আশেপাশে কত কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা ঘটে। ফেসবুকে তার ঢেউ উঠে। এবারে রাজন নামের ১৩ বছর বয়সী একটা ছেলে পিটিয়ে মেরে ফেলার দৃশ্য কে বা কারা যেন ইউটিউব আর ফেসবুকে আপলোড করে দিয়েছে। পিটিয়ে মেরে ফেলেছে - কথাটা শুনতে অন্যদের কত খারাপ লাগছে জানি না। আমার কিন্তু তেমন একটা খারাপ লাগছে না।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড বহুকাল আগে আমাদের এই আচরণের ব্যাখ্যা করে গেছেন “Civilization and Its Discontents” বইটাতে। ফ্রয়েড বলেছেন, আমরা খুন, ধর্ষণ করতে ভালোবাসি। কিন্তু এই কাজগুলো যেহেতু আমাদের জন্য ক্ষতিকর তাই আমরা কিছু নিয়ম তৈরি করেছি। যেমন খুন করলে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে ইত্যাদি। এখন সভ্য হতে গেলে আমাদের এই সব নিয়ম মেনে চলতে হবে। নিয়ম মেনে চললে আমরা আমাদের প্রিয় কাজ খুন খারাবি, ধর্ষণ করতে পারবো না। আর এই জন্য সভ্য মানুষের মনে কিছুটা অসন্তোষ জমা হয়। আমরা যে হঠাৎ হঠাৎ এসব কাজ করে ফেলছি, এগুলো সেই পুঞ্জীভূত অসন্তোষেরই বহিঃপ্রকাশ।
এক দিক দিয়ে বরং ভালোই হয়েছে। উত্তেজিত হওয়ার মতো একটা সাবজেক্ট পাওয়া গেছে। ফেসবুকে কয়েকটা জোকারের কাজই হল এই রকম একটা সাবজেক্ট নিয়ে খুব মাতলামি করা। আমার কাছে এসব মাতাল দেখতে ভালো লাগে। দুঃখের ব্যাপার, এরা কিছুদিন যাবত লেখালেখি করার কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। আমারও ভালো লাগে না। ফেসবুকে ঢুকি। কারো গরম গরম স্ট্যাটাস নাই। লাইকও দিতে পারি না।
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মজা নিতে হলে আশেপাশে কয়েকটা জোকার রাখতে হয়। এই জোকাররা পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে নাচবে, হাসবে, কাঁদবে আর আমরা হাততালি দেব। ওরা খুশী হয়, আমরাও খুশী হই। মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং। আগে জোকাররা হাততালি পেত এখন লাইক পায়। ঘটনা একই।
অবশ্য বাংলাদেশের খেলা নিয়েও উত্তেজিত হওয়া যেত। গেল না, কারণ বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে ধুম করে হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ম্যাচে আবার জিতে গেল। খবরটা ভালো কিন্তু গোপনে গোপনে আমার একটু মন খারাপও হয়েছে। রোজা রেখে শান্তিতে কাউকে গালাগাল করা যাচ্ছিল না। তামিম ইকবাল শুরুতেই আউট হয়ে যাওয়ার পর আমি একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হল না। শালারা জিতেই গেল!
ওয়ান ডে তে এখন জিতে গেলেও কেমন যেন পানসে ধরণের খুশী খুশী লাগে। আগের মতো “হিট” আসে না। আগে তো বছরে একবার জিতলেই হইতো।
আহ! কি দিন ছিল! খেলায় জিতে যাবার আগেই আমরা রাস্তায় বের হয়ে পড়েছিলাম রঙিন পানি নিয়ে। শুরুতে ব্যাপারটা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ছিল। পরে দেখা গেল খেলায় জেতার চাইতে রঙিন পানি দিয়ে মেয়েদের ভিজিয়ে দেয়াতেই বেশী মজা। মেয়েরা আজকাল যে জামা পড়ে সেটা তো না পড়ার মতোই। পানি পড়ার সাথে সাথে সেটা গায়ের সাথে লেপ্টে গিয়ে এমন একটা অবস্থা হয় যে আমাদের গায়ের মধ্যে উত্তেজনায় জ্বর চলে আসে। কিছু অবুঝ আর দুষ্টু ছেলে অবশ্য এই সুযোগে অনেক মেয়ের বুকে হাত দিয়েছে! এসব অবশ্য গুরুতর অপরাধের মধ্যে পড়ে না। এগুলো মাঝারী অপরাধ।
এই তো কয়দিন আগে কিছু দুষ্টু ছেলে উত্তেজনা সামলাতে না পেরে কয়েকটা মেয়েকে একদম জামা কাপড় খুলে ন্যাংটা করে দিয়ে খুব মজা নিয়েছে। হা হা হা। বেকুব জোকারগুলা এসব দেখে ফেসবুকে কি চিল্লানটাই না চিল্লাইলো। খাড়া বলদ কতগুলা। আরে বলদ, রাজনীতি-দল-গ্রুপিং- চাপাতি-কিরিচের কোপ থেকে শুরু করে গুরুর পায়ের ধূলা কি এমনিতেই ন্যায় নাকি পোলাপানগুলা? এরা হল রাস্তার ছেলে আর তুই হইলি ফেসবুকের ঘোমটা-চুড়ি-লিপ্সটিক দেয়া বদল। তুই নিজে মজা নিতে পারলে কি আর উত্তেজিত হতি? কখনোই না। আর সত্যিই উত্তেজিত হলে কি আর ঘরে বসে থাকতে পারতি? হা হা হা! বলদ কি এদের সাধে বলি?
আচ্ছা যাক। এভাবে মুখে বাজে কথা আনা ঠিক না। রোজা রমজানের মাস। গালাগাল করা ঠিক না।
আসলে এই ঘটনাটা একটা ঘটনা না। অনেকগুলো ঘটনার সমষ্টি। মাঝে মাঝে আমার মাথায় এর চেয়ে খারাপ দৃশ্য ঘোরাঘুরি করে। এবং আমার ধারণা, কম বেশী সবার মনের মধ্যেই মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো পিশাচ টাইপ চিন্তা দুই একবার এসেছেই।
কি, বিশ্বাস হচ্ছে না?
ফার্মগেটে দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন বাসে উঠতে পারি না, কিংবা বাসে উঠে যখন দেখি কেউ আমার পকেটে থাকা বেতনের টাকাটা নিয়ে গেছে তখন আমার মতো অনেকেরই মনে হয় এই ঢাকা শহরটা ফকিন্নি আর চোর চোট্টায় সয়লাব হয়ে গেছে। এদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। খুব খারাপ একটা রোগ হয়ে সবাই মরে গেলে আমি একটু শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারতাম। ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে এই কথা আমি প্রায়ই শুনেছি।
সরকারী চাকরীতে দুইটা পোষ্টে যখন সাড়ে চার লাখ এপ্লিকেশন জমা পড়ে তখনও অনেকেরই একই কথা মনে হয়। অবশ্য মনে হওয়া আর করে ফেলার মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে মানুষে মানুষেও পার্থক্য আছে। কেউ মনে মনে ভাবে আর কেউ করে ফেলে। কেউ আমাদের মতো শাড়ি-চুড়ি পড়ে স্ট্যাটাস দেয়। আর কেউ সত্যি সত্যি রাস্তায় নামে।
এখানেই শেষ না। আরও আছে।
সিএনজিতে যাওয়ার সময় আমার হাত থেকে বাচ্চা একটা ছেলে যখন আমার আই ফোনটা নিয়ে চলে যায় তখনও আমার খুন করতে ইচ্ছা করে।
ভুল চিকিৎসা করে ডাক্তার আমাদের মেরে ফেলছে এই অভিযোগ করে আমাদের ডাক্তারদের মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে।
রাজনের মতো একটা ছেলে আর কয়েক বছর পর লাইসেন্স ছাড়া যখন ঢাকায় গাড়ি চালিয়ে আমার-তোমার বার-তের বছর বয়সী বাচ্চা বাচ্চা ছেলেকে-মেয়েকে বাসের চাকায় পিষে মেরে ফেলবে তখনও আমাদের রাজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করবে।
আমরা, ফেসবুকের জোকারগুলা বুঝতে পারি না সমস্যাটা কোথায়। আমাদের খালি উত্তেজিত হতে ইচ্ছা করে। খুন করতে ইচ্ছা করে। ফাঁসি দিতে ইচ্ছা করে।
কেন জানেন? আমরা জানি যে ছেলেটা মরেছে সে রাজন, ত্বকি না। But do you know why Toki was killed? Do you have any Idea how brutally he was killed, not for stealing, but only for being someone's son who stood for justice?
যাই হোক, ত্বকির বিচার হয়তো হবে রাজাকার বিচার হওয়ার পরে। তাছাড়া রাজনকে যারা মেরেছে তাদের বেশ ধরা ছোঁয়া যায় এরকম ফকিন্নিদের মতোই লাগছে। অন্তত ওরা শামিম ওসমানের লোক না। আমাদের মনে হচ্ছে ওদের ধরে হয়তো ফাঁসিতে ঝোলানো যাবে। কিভাবে, কেন কি হয়েছে এসব আমরা জানতে চাই না। নিজের হাতে না হলেও অন্তত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কিছু ফকিন্নি মারতে চাই।
আমরা রাজন হত্যার বিচার চাই কারণ অন্তত এভাবে হলেও খুন করার মজাটা আমরা নিতে চাই
আমার ফেসবুকঃ
স্বপ্নস্বর্গ - নাভিদ কায়সারের ব্লগ