অনেকে আগেও বলেছে, “ভাইরে, তোর পেট ভরা প্যাঁচ, জিলাপির প্যাঁচ।”
কথাটা শুনে আমি মনে মনে হেসেছি। তবে কথাটা স্বীকার করিনি। স্বীকার করি কি করে! নিজের মনের ভেতরে ঢুকে আমি নিজেই আঁতকে উঠি প্রত্যেকবার।
খাইছে! এইটা কি? অন্ধকার, চোরাবালি, উড়ন্ত তেলাপোকা, মাকড়সার জাল আর ঘন জঙ্গলে ভরা এইটা কি মানুষের মন? অসম্ভব!
ঘটনা দেখে নিজের জন্য খুব খারাপ লাগলো। পরিবার, বন্ধু বান্ধবদের জন্যও খারাপ লাগলো। আহারে! বেচারারা আমাকে কত্ত ভালোবাসে! ওদের জন্য কি আমি এই জঙ্গল কেটে সাফ করতে পারবো না?
মনের ভেতর থেকে কে যেন গর্জে উঠলো - অবশ্যই! আমাকে পারতেই হবে!
গর্জনের স্টাইল দেখেই আমার সন্দেহ করা উচিৎ ছিল। বন-বাদাড়ে কত ধরণের ভূত প্রেত ঘাপটি মেরে বসে থাকে। আর এইটা তো সাক্ষাৎ শয়তানের ঘাঁটি! তবে আমার মনে একটা বিশ্বাস ছিল – ধুর! আমি কি এতো খারাপ? আমার সবটাই তো আর খারাপ না। একটু সহজ সরল ভালো মানুষও কোথায় যেন লুকিয়ে আছে!
আর, এই গাধাটাই আমাকে বোকা বানালো!
একদিন আমি বিপুল বিক্রমে একটা ধারালো কুঠার নিয়ে সেই জঙ্গলের সামনে হাজির হলাম। মনে একটু ভয় যে কাজ করছিল না, তা না। তবে শুরু করার আগেই হেরে যাবার শিক্ষা আমি পাই নি। তাই জঙ্গলের একধার দিয়ে কুড়াল চালাতে লাগলাম।
কিন্তু একী! একদিক দিয়ে জঙ্গল কাটি, আরেকদিক দিয়ে নতুন করে গাছ গজানো শুরু করে! বেশ কিছুক্ষণ এলোপাতারি ঝোপঝাড় কেটে আমি হাফিয়ে পড়লাম।
বাবারে বাবা! এইসব কি ভদ্র মানুষের কাজ নাকি? একা এই জঙ্গল পরিষ্কার করা কি কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব?
আমি একটা সদ্য কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে আকাশ পাতাল ভাবছিলাম যে কি করে কি করা যায়! হঠাৎ, জঙ্গলের এক প্রান্তে চকচকে কি যেন একটা দেখলাম। ভালো মতো খেয়াল করে দেখলাম চকচকে জিনিষটার কাছেই ছায়ার মধ্যে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আমার খুব কৌতূহল হল। ব্যাপারটা কি! আমার মনের ভেতরে এটা আবার কি জিনিষ! কুড়ালটা পায়ের কাছে রেখে আমি খুব সাবধানে এগিয়ে গেলাম ব্যাপারটা কি দেখার জন্য।
কাছে গিয়ে দেখি ওটা একটা লোহার বর্ম, তার পায়ের একটা ধারালো তলোয়ার পড়ে আছে। ওটাই ঝিক ঝিক করছে। অনেক আগে মানুষেরা এই বর্ম পড়ে, তলোয়ার হাতে যুদ্ধে যেতো। কিন্তু এটা এখানে কি করছে! আজকাল তো আর যুদ্ধ নেই। এখন কর্পোরেট যুগ, লোকজন এখন আর বর্ম পড়ে মারামারি করে না। কাগজে কলমে আর মগজেই যুদ্ধ চলে।
আমি একটু ঝুঁকে তলোয়ারটা হাতে ধরতেই হাজার ভোল্টের একটা শক খেয়ে কোথায় যেন উড়ে চলে গেলাম!
উহ! কি ভয়ানক ছিল সেই ইলেকট্রিক শক! সারা শরীরের সমস্ত কলকব্জা ওলট পালট করে দিয়ে গেল। আমি এক ধাক্কা খেয়ে দশ হাত দূরে মাটির ওপর ডিগবাজি খেয়ে পড়লাম। আমি এতক্ষণ বুঝিনি, ওই জঙ্গলের ভেতরের শয়তানেরা সেই তখন থেকে আমার ওপর নজর রাখছিল। নচ্ছারগুলো এতক্ষণ কোন শব্দই করেনি। আমি মাটিতে আছড়ে পড়তেই জঙ্গলের ভেতর ওরা খিক খিক করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে লাগলো, যেন খুব ফুর্তির একটা ঘটনা ঘটেছে! একে তো কুড়াল দিয়ে জঙ্গল কেটে শরীর দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, তারপর এই শক খেয়ে শরীরটা একেবারে ভেঙ্গে আসছিল।
সেটাও মেনে নেয়া যেত, কিন্তু ওই হাসি? উফফ!! সেই হাসির শব্দ শুনেই পিত্তিটা একেবারে জ্বলে যাচ্ছিলো।
আর তখনই চমকে উঠে খেয়াল করে দেখলাম জঙ্গলের কোথায় যেন আগুন লেগেছে! গাছপালার ঘনত্বের কারণে ভালো করে দেখা যায় না, কিন্তু ওর মধ্যেই শব্দ শুনে বুঝলাম শয়তানগুলো হাসি থামিয়ে হুটপাট করে পালাচ্ছে।
আমি ওদের দুরাবস্থা দেখে হা হা করে হাসতেই এক পশলা বৃষ্টি নেমে আগুনটা নিভে গেল। আর তারপরই ভয়ানক আঁধার করে এলো। আমি টের পেলাম ওই শয়তানেরা আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য জঙ্গলের গভীর থেকে অশুভ কোন প্রেতকে ডেকে নিয়ে আসছে। আমি কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম। আমার গা ছম ছম করতে লাগলো। তীব্র আতঙ্ক আর ভয়ে আমার শরীর অবশ হয়ে আসছিল।
আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা যাবে না। আমি দ্রুত পায়ে সেই কেটে রাখা গাছের গুঁড়িটার কাছে এসে দেখলাম আমার কুঠারটা কারা যেন নিয়ে চলে গেছে। নিজেকে খুব অসহায় লাগলো। দূরে ওই লোহার বর্মটা দেখতে পাচ্ছি। তাঁর পায়ের কাছে এখনও সেই তলোয়ারটা পড়ে আছে। কিন্তু ওদিকে যাবো সেই সাহস হল না। জঙ্গলের ভেতর থেকে শয়তানদের জংলী ছন্দে বাজানো দামামার শব্দ ভেসে আসছে, উদ্দাম কণ্ঠে বিচিত্র উলুধ্বনি করে ওরা সেই প্রেতকে ডেকে আনতে চাইছে আমাকে চিরতরে শায়েস্তা করার জন্য।
আমি একবার ভাবলাম পালিয়ে যাই। খামাখা ঝামেলা করে কি লাভ? কিন্তু মনের মধ্যে আবার কে যেন আমাকে কাপুরুষ বলে গালি দিল। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। ওই শয়তানগুলো আবার আমার সাথে ফাইজলামি করছে না তো?
সন্দেহ আর অজানা আশঙ্কা নিয়ে আমি যখন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে কি করা যায়, ঠিক তখনই জঙ্গলের অনেক ভেতর থেকে একটা রক্তহীম করা আওয়াজ ভেসে এলো। যেন শ্যাওলা ধরা পাতাল গহব্বরের ভেতর থেকে প্রাগৈতিহাসিক কোন পিশাচ উঠে আসছে আমাকে শেষ করে দেবে বলে।
আমি ঠিক তখনই, চোখ বন্ধ করে খুব সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাকে ওই তলোয়ারটা নিতেই হবে। আমি এক দৌড়ে সেই বর্মটার কাছে চলে গেলাম। তলোয়ারটার দিকে তাকিয়ে আগের সেই বৈদ্যুতিক শকটার কথা ভেবে আমার শরীর কেঁপে উঠলো। অথচ এটা ছাড়া আজকে আমার আর বাঁচার কোন পথ নেই।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে তলোয়ারটা ধরতেই তীব্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গ আমার শরীর দিয়ে বয়ে যেতে লাগলো। প্রচন্ড যন্ত্রনায় আমার প্রায় হুশ হারিয়ে যাচ্ছিল। পা ভাঁজ করে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কি যেন একটা জিদ আমার মধ্যে তখন গেড়ে বসেছিল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে অমানুষিক যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরই অবাক হয়ে দেখালাম ওই বিদ্যুৎ তরঙ্গ আমাকে আর কষ্ট দিচ্ছে না, বরং ওটা থেকেই অপার্থিব আর প্রায় ঐশ্বরিক এক শক্তি আমাকে ক্রমেই শক্তিশালী করে তুলছিলো। কিছুক্ষণ পো আমি বীর দর্পে উঠে দাঁড়ালাম। আমার হাতে সেই প্রাচীন তলোয়ারটা। আমি হাত ঘুরিয়ে তলোয়ারটা বাতাসে চালিয়ে নিলাম দেখে নিলাম। বাহ! নিজের ভেতর কেমন যেন একটা শক্তি এসে গেছে। এখন আসুক সেই পিশাচ!
আমাকে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। দুদ্দাড় করে জঙ্গল মাড়িয়ে, গাছপালা ভেঙ্গে বিকট শব্দ করে হিংস্র পিশাচটা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, এর চেহারাও আমারই মতো, শুধু আদিম মানুষের মতো তেলচিট চিটে সারা শরীর কালো কালো লোমে ভরা, মাথার চুলগুলো লম্বা আর উসকোখুসকো, আঙ্গুলের গোড়ায় বাঁকানো নখের ভেতরে কালো নোংরা – এক কথায় বিশ্রী একটা অবস্থা। ওর হাতে আমার সেই ফেলে যাওয়া কুঠারটা। হারামজাদা শয়তানগুলো আমার কুঠার, আমার কাছ থেকেই চুরি করে আমার শত্রুকে দিয়েছে। কত খারাপ এরা!
পিশাচটা আমাকে তাঁর রক্তচক্ষু দিয়ে ভালো করে একবার দেখলো। তারপর ক্রুদ্ধ একটা গর্জন করলো।
আমার কেন যেন ব্যাপারটা দেখে একটু হাসি পেয়ে গেল। আমিও যুদ্ধের ময়দানে ওই পিচ্চি শয়তানগুলোর মতো খিক খিক করে হাসতে শুরু করলাম।
আমার হাসি দেখে পিশাচটা ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে রাগে গরগর করতে করতে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “হাসছিস কেন হারামি?”
আমি কোন রকমে হাসি থামিয়ে বললাম, “খেয়াল করে দ্যাখ, তুই তো উত্তেজনায় প্যান্ট পড়তেই ভুলে গেছিস। হি হি হি।”
আমার কথা শুনে পিশাচটা ঝট করে হাত থেকে কুড়ালটা ফেলে দিয়ে ওইখানটা আড়াল করলো। বেচারার চেহারা হয়েছিল দেখার মতো! আমি এসব দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। পিশাচটা মুখ চোখ লাল করে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমি হাসি থামাতেই পারছি না। হাসতে হাসতে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠছিল। এক সময় কোন রকমে উঠে গিয়ে পিশাচটার কাঁধে হাত রেখে বললাম, “একা একা শয়তানি করতে আমার আর ভালো লাগছিল না, বুঝলি! তাই কায়দা করে তোকে ডেকে আনলাম। এই জঙ্গলটা আমিই বানিয়েছি আর আমি এটাকে ধ্বংস করবো! হা হা হা! আমি কি পাগল?”
...
অনেকদিন পরের কথা।
আমি আর পিশাচটা মিলে সেই জঙ্গলের সামনে একটা স্টেজ বানিয়েছি। বাইরে থেকে দেখলে কিছুই বোঝা যায় না যে স্টেজের পেছনে কি আছে। স্টেজের ওপর নানা রকম সুন্দর সুন্দর ছবি টানিয়ে রেখেছি। সেগুলো দেখে সবাই খুব খুশী হয়। ইদানীং আমি লেখালেখি করে বেশ নাম কামিয়েছি। মাঝে মাঝে কিছু আলাভোলা আর কৌতূহলী মানুষ ভুল করে আমার কাছে চলে আসে। কৌতূহল মেটাতে ওদের নিয়ে আমাকে স্টেজের পেছনে যেতেই হয়। পিশাচটা ওদের নিয়ে কি করে সেটা দেখতে আমার ইচ্ছা করেনি।
এখন আমি স্টেজের বাইরেই থাকি আর পিশাচটা ভেতর থেকে মাল পত্র সাপ্লাই দেয়। পিশাচটা এতো নিষ্ঠুর! এতদিন সুখে শান্তিতে জঙ্গলে বাস করতে থাকা শয়তানগুলোকে ও সারাদিন খাটিয়ে মারে। এক ফোটা বিশ্রাম নিতে দেয় না। ওরা মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে। ওরা প্রায়ই বলে, “ভাইরে, তোর পেট ভরা প্যাঁচ, জিলাপির প্যাঁচ।”
শুনে আমি হাসি। কিছু বলি না।
আমার লেখা অন্যান্য গল্পঃ
১) একটি অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প
২) ফেরা
৩) জয়ানালের মধ্যরাতের কবিতা
৪) নিগূঢ় প্রতিবিম্ব
৫) পুনর্জাগরন
৬) একজন জাহেদা বেগম
৭)গল্পঃ আক্ষেপ
৮) পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রেমের গল্পটা
৯) শেষ পর্যন্ত
১০) কোন এক অনিয়ন্ত্রিত সকালে
১১) নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়
১২) ভয়
১৩) একটি অসম্পূর্ণ চিঠি
১৪) মুক্তি
আমার ফেসবুকঃ
স্বপ্নস্বর্গ - নাভিদ কায়সারের ব্লগ