুগম হচ্ছে না। হয়ত জমির মালিকানা নিয়ে ঝামেলা আছে। ওয়ারিশরা কে কত বেশি কেড়ে নিতে পারবে সেটা নিয়েই কাড়াকাড়ি চলছে।
হয়তো বাড়ির মালিক বৃদ্ধ পিতা এখনো বেঁচে আছেন। গোয়ার গোবিন্দ লোক তিনি। বার্দ্ধক্যের অসুস্থতায় শয্যাশায়ী। জীবন প্রদীপ নিভে আসছে কিন্তু তারপরও এই বাড়ির মায়া ছাড়তে পারেননি। আহারে! নিজের সন্তানদের দেখলে কেমন লাগে তার এখন? লোভী, আত্মকেন্দ্রিক, নির্দয় আর হিংস্র কতগুলো চোখ - বৃদ্ধ কি নিজের ছায়া দেখতে পান ওদের মধ্যে?
নাহ, আজকাল উপন্যাস বেশী পড়া হচ্ছে বোধহয়। আজগুবি কল্পনা করছি। জীবন এত সহজ না। তবে সেটা সঠিক করে কে বলতে পারে? আসলে এই তিন নাম্বার রোডটাই অন্য রকম। শান্ত, নিরিবিলি। এই পরিবেশটাই আমার ভালো লাগে। অফিস থেকে ফিরে দুই নাম্বার রোডে আমি সাধারণত ঢুকি না। এই গলির মুখে রিকশার জটলা লেগেই থাকে। সারাক্ষণ খামাখা হৈচৈ, ডাকাডাকি। আমার ভালো লাগে না। তিন নাম্বার রোডটা পুরোপুরি আলাদা। একটু ঘুরপথ আর একটু বেশী হাঁটতে হলেও আমি এই তিন নাম্বার রোডে চলে আসি। আমার ভালো লাগে। শুক্রবারে আমি যখন এই রাস্তা দিয়ে অফিসে যাই তখন কোন এক বাসা থেকে খিচুড়ির ঘ্রাণ আসে। সাথে কি ডিম ভাজি থাকে? কে জানে!
ঘুরে ফিরে আমি আবার সেই বাড়িটার সামনে চলে আসি প্রায় প্রতিদিন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে আমার আগের ধারণা পুরোপুরি ভুল। তিন ছেলে রেখে বাবা মারা গেছেন। মা বেঁচে আছেন। মা-র নাম মেহেরুন্নেসা খানম। এই কড়ই গাছটা তাঁর স্বামী, হাইকোর্টের জাঁদরেল উকিল আব্দুস সালাম সাহেবের লাগানো। কড়া বৈষয়িক মানুষ ছিলেন তিনি। বাড়িটা তাঁর নিজের হাতেই তৈরি করা। কত স্মৃতি পড়ে আছে শ্যামলীর তিন নাম্বার রোডের এই বাড়ির উঠোনে, জানালার ওপাশে, ক্লান্ত দুপুরে! শামলী তিন নাম্বার রোডের এই মহান বৃক্ষ এক মৃত বৃদ্ধের স্মৃতি ধারণ করে ডালপালা মেলে ধরেছে আকাশে।
বৃদ্ধা হয়তো তিন ছেলের বাসাতেই থাকেন পর্যায়ক্রমে। হতে পারে ছেলেরা দেশে থাকে না। এই গাছটাকে দেখার জন্য বৃদ্ধা মাঝে মাঝে দেশে চলে আসেন। এই আঙিনায় হাঁটেন। ওই বাড়িটায় থাকেন হয়ত এক রাত।
-ছাদে ওঠেন কি?
-ওঠেন হয়ত।
-একা?
-নাহ! নাতনী থাকে সাথে।
-নাতনীর হাত ধরে বৃদ্ধা ছাদে ওঠেন ভরা জ্যোৎস্না রাতে। দাদী-নাতনী মিলে গভীর রাত পর্যন্ত গুটুর গুটুর গল্প করেন। আর পাশের বাড়িতে রাত জেগে থাকে অপেক্ষা ক্লান্ত দুই চোখ যার খোঁজ নেয়া হয়নি।
শ্যামলী তিন নাম্বার রোড দিয়ে রোজ সকাল-বিকেল অফিসে আসা-যাওয়ার মাঝে এইভাবে আমার মনে গল্প তৈরি হয়। গল্প অনেক দূর এগিয়ে যায়। আমি প্রতিদিন একটু একটু করে আমার কল্পনার জাল বুনি। গল্পটা সেই মহীরুহকে ছাড়া আর কাউকে বলা হয় না।
একসময় রাত হয়ে আসে। বৃষ্টি পড়তে থাকে। এইসব রাতে মনের মধ্যে বিষণ্ণতার তৃষ্ণা জমা হয়। এইসব বিষণ্ণ সময়ে কাউকে মনের কথা বলতে ইচ্ছা করে। কাকে বলা যায়? কেউ তো কাছে নেই!