করিম ব্যাপারীর এই একটা স্বভাব জগলুর খুব খারাপ লাগে। প্রত্যেক সপ্তাহের কোন একটা দিন সে তাঁকে কোন কারণ ছাড়াই গভীর রাত পর্যন্ত দোকানে আটকে রাখবে। রাতের বেলা জগলুকে একা একা বাড়ি ফিরতে হয়। রাতের বেলা একা একা বাড়ি ফেরাটা সমস্যা না। সমস্যা হল ভূতের ভয়। জগলু এমনিতে ভূতে ভয় পায় না। কিন্তু তাঁর বাড়ি ফেরার পথে একটা মড়া পোড়ানোর শ্মশান আর মোল্লা বাড়ির কবরস্থানটা পড়ে। দুইটাই ভয়ানক জায়গা। দিনের বেলাতেও ওদিক দিয়ে যেতে মানুষের বুক কাঁপে। আর রাতের বেলায় তো কথাই নাই। শ্মশানটা আবার চারদিকে বাঁশঝাড়ে ঘেরা। একটু বাতাস হলেই বাঁশে বাঁশে আঘাত লেগে মরমর করে ভৌতিক সব শব্দ হয়। শব্দ শুনে সবাই বোঝে যে ওতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কিন্তু তাতে কারো ভয় কাটে না। কারণ মাঝে মাঝে ওদিক থেকে এমন সব গা হিম করা শব্দ ভেশে আসে - যার উৎস সেই বাঁশ বাগান কিনা তাতে সবারই যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এখানেই শেষ না। দোকান থেকে বেড়িয়ে মিনিট দশেক হাঁটার পর, হাটটা পার হয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে রেললাইনের পাশ দিয়ে। সেই রাস্তা ধরে আরও মিনিট বিশেক হাঁটার পর পড়বে তিন রাস্তার মোড়। সেখানে একটা শত বর্ষী শ্যাওড়া গাছ আছে। গ্রামের বুড়িরা সেই ছোট বেলা থেকেই এই শ্যাওড়া গাছ নিয়ে নানান ভয়ানক আর ভৌতিক গল্প বলে এসেছে। পূর্ণিমার রাতে নাকি ওই গাছের চূড়ায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক বিশালদেহী ডাকিনী। সেই ডাকিনীর আরেক পা কোথায় পড়েছে সেটা কখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে সেই থুত্থুড়ে বুড়িরা বলেছে, সেই ডাকিনীর আরেক পা পড়েছে কোন একটা তেঁতুল গাছের মগডালে। রাতের বেলা যে এই দুই পায়ের সীমা অতিক্রম করেছে তাঁকে আর বেঁচে ফিরতে হয়নি। শ্যাওড়া গাছের ডাকিনী তাঁকে ঘাড় মটকে মেরেছে।
সেই শ্যাওড়া গাছ হাতের ডানে রেখে যে রাস্তাটা গ্রামের ভেতরে চলে গেছে তাঁর শেষ প্রান্তে নূর মসজিদের পাশে জগলুদের বাড়ি। অনেক দূরের পথ।
হাট পার হয়ে জগলু মোড়ের অশথ গাছটার নিচে এসেছে এমন সময় কতগুলো শেয়াল “হুয়া হুয়া হুয়া” করে এক সাথে ডেকে উঠলো। একে তো অন্ধকার রাত, তার ওপর রাস্তা ঘাটে কোন মানুষজন নেই – জায়গাটা অসম্ভব নির্জন হয়ে আছে। এর মধ্যে শেয়ালগুলো এমনভাবে ডেকে উঠলো যে জগলুর একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। শেয়ালের ডাক শুনে জগলু ভয় পেয়ে যাবে এতো দুর্বল সে নয়। তবে বাজারের এই দিকটায় গাছপালা বেশী বলে রাতের অন্ধকারটা একটু বেশীই লাগে। দিনের বেলাতেও জায়গাটা অন্ধকার অন্ধকার থাকে। এখন তো হাতের তালুও দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আজকে যেন কৃষ্ণপক্ষ, অমাবস্যার রাত।
ঝোপের আড়ালে বসে চারপাশে ঝিঁঝিঁ ডাকছে নিরন্তর। হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে ভেশে আসছে হাসনাহেনার মাদকতাময় গাঢ় সৌরভ। মিট মিটিয়ে সবুজ আলো ছড়িয়ে একটা ঝোপকে ঘিরে এখানে সেখানে এলোমেলোভাবে উড়ছে কিছু জোনাকি। অন্ধকারে জ্বলতে নিভতে থাকা সেই সবুজ আলো দেখে মনে হয় অন্য জগতের কারা যেন অসংখ্য জ্বলজ্বলে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। এমনিতেই গায়ে শিরশিরে একটা অনুভূতি হয়।
শেয়ালের ডাকটা তখনও মিলিয়ে যায়নি। হঠাৎ চার পাঁচটা কুকুর ঝড়ের বেগে তাঁর প্রায় গা ঘেঁষে চলে গেল। ব্যাপারটা এতো দ্রুত ঘটে গেল যে ভয়ে জগলুর কলজেটা গলার কাছে এসে আটকে রইলো।
এক লাফে সে রেলের রাস্তায় উঠে আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে একটা ফু দিয়ে নিল। যাত্রার শুরুটাই আজকে খারাপ। সব দোষ ওই ব্যাপারীর। এভাবে তাঁকে দেরী না করালেও পারতো।
এমনিতে করিম ব্যাপারি মানুষ হিসেবে খারাপ না। নামাজ কালাম পড়েন পাঁচ ওয়াক্ত। এই বয়সেও প্রচুর খাটতে পারেন বলে শরীরে মেদ জমতে পারেনি। এখনো তাঁর হালকা পাতলা কিন্তু পেটা শরীর। মুখটা চোখা, তীক্ষ্ণ চোখের দিকে একবার তাকালেই তাঁর বুদ্ধিমত্তা আন্দাজ করা যায়। ব্যাপারীর মাথায় সব সময় টুপি থাকে, তাছাড়া সাদা লুঙ্গী-পাঞ্জাবী আর কাঁচাপাকা দাঁড়িতে তাঁকে দেখলেই মনে একটা শ্রদ্ধা চলে আসে। ভদ্রলোকের বিষয় সম্পত্তি আছে অনেক, তবে লোভ নাই। টাকা পয়সা বেশী হয়ে গেলে লোকজন কৃপণ হয়ে পড়ে, ইনি তা হননি। নিয়মিত দান খয়রাত করেন। গেলবার হজ্জে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পরায় সেবার আর বন্দোবস্ত হয়নি। এই বছর আবার চেষ্টা করবেন শোনা যাচ্ছে।
তাছাড়া ব্যাপারী বেতন টেতন তাঁকে ভালোই দেয়, বাসায় মেহমান আসলে যখন ভালোমন্দ রান্না হয় তখন সেও তাঁর ভাগ পায়। জগলুকে জয় করার এক মাত্র অস্ত্র হল ভালো খাওয়া। সুস্বাদু খাওয়া খাইয়ে জগলুকে দিয়ে যা খুশী তাই করিয়ে নেয়া যায়।
ব্যাপারীর যে আজকে মতলব খারাপ সেটা সে আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিল। কারণ যেদিন এই ঘটনা ঘটবে সেদিন জগলুকে অবশ্যই দুপুরের খানা ব্যাপারীর সাথে খেতে হবে। আজকে অবশ্য খাওয়াটা ভালো ছিল। পাতলা ঝোলের মাছের তরকারী, তরকারীতে লম্বা করে কাঁটা আলুর সাথে শিম দেয়া হয়েছে, সাথে আলু আর শিমের বিচির ভর্তা আর আস্ত মাছের ডিম, কড়া করে ভাজা। খেতে বসে জগলু শুরুতে কপকপ করে এক বাটি ভাত খেয়ে আবার ভাতে নেয়ার সময় খেয়াল করে দেখে ব্যাপারীর প্লেট তখনও অর্ধেকও হয়নি।
“করিম বাই, মনডা উদাস ক্যান?” ভাত নিতে নিতে জগলু জিজ্ঞেস করে। আড় চোখে চেয়ে দেখে প্লেটে তখনও এক টুকরো মাছের ডিম পড়ে আছে।
“বড় মাইয়াডার লাইগা মনডা খুব পোড়ে। ম্যালা দিন হইল কোন খোঁজ খবর নাই।” করিম ব্যাপারী এতক্ষণ প্লেটে মুখ গুঁজে ছিল। জগলুর কথা শুনে মুখ তুলে তাকায়।
ব্যাপারীর কথা শুনে জগলু একটু থমকে যায়। ব্যাপারীর দুই মেয়ে। দুলারী আর সোহাগী। তাঁর বড় মেয়ে অর্থাৎ দুলারীর সাথে জগলুর মন দেয়া নেয়ার একটা ব্যাপার ছিল। সাহসের অভাবে সে কোন দিনই বিয়ের বিষয়টা ব্যাপারীর কাছে খুলে বলতে পারেনি। দুলারীও তাঁর কাপুরুষতা ক্ষমা করেনি।
“তা গঞ্জে যান একদিন। এইদিক সামাল দিবার জন্য আমরা তো আছিই।” জগলু মুখ কালো করে খেতে থাকে। দুলারীর কথাটা শুনেই ক্ষুধাটা সাথে সাথে মরে গেল। আর খেতে ইচ্ছা করছে না।
“হ, গঞ্জে একদিন যাওন লাগবো।“ আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
“কিছু কি হইছে নি?” ব্যাপারীর দীর্ঘশ্বাস শুনে জগলুর দুশ্চিন্তা লাগে দুলারীর জন্য।
প্রশ্নটা শুনে বৃদ্ধের চোখে পানি চলে আসে। এই ছেলেটা তাঁর কেউ না। অথচ তাঁকে কত ভালো বোঝে। বড় মেয়ের বিয়েটা এঁর সাথে দেয়ার জন্য বাড়ির ভেতর থেকে তাঁর উপর অনেক চাপ এসেছিল একসময়। কিন্তু তিনি নমনীয় হননি। সবার ভালো চিন্তা করেই তিনি মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেন। জগলু আর হেনার যে মনের মিল হয়েছে সেটা তিনি জানতেন। কিন্তু জগলু বলতে গেলে তাঁর ঘরের ছেলে। ঘরের ছেলের সাথে বড় মেয়ের বিয়ে দিলে তাঁর ঘরজামাই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটা তাঁর নিজেরও অসম্মান। তিনি এই অসম্মান মেনে নিতে চান নি। এখন মনে হচ্ছে, নিজের জিদের কাছে তিনি তাঁর আদরের মেয়েটাকে বলি দিয়েছেন। শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটা ভালো নেই।
করিম ব্যাপারী সাবধানে চোখের পানি সামলে জবাব দেন, “বয়স হইছে তো! সবাইরে কাছে দেখতে মন চায়। তুমি বিয়া বসবা কবে?”
শ্বশুর হতে পারতো এমন একজনের কাছ থেকে বিয়ের প্রসঙ্গে কথা উঠলে যা হওয়ার কথা জগলুরও তাই হল। বোকার মতো হাসি হেসে সে দরজার দিকে তাকিয়ে আটকে গেল। দরজার আড়াল থেকে সোহাগী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। এই মেয়েটার মতিগতি সে ভালো করে বোঝে না। এর চলাফেরা, কথাবার্তা সবই রহস্যময় আর হেঁয়ালিতে ভরা। দুলারীর সাথে যখন তার ভাব ভালোবাসা চলছিল তখন ওর হাত দিয়েই তাদের চিঠিপত্র চালাচালি হতো। কিন্তু সোহাগী নিজেও যে জগলুর প্রতি দুর্বল সেটা সে কখনোই লুকাতে চেষ্টা করেনি। এটাও একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। দুলারীর শেষ চিঠিটা দিতে এসে সোহাগী বলেছিল,
“এইবার কি করবা জগলু ভাই? তোমার তো আমও গেল, ছালাও গেল।” এক হাতে বেণী দোলাতে দোলাতে, মাথাটা একটু কাত করে তির্যক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় মেয়েটা। ধূর্ত মুখের অভিব্যাক্তিতে একটা খুশীর হাসি খেলে যায়।
“ক্যান? কি হইসে?” জগলু তখনও জানে না দুলারী তার বাবার কথা মেনে নিয়েছে। যেই ছেলের নিজের প্রেমিকার হাত চাওয়ার সাহস নেই, তাঁর সাথে দুলারী বিয়ে বসবে না।
“সেইটা তুমি চিঠি পড়লেই বুঝবা।” জগলুর হাতের চিটিটা চোখ দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে উদাস ভঙ্গীতে আকাশের দিকে তাকায় সোহাগী।
“তুই দুলারীর চিঠি পরছস?” শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে জগলু।
“হ। শুধু এইটা না। আমি সব চিঠিই পড়ছি।” দুলারী এখনো উদাস। দৃষ্টি এখনো আকাশেই।
চিঠিতে কি কি লেখা ছিল সেসব মনে করে জগলুর কান লাল হয়ে গেল। সোহাগী ব্যাপারটা খেয়াল করে খিল খিল করে হাসল আরেক চোট। মিষ্টি একটা ধাতব ঝংকারের মতো লাগে ওর হাসিটা। সোহাগীর হাসির মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যার জন্য হাসিটা থেমে গেলেও অনেকক্ষণ মাথায় হাসিটা ঘুরতে থাকে। হাসি থামিয়ে মেয়েটা ঝট করে ঘুরে জগলুর খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। এতো কাছে যে সোহাগীর দেহের উত্তাপ সে টের পেল নিজের রোদে পোড়া শুষ্ক চামড়ায়। জগলু কখনও কোন মেয়ে, এমনকি দুলারীরও এতো কাছাকাছি হয়নি কখনও। অজানা এক অনুভূতিতে সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল তার সেই মুহূর্তে। কি বলবে বুঝতে না পেরে জগলু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সোহাগী তার মুখটা জগলুর আরও কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বলে, “অখন কি করবা, জগলু ভাই? তোমার তো এখন আর রক্ষা নাই। দুলারীর চিঠি নিয়া অখন তুমি কানতে লাগ। আমার ম্যালা কাজ আছে। আমি গেলাম।”
কথা শেষ করেই সোহাগী চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল। চিঠিটা হাতে নিয়ে ভ্যাবলার মতো সোহাগীর যাওয়ার পথের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল সে। সোহাগীর গায়ের গন্ধ তখনও বাতাসে ভাসছিল।
এরপর অবশ্য সোহাগীর সাথে বহুদিন আর কোন কথা হয়নি তাঁর। তবে এই সব দিনে দরজার আড়ালে তাঁর রহস্যময় নিঃশব্দ উপস্থিতি জগলু সব সময়ই টের পেয়েছে।
দুপুরে খাওয়া শেষে ব্যাপারী ঘুম দিল। প্রতিদিন দুপুরে তিনি নিয়ম করে ভাতঘুম দেবেন। ঘুম থেকে উঠে কয়টা পাইকারি দোকানের লেনদেন সমাধা করার জন্য বের হলেন। আবার বিকালে ফেরত আসলেন। এসেই জগলুকে আটকে ফেললেন। জগলু অবশ্য আরও পরে দোকান ছেড়ে বের হয়। সন্ধ্যার পর বিক্রি বাড়ে। এই সময় কর্মচারীদের হাতে ক্যাশের দায়িত্ব দিয়ে বের হওয়া যায় না। সে নিজে যদিও এই দোকানের অন্যান্য কর্মচারীর মতোই। তবুও সে এই দোকানটাকে নিজের মত করে দেখে।
জগলুকে ব্যস্ত দেখে করিম সাহেব আর দোকানে বসলেন না। ওকে থাকতে বলে আবার তিনি বের হয়ে গেলেন। ব্যবসায়ী সমিতির একটা মিটিং আছে। মিটিং শেষ করেই তিনি আবার দোকানে ফিরবেন।
দোকানে ফিরতে ফিরতে তাঁর বেশ দেরী হল। জগলু ততোক্ষণে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে। বাকি কর্মচারীদের বিদায় করে দিয়ে সে একাই অপেক্ষা করছিল। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। লেপের তলায় না থাকলে জগলুর এই শীত জিনিষটা বেশী সহ্য হয় না। ব্যাপারীর মিটিং থেকে ফিরতে দেরী হল। এসেই খাওয়া দিয়ে দিতে বললেন। খেতে খেতে তিনি জানালেন আগামী শুক্রবার হেনাকে তিনি দেখতে যাবেন। পারলে নিয়ে আসবেন। খাওয়া শেষে জগলু আর দেরী করেনি।
কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে আজকে এমন অবস্থা হবে সেটা জগলু স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। এমন অবস্থা হবে সেটা জানলে সে আজকে দোকানেই থেকে যেত।
রেলের রাস্তাটা আসলে পায়ে চলা মেঠো পথ। রেল লাইনের পাশাপাশি সরু পথটা চলে গেছে বহুদুর। দুপাশে বিস্তীর্ণ ধান আর সবজির ক্ষেত। দূরে কোথাও দাঁড়য়ে আছে একটা তালগাছ। একাকী এবং নিঃসঙ্গ। ক্ষেতের মাঝে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাকতাড়ুয়াগুলোকে দেখে আজ কেমন যেন ভয় ভয় করছে। এদিক দিয়ে গাড়ি ঘোড়া তেমন একটা যাওয়া আসা করে না বলে এখনো রাস্তাটা পাকা হয়নি। তবে হবে হবে করছে। টাকা পয়সা খাওয়ার বন্দোবস্তটা ঠিক হয়ে গেলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।
চাদরটা গায়ে আরও ভালভাবে জড়িয়ে জগলু একমনে হাঁটা শুরু করে। পথ এখনো পুরোটাই সামনে পড়ে আছে। যখন সে মনে মনে ভাবছিল একটা সিগারেট ধরাবে কিনা ঠিক তখনই তাঁর ভয়ানক একটা কথা মনে পড়ে গেল।
গত বছর শীতের সময় এই রেলে কাঁটা পড়ে মরেছিল রসুলপুরের ইদ্রিস মোল্লার ছেলে সালাম। ছেলে হিসেবে অবশ্য সালামের খুব একটা ভালো অবস্থান ছিল না। আজেবাজে নেশা করা, রাত বিরাতে ঘুরে বেড়ানো, বদমাশ ছেলেদের সাথে নিয়ে হই হল্লা করাই ছিল তাঁর অভ্যাস।
সেই ছেলেই একদিন রাতের বেলা বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে কাঁটা পড়লো। শরীরটা কেটে দু’ভাগ হয়ে রেলের দু’পাশে পড়েছিল। বীভৎস দৃশ্য। সারা রাত ছেলেটার লাশ পড়ে রইলো রেললাইনের উপর। ভাগ্য ভালো শেয়াল কুকুরে লাশটা মুখে নেয়নি। নাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। ভোরে দোকানে যাওয়ার পথে সেদিন ভিড় দেখে কাছে গিয়ে শোনে এই অবস্থা। জগলুর সন্দেহ হয় সালামের দলবল একবার তাঁর দোকানে চুরি করার জন্য গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারেনি। সালামকে সে আজীবনই বাজে ছেলে হিসেবে দেখে এসেছে। কিন্তু সেদিন তাঁর এই করুণ পরিণতি দেখে সে বেশ কষ্ট পেয়েছিল।
সিগারেট ধরানোর ঠিক আগ মুহূর্তে জগলুর সালামের কথা মনে পড়ার কারণ আছে। ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে ঠোঁটের কাছে এনেছে এমন সময় তাঁর মনে হল রেলের ধার থেকে কি যেন একটা তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে পাশের ক্ষেতে নেমে গেল। কিছু না বুঝতে পেরে জগলু খানিকক্ষণ খোলা মাঠটার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কোথাও কিছু নেই। আকাশে এক ফালি কাস্তে আকৃতির চাঁদ। মেঘহীন তারাভরা ঝলমলে আকাশ। ঝিঁঝিঁর ডাক আর অশুভ কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকা কয়টা কাকতাড়ুয়া। আর কিছু নেই। ভয়ের একটা শীতল স্রোত তাঁর মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেল। সে ঠিক দেখল না ভুল দেখল বুঝে উঠতে পারলো না। তাঁর স্পষ্ট মনে হল সাদা শার্ট পড়া কেউ যেন তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে গেল।
তাঁকে কি নিশিতে ধরার চেষ্টা করছে নাকি? কাঁপা কাঁপা হাতে সে বেশ সাহস নিয়ে এবার সিগারেটটা ধরাল। সিগারেটে প্রথম টানটা দিয়ে সে তাঁর হারানো সাহস অনেকখানি ফিরে পেল। নিকোটিনের ঝাঁজে সেই অস্থিরতা কমে এলো। ভয়ে তাঁর বুকটা ধড়ফড় করে উঠেছিল। ভালো রাত হয়েছে। গ্রামের লোকজন প্রায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। এতো রাতে তাঁকে যদি নিশিতে পায় তাহলে খবর আছে। সে একবার পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখল। নাহ অনেকখানি পথ সে পেরিয়ে এসেছে। আর ফিরে যাওয়া চলে না। মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। জেলা ফুটবল লীগের সেন্টার ফরোয়ার্ড জগলু ভূতের ভয়ে রাতের বেলা দোকানে ফিরে এসেছে। এই কথা লোকজনের মুখে শোনার চাইতে সালামের ভূতের হাতে মরে যাওয়া ভালো। যা হওয়ার হবে। জগলু আবার হাঁটা শুরু করলো, তবে এবার একটু দ্রুত পা চালিয়ে।
তবে কিছুদুর হাঁটার পর জগলুর একটা বিচিত্র অনুভূতি হতে লাগলো। ওর মনে হতে লাগলো কেউ তাঁকে খুব কাছ থেকে অনুসরণ করছে। কিন্তু যে বা যা-ই তাঁকে অনুসরণ করুক না কেন, সে হাঁটছে খুব পা টিপে টিপে যেন চলার শব্দ টের পাওয়া না হয়। তারপরও মাঝে মাঝে অস্পষ্ট পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাপারটা খেয়াল করার পর থেকেই জগলুর ঘাড়ের কাছটায় শিরশির করছে। এমনকি একবার সে স্পষ্ট শুনল কেউ একজন মুখ চাপা দিয়ে কাশল।
বিষয়টা কি? আশেপাশে তো কাউকে দেখা যায় না, তাহলে কাশে কে?
আহ! শীতটা খুব বেড়েছে। সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে জগলু পেছনে ফিরে দেখে একবার। পেছনের রাস্তাটা কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আছে। বেশিদূর দেখা যায় না। দূর থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া শোনা যাচ্ছে। পুরোপুরি ভৌতিক পরিবেশ। জগলু সিগারেটের অবশিষ্টাংশটা টোকা দিয়ে কুয়াশার ভেতর ছুঁড়ে দিল। মাটিতে পড়ে সেটা একটা আগুনের ফুল্কি ছড়িয়ে নিভে গেল। আরও কয়েক সেকেন্ড জগলু সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। তারপর ঘুরে হাঁটা দিল। দশ কদমও হয়তো পার হয়নি হঠাৎ কে যেন তাঁর চাদরের খুঁট ধরে আলতো করে একটা টান দিল। ভয়ে জগলুর সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো। ব্যাপারটা এতই হালকা ভাবে ঘটলো যে ঘটনাটাকে খুব সহজেই মনের ভুল হিসেবে কল্পনা করে নেয়া যায়, কিন্তু রাতের এই আধভৌতিক পরিবেশে সেটাই অনেক বড় কিছু। জগলুর বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠলো এবার। পেছনে না তাকিয়ে জোর কদমে হাঁটা শুরু করলো সে আবার। রাতের পরিবেশ এবার আরও অস্বাভাবিক আর জীবন্ত হয়ে উঠলো। শেয়াল গুলো এবার আরও কাছাকাছি ডাকতে শুরু করলো। জগলুর মনে হল কবর থেকে রেলের চাকায় কাঁটা পড়া লাশগুলো সব উঠে এসেছে। তাঁর পেছন পেছন সেই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মুন্ডু কাঁটা লাশ গুলো হেঁটে আসতে শুরু করেছে।
চোখ বন্ধ করে এভাবে যে সে কতক্ষণ হাঁটল সে জানে না। হঠাৎ দূরে একটা আলো জ্বলতে দেখে আত্মায় পানি ফিরে এলো তাঁর। একটা ট্রেন আসছে! আসুক ট্রেনটা। বড় একা আর অন্ধকার লাগছিল সব কিছু। এতো দ্রুত হাঁটার ফলে এই শীতেও ঘেমে উঠেছে সে। জুলপি দিয়ে সরু একটা ঘামের ধারা নেমে এসেছে। চাদরের কোণা দিয়ে ঘামটা মুছে নিল সে। ততোক্ষণে ট্রেনটা চলে এসেছে। ট্রেনের সামনের সার্চ লাইটের আলোতে চাদরের কোণাটার দিকে দৃষ্টি পড়তেই আতংকে তাঁর চোখ কোটর থেকে ছিটকে বেড়িয়ে আসতে চাইলো। চাদরের কোণাটায় রক্ত মাখানো একটা হাতের ছাপ! যেন কেউ সেটা ধরতে চেয়েছিল কিন্তু অল্পের জন্য ফস্কে গেছে!
ঝিকঝিক করতে করতে ট্রেনটা ওর সামনে দিয়ে চলে গেল। জগলুর খুব ইচ্ছা করছিল লাফ দিয়ে ট্রেনটায় উঠে পড়ে। কিন্তু কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেনটা দ্রুত চোখের আড়ালে চলে গেল।
ট্রেনের শব্দের রেশটা মিলিয়ে যেতেই পুরনো সেই ভৌতিক পরিবেশ ফিরে এলো। ঝিঁঝিঁর গায়ে কাঁটা দেয়া অসহ্য ডাকটাকে এখন মনে হচ্ছে কবরের নিচ থেকে উঠে আশা অশুভ কোন অশরীরীর গোপন এক সংকেত। রেল লাইনের দুপাশে ঘন হয়ে জন্মানো ঝোপের ওপর কুয়াশা জমেছে। হঠাৎ হঠাৎ হু হু করে ডেকে উঠছে রাতজাগা পাখি। আকাশে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে অবশেষে। আজকে তাহলে অমাবস্যা না। কিন্তু চাঁদের আলোতে অন্ধকার না কমে আরও বাড়ছে।
ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর জগলুর মনে হল এবার যেন সবাই তাঁর অসহায় অবস্থা দেখে হাসছে। শিয়ালের আওয়াজ একবার খুব কাছে আবার পর মুহূর্তেই বেশ দূরে চলে যাচ্ছে। তাদের গ্রামে যে এতো শিয়াল আছে সেটা জগলু আন্দাজে ছিল না।
শিয়ালগুলা কি একটা আরেকটাকে কোন ধরণের সিগনাল পাঠাচ্ছে নাকি? আওয়াজ শুনে তো তাই মনে হয়! এতক্ষণ তো মনে হচ্ছিল দুই একটা শিয়াল, এখন তো মনে হচ্ছে হাজার খানেক!
আচ্ছা, রাতের বেলা একলা পেয়ে শিয়ালগুলো আবার তাঁকে ধরে বসবো নাতো?
আরে নাহ! জগলু নিজেই নিজেকে সাহস দেয়। শিয়ালের এতো সাহস হবে না। তারপরও সাবধানের মার নেই। ভূতের চাইতে শিয়াল বেশী বাস্তব আর বিপদজনক। হাতের কাছে একটা লাঠিসোটা থাকা দরকার।
খুঁজতে খুঁজতে একটা দীর্ঘ গাছের নিচে তিন হাত লম্বা একটা লাঠি খুঁজে পেল সে। লাঠিটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনে সে যা দেখল তাতে ভয়ে তাঁর গায়ের রক্ত পানি হয়ে গেল।
খানিকটা দূরে, বাজারের সেই কুকুরগুলো তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সারিসারি তীক্ষ্ণ দাঁত বের করে তাঁর দিকেই তাকিয়ে হিংস্র ভঙ্গীতে চাপা গর্জন করছে। আশেপাশে কোন লোকজন নেই। হঠাৎ এই কুকুরগুলো একসাথে তাঁকে আক্রমণ করে বসলে বিশাল বিপদ হয়ে যাবে। রাতের বেলা ট্রেনে কাঁটা পড়া লাশ টানা হেঁচড়া করে ওদের অভ্যাস। মাংসাশী জন্তুগুলো মানব শরীরের স্বাদ পেয়েছে কয়েক প্রজন্ম আগেই। দিনের বেলা হয়তো ভয়ে কিছু করার সাহস পায় না। কিন্তু রাতের বেলা?
অন্ধকারে কুকুরগুলোকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। কেবল অন্ধকারে জ্বলজ্বল করতে থাকা সবুজ চোখগুলোই দেখা যাচ্ছে। অশুভ আর ভৌতিক ছায়ার মতো লাগছে দেখতে ওদেরকে। দেখে মনে হচ্ছে নরক থেকে উঠে আসা একদল পশু তাঁকে ঘিরে ধরেছে। এক হাতে লাঠিটা শক্ত করে ধরে জগলু হুশ হুশ শব্দ করে কুকুরগুলোকে তাড়াবার চেষ্টা করলো। বৃথা চেষ্টা। একটা কুকুরকেও জায়গা থেকে নাড়ানো গেল না। বরং কুকুরগুলো এবার তাঁর দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগলো। ওদের জান্তব গর্জন এখন চাইতে বেড়েছে। এতক্ষণ চারপাশ সরব করে রাখা ঝিঁঝিঁ পোকারা যেন নতুন উদ্যমে খুনের দামামা বাজাতে লাগলো এক পৈশাচিক জংলী ছন্দে। আজ যেন এক বিশেষ কালো কুৎসিত রাত। আদিম একদল রক্তপিপাসী পশু তাদের শিকার খুঁজে পেয়েছে। বহু দিনের রক্তপিপাসা মেটাবে আজ তারা।
জগলু ভয় পেয়ে একটু কুঁকড়ে পেছনে সরে এলো। মাঘ মাসের তীব্র শীত সে এখন আর অনুভব করছে না। সারা শরীর দিয়ে কুলকুল করে ঘাম ঝরছে তাঁর। গায়ের চাদরে লেগে থাকা রক্তের দাগের কথাও সে ভুলে গেছে। তীব্র আতংক নিয়ে সে তাকিয়ে আছে কুকুরগুলোর দিকে।
শেষ পর্যন্ত কি এক দল জংলী কুকুরের কাছে তাঁকে মরতে হবে? - ভয়াবহ চিন্তাটা অন্য সময় হয়ত হাস্যকর লাগতো। কিন্তু এখন সেটা জ্বলন্ত বাস্তব বলে মনে হচ্ছে তাঁর কাছে।
শেষ চেষ্টা হিসেবে তিন হাত লম্বা লাঠিটাকে মাথার ওপর উঁচু করে ধরলো সে। একটা পা পেছনে নিয়ে শরীরটা টান করে দাঁড়ালো। তাঁর প্রস্তুতি দেখে কুকুরগুলো একটুও ভয় পেল না। আগের মতোই এগিয়ে আসতে লাগলো শান্ত আর অবিচল পায়ে। শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সব কয়টা কুকুর মাথা নিচু করে আগের চাইতেও ভয়ংকর ভাবে তীক্ষ্ণ দাঁত বের করে গর্জাতে লাগলো। জগলু আত্মরক্ষার তাগিদে লাঠিটা শক্ত করে ধরে ওদের সামনে ঘোরাতে লাগলো আর “বাঁচাও” “বাঁচাও” বলে চিৎকার করে সাহায্যের জন্য ডাক দিতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই ওই খুনী পশুদের অগ্রযাত্রা থামাতে পারলো না। রাতের আঁধারে তাঁর আর্তচিৎকার ঝিঁঝিঁ আর শেয়ালের ডাকের আড়ালে চাপা পড়ে গেল। কেউ তাঁর সাহায্যের জন্য এগিয়েও এলো না।
শেষ মুহুর্তে কুকুরগুলো সব একসাথে মাথা নিচু করে দৌড়ে এসে তাঁর দিকে ঝাঁপ দিল। শেষ মুহূর্তে “বাঁচাও” বলে এক গগন বিদারী আর্ত চিৎকার দিল জগলু ধাক্কা সামলানোর জন্য সে এক হাতে মুখ ঢেকে ধপাস করে পড়ে গেল।
কতক্ষণ যে সে এভাবে মাটিতে পড়ে ছিল তাঁর মনে নেই। তাঁর জ্ঞান ফিরল তীব্র শীতে। জ্ঞান ফিরতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসল। পূর্ববর্তী ঘটনা মনে করে বিস্ফোরিত নেত্রে সে চতুর্দিকে দেখল। নাহ, কুকুরগুলোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাঁর সারা শরীরও অক্ষত আছে। কিছুই হয়নি। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল সে? এক ঘন্টা? দুই ঘন্টা? নাকি দশ মিনিট? বোঝার উপায় নেই। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আবার সে মাটিতে শুয়ে পড়লো। তীব্র আতংকের ফলে শরীর কাহিল হয়ে পড়েছে। নড়তে ইচ্ছা করছে না।
রাতের পরিবেশ আগের মতোই আছে। জংলী কোন ফুলের মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে যেন কোথা থেকে। একটা রাত জাগা পাখি ডেকে উঠলো টিঈঈইই টিঈঈইই করে। কি যেন একটা সরসর করে ছুটে গেল খুব কাছ দিয়েই। জগলু যেখানে পড়ে গিয়ে ছিল সেখানে গাছের মরা পাতা এসে জমা হয়েছে বলে হঠাৎ পতনে সে কোন আঘাত পায়নি। মনে হচ্ছে যেন সে যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল এই গাছের নিচে।
কিন্তু ঘটনাটা কি ঘটলো? মাটিতে শুয়ে থেকেই মাথাটা একটু তুলে চারপাশে আবার একবার দেখল সে। নাহ! কোথাও কিচ্ছু নেই।
তাইলে কি এতক্ষণ ধরে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? নাহ! এইটা কিভাবে হয়? জেগে থেকে কেউ স্বপ্ন দ্যাখে? আজব কারবার শুরু হলো দেখা যায়! ওই পাগলা কুকুরগুলা কি মিথ্যা ছিল? ওহ! কি ভয়ংকরভাবে দাঁত খিঁচিয়ে কুকুরগুলো ছুটে আসছিল! আল্লাহ মাবূদ! কি ছিল ওইগুলা? জীন টিন নাতো? জীনই হবে। জীন ছাড়া এমন বেহুদা কাজ আর কেউ করতে পারে না।
কিন্তু একটা জিনিষ তাঁর মাথায় ঢুকল না। ওরা যদি জীন হয়েই থাকে তাহলে ওর কোন ক্ষতি না করে শুধু ভয় দেখিয়ে চলে গেল কেন?
ভয়ে ভয়ে সে চারপাশে তাকায় আবার! কিন্তু ভয়ের কাছে বাড়ি ফেরার তাড়না জয়ী হয়। জগলু একটা দম নিয়ে উঠে বসে। কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না, বাড়ি ফিরতে হবে। কিছুদূর এগিয়ে জগলু আবার সেই পুরনো জায়গাটায় ফিরে আসে। হাতের লাঠিটা ফেলে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। জীন হোক আর ভূতই হোক – হাতে একটা লাঠি থাকলে ভরসা পাওয়া যায়।
লাঠিটা সম্ভবত একটা গাছের নিচে পড়েছিল। সত্যিই জগলুর হাতে কোন লাঠি ছিল কিনা সেটা আমাদের জানার কোন উপায় নেই। আমরা জানি জগলুর হাতে একটা লাঠি ছিল। জগলুও সেটাই জানে, অন্তত এই মুহূর্তে সে তাই ভাবল।
মাটি হাতড়ে লাঠিটায় হাত দিয়েই জগলু পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। কারণ লাঠিতে হাত দেয়া মাত্র সেটা ফোঁস করে উঠলো। অন্ধকারে লাঠি ভেবে জগলু সাপের লেজ ধরে ফেলেছে।
কি মুসিবতে পড়লামরে আল্লাহ! কাঁদো কাঁদো স্বরে জগলু এবার খোদাকে ডাকতে শুরু করলো। দুনিয়ার তাবৎ প্রাণীকুলের মধ্যে এই সাপ জিনিষটাকে সে প্রচন্ড ভয় খায়। এমনিতেই আজকে রাতে ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটতেছে, তার মধ্যে এইটা আবার নতুন কি শুরু হইলো! শীতের কালে না সাপেরা সব ঘুমায়া থাকে! এই ইবলিশের বাচ্চা রাইতের বেলা এইখানে কি করতাছে?
প্রশ্নটা করে সে বোকা বনে গেল। কথাটা কি ঠিক হল? জঙ্গলে তো সাপেরই থাকার কথা। সাপটা বরং উল্টা প্রশ্ন করতে পারে যে সে এখানে, এই জঙ্গলার ধারে কি করছে! সাপের মাথাটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, বিষাক্ত সাপ কি না কে জানে! তবে লেজটা ধরার সাথে সাথে যে আওয়াজ পাওয়া গেছে তাতে এটা নির্ঘাত সাক্ষাৎ গোখরা বা শঙ্খচূড়। কোন মিস নাই।
আস্তে কইরা লাঞ্জাটা ছাইড়া দিলে কি সাপটা টের পাইবো? পাওয়ার তো কথা। কিন্তু টের পাইলেও তাঁকে কি কামড়াইতে আসবো? মনে হয় না। সে তো কোন ক্ষতি করে নাই। রাতের আন্ধারে ভুলে লেঞ্জাটা ধইরা ফেলছে। আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত মাথায় হাত পড়ে নাই। তাইলে খবর আছিলো।
বিসমিল্লাহ্ বলে যেই না সে হাতের মুঠি আলগা করেছে সেই মাত্র আবারো সাপটা ফোঁস করে উঠলো। ভয়ে জগলু চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। খানিক বাদে আর কোন শব্দ না পেয়ে সে চোখ খুলল।
না খুললেই ভালো ছিল। কারণ চোখ খুলে সে যা দেখল তা সে সারাজীবন ভুলতে পারবে না। জগলু যেখানে বসে আছে সেখান থেকে হাত পাঁচেক দূরে বিরাট এক শঙ্খচূড় সাপ কুন্ডুলি পাকিয়ে ফনা তুলে বসে আছে। ভয়াবহ আতঙ্কে সে বরফের মতো জমে গেল। চোখের পাতা ফেলতেও ভয় লাগছে ওর। সাপটা এখনো ফণা তুলে আছে। মনে হয় ওকেই দেখছে। হঠাৎ করেই সাপটা ফোঁস করে একটা ছোবল দিল। সাথে সাথে জগলু সাপের লেজটা ছেড়ে দিয়ে ছিটকে দশ হাত দূরে সরে গেল। সেই ফাঁকে ফণা নামিয়ে সাপটা একেবেকে দ্রুত একটা ঝোপের আড়ালে চলে গেল।
জগলু ত্রস্ত চোখে সাপটার চলে যাওয়া দেখল। তারপর খুব ধীরে ধীরে বুকের মধ্যে এতক্ষণ আটকে রাখা শ্বাসটা ছাড়ল। বুকটা হাপরের মতো ওঠা নামা করছে তাঁর। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে।
বসে থেকে জগলু কিছুক্ষণ ভাবল রাতের বেলা এখন পর্যন্ত সে কি কি আপদ পার করলো। প্রথমে সালামের ভূত, তারপর সেই রহস্যময় বুনো কুকুর আর এখন একটা জলজ্যান্ত সাপ। আজ রাতে কপালে আর কি কি আছে কে জানে?
একটা সময় দুর্বল পায়ে জগলু উঠে দাঁড়ায়। বাড়ি ফিরতে হবে। আর কিছুদূর গেলেই তিন রাস্তার মোড়। প্রায় আকাশ ছোঁয়া উঁচু শ্যাওড়া গাছের চুড়াটা এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। না, গাছের চূড়ায় কোন ডাকিনীর পা দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য দেখা গেলেও কিছু করার ছিল না। জগলু এই মুহূর্তে আর কিছুই পরোয়া করে না। বড় ক্লান্ত লাগছে তাঁর।
ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তিন রাস্তার মোড়ে এসে হাঁটার গতি একটু বাড়িয়ে দিল জগলু। মনে মনে যত কথাই বলুক, যত সাহসীই হোক না কেন এদিকে আসলে সবারই গা-টা ছমছম করে ওঠে। শ্যাওড়া গাছের ডাকিনী চোখে দেখা না যাক, মনের মধ্যে ঠিকই তাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি ধরা পড়ে। শ্যাওড়া গাছ থেকে নেমে আসা সারি সারি স্তম্ভমূল রাস্তার উপর ফাঁসীর দড়ির মতো শুন্যে লটকে আছে। হঠাৎ করেই যখন ঝিঁঝিঁর ডাকটা থেমে গিয়ে এখানে কবরের নীরবতা নেমে আসে তখন বাতাসে দুলতে থাকা সেই সারি সারি ঝুলগুলোতে একটা আগ্রাসী হাহাকার খেলা করে যায়। মনে হয় যেন রাত জাগা নিশাচর পিশাচেরা গাছের আড়াল থেকে পথিকের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায় আছে।
জগলু ভয়ে ভয়ে জায়গাটা পার হয়। তাঁর কেবলই মনে হতে থাকে আর একটু এগুলেই পেছন থেকে কেউ তাঁর কাঁধে হাত দেবে। অথবা মাটির নিচ থেকে একটা মড়া মানুষের হাত বের হয়ে তাঁর পা চেপে ধরবে। কথাগুলো ভাবতেই ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তাঁর। পায়ের গতি আরও বেড়ে যায়।
শ্যাওড়া গাছের তিন রাস্তার মোড়টা দ্রুত পার হয়ে একটু এগুলেই সেই কুখ্যাত বাঁশঝাড়। জগলু কখনও মড়া পোড়াতে দেখেনি। তবে শ্মশান নিয়ে নানা ধরণের বিজাতীয় গল্প শুনেছে। যেমন লাশ সম্পূর্ণ পোড়ানো হলেও নাকি নাভিটা আগুনে পোড়ে না। ওটা ছাইয়ের মধ্যে থেকে যায়। সব ক্রিয়া কর্ম শেষ হয়ে গেলে শ্মশানের পুরোহিতেরা সেই নাভি একটা বাঁশের কঞ্চির ডগায় বেঁধে খালের কাদার মধ্যে গেঁড়ে রাখে। উদ্দেশ্য - সদ্যমৃত লাশের আত্মাটাকে পঞ্চভূতে বিলীন হতে দেয়ার একটা পথ তৈরি করা। আর এটাই নানান ধরণের বদ লোকজনকে আকৃষ্ট করে এখানে নিয়ে আসে। তন্ত্রমন্ত্রের সাধকেরা অমাবস্যার রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে এইসব জায়গায় জড় হয় যখন কোন খারাপ বা অত্যাচারী মানুষ মারা যায়। বিলের জলে পুঁতে রাখা নাভি দিয়ে তাঁরা শ্মশান কালীর পূজা করে। খুব জটিল আর দীর্ঘ সেই পুজার প্রক্রিয়া। একটু হেরফের হলেই নাকি কালীর রোষে পড়ে কল্লা হারাতে হয়।
ভয়ে ভয়ে এক পা এক পা করে সে জায়গাটা পার হতে থাকে। ঘন হয়ে জন্মানো বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে চাঁদের মৃদু আলোতে পথ চলতে কষ্ট হয়। ঝিঁঝিঁর তীক্ষ্ণ আওয়াজ, শিয়ালের দূরবর্তী কান্না আর বাঁশ ঝাড়ের প্রলম্বিত মরমর আওয়াজে চারপাশের পরিবেশটা পুরোপুরি বদলে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে ডেকে উঠছে একটা রাত জাগা প্যাঁচা। ডানা ঝাপটে এখান থেকে ওখানে উড়ে যাচ্ছে একটা নাম না জানা অদৃশ্য পাখি। রাতের অন্ধকারে সেই ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনে ভয় লাগে। মনে হয় অশরীরী এক প্রেতাত্মা বন্দীদশা থেকে ছুটে বের হয়ে আসার আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে। ওখান থেকে বের হতে পারলেই সামনে যাকে পাবে তাঁর রক্ত চুষে খাবে।
আর দু কদম গেলেই শ্মশানটা পার হয়ে যাবে এমন সময় রক্ত হিম করা এক হাসির আওয়াজ ভেশে এলো পেছন থেকে। জগলুর সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো সেই আওয়াজ শুনে। তবে এবারে জগলু আর দাঁড়ালো না কি হয় সেটা দেখার জন্য। শরীরে যত শক্তি ছিল তা জড়ো করে সে ঝেড়ে দৌড়ালো। পেছন থেকে খনখনে গলায় তাঁকে ডাকতে লাগলো একটা কণ্ঠস্বর – “কাছে আয়...কাছে আয়...তোর মুন্ডু চিবিয়ে খাবো আমি...বড় পিপাসা পেয়েছে...কাছে আয়...যাচ্ছিস কোথায় হতচ্ছাড়া...হা হা হা...”
তখন আর জগলুকে খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। ওর পায়ে যেন কেউ পাখা লাগিয়ে দিয়েছে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে শ্মশানের অন্ধকারটা পার হয়ে একটা ফাঁকা রাস্তায় চলে আসে। চাঁদটা এতক্ষণে মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে এসেছে। সামনেই কবরস্থান। দৌড়ে সে কবরস্থানটাও পার হয়ে যায়। পেছনে সেই ভৌতিক কণ্ঠ তখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি। দৌড়াতে দৌড়াতেই চোখের কোণ দিয়ে সে দেখতে পেল কবরগুলোতে কে বা কারা যেন মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। আর সেই কবরগুলোর সামনে কালো কাপড় পড়ে কারা যেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দৌড়ে যেতে দেখে সব কয়টা মুখ এক সাথে ঘুরে ওর দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড সময়, কিন্তু ওর মধ্যেই জগলু দেখল সব কয়টা লোকের চোখ চাঁদের আলোতে ভাঁটার মতো জ্বলছে। যেন কবরের নীরবতা নষ্ট করার অপরাধে ওরা জগলুকেই আজকে কবরে শুইয়ে দেবে।
পাগলের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে সে বাসার সামনে নূর মসজিদের কাছাকাছি চলে এলো। মসজিদে তখন ফজরের আজান দিচ্ছে। জগলু দূর থেকেই দেখল মসজিদের সামনে ধবধবে সাদা জোব্বা পড়া এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল কেবল তাঁর মাথাটা প্রায় মসজিদের ছাদে গিয়ে ঠেকেছে! কিন্তু এই মুহূর্তে আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। তাঁর পেছনে ছুটে আসছে শ্মশানের মুন্ডুখেকো এক ডাইনী আর শয়ে শয়ে কবরের প্রেতাত্মা। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে জীনের বাদশা। জ্ঞান হারাবার আগে দৌড়াতে দৌড়াতেই সে টের পেল পেছন থেকে কেউ যেন তাঁর চাদরটা প্রায় ধরে ফেলেছে...
-----------
পরদিন...
জগলুর সাধারণত ঘুম ভাঙ্গে অনেক সকালে। প্রায় কাক ডাকা ভোরে। আজকে তাঁর ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হল। জগলুর বড় ভাবী তাঁকে ডেকে তুলল। ঘুম ভাঙ্গার পর কিছুক্ষণ সে হতভম্ব হয়ে বিছানায় বসে রইলো। গতরাতের সমস্ত ঘটনা মনে করে তাঁর সারা শরীর কেঁপে উঠলো। কিন্তু একটা ব্যাপার সে বুঝতে পারলো না, সে তো মসজিদের সামনে পর্যন্ত এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ওখান থেকে সে বাড়ি পর্যন্ত আসলো কিভাবে?
বিষয়টা ঠিক মতো বুঝতে না পেরে ভাবীকে ডেকে সে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবী, দোকান থেইকা কাইল রাইতে আমি বাসায় আইছি কয়টায়?”
“কাল তো তুমি দেরী কইরা ফিরলা। ক্যান মনে নাই?” ওর ভাবী বিছানাটা ঝাড়তে ঝাড়তে জবাব দেয়।
ভাবীর কথাটা শুনে জগলুর মাথাটা ঘুরে উঠে। তাহলে কি সে স্বপ্ন দেখছিল? এও কি সম্ভব? সে মরিয়া হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,
“রাইতে? কয়টায়? মনে আছে আপনার?”
“কি ব্যাপার? তোমার কি শইল খারাপ? এইসব কি জিগাইতাছ তুমি?” ভাবী বিছানা গোছানো বাদ দিয়ে চোখে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকায় ওর দিকে। তাঁর কপালে হাত দিয়ে শরীরের উত্তাপ দেখে বোঝার চেষ্টা করেন জ্বর এসেছে কিনা।
“ভাবী ঠিক কইরা কন তো, আমি বাড়িত ফিরছি কয়টায়।” জগলু ভাবীকে তাড়া দেয়।
ভাবীর চোখে মুখে এবার সত্যিকারে দুশ্চিন্তা দেখা দিল। একটু চিন্তা করে নিশ্চিত হয়ে তিনি বললেন, “তুমি বাড়িত আইসা যখন ঢুকলা তখন এশার আজান দিতাছে। ক্যান? কি হইছে?”
উত্তর শুনে জগলু চুপ করে গেল। গতকাল রাতে দোকান থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে সোহাগী এসেছিল হাতে একটা পান নিয়ে। মুখ গম্ভীর। রাতের বেলা ভালো মন্দ খাওয়া হলে জগলু খুব শখ করে একটা পান খায়। অন্যান্য দিন সোহাগীদের বাসায় কাজ করে যে ছেলেটা সে পানটা দিয়ে যায়। সোহাগী আগে কখনও আসেনি। গতকাল রাতের বেলা ওকে দেখে জগলু বেশ অবাক হয়েছিল। তাঁর দিকে তাকিয়ে পান ধরা হাতটা বাড়িয়ে ধরে সোহাগী রাগী রাগী গলায় বলল, “বাপজান যে আমার বিবাহের বন্দোবস্ত করতেছেন আপনি কি সেই বিষয়ে কিছু জানেন?”
বিষয়টা জগলু জানত না। তাই সে কিছু না বলে সোহাগীর দিকে জিজ্ঞসু দৃষ্টিতে তাকায়।
“আপনি কি কিছুই করবেন না?” সোহাগী গলায় উষ্মা ঢেলে বলে।
“মানে?”
সোহাগী কোমরে হাত দিয়ে বলে, “মানে বোঝেন না?”
জগলুর ততোক্ষণে কান গরম হতে শুরু করেছে। সেদিকে দেখে সোহাগী খিল খিল করে হেসে বলে, “নেন, হইসে। আপনারে আর কিছু করতে হইব না। এতদিন যখন এতকিছু করতে পারছি তখন এইটুকুও করতে পারুম আমি। লন, পান খাইয়া বিদায় হন। সাবধানে যাইয়েন। রাস্তায় আজকে ভূতে ধরতে পারে।”
এইসবই তাহলে সোহাগীর কারবার! নিশ্চিত পানের মধ্যে সে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল। সেই আরক মেশানো পান খেয়েই রাতের বেলা তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল – রাতের বেলার সেই ভূত, কুকুর, সাপ সবই তাঁর উত্তপ্ত মনের কল্পনা। হয়তো সে গতকাল বাসায় ফিরে ঘুমের মধ্যেই এইসব দেখেছে। কিন্তু এতো স্পষ্ট ছিল সেই স্বপ্ন!
ভাবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জগলুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হইসে ভাই? শরীর খারাপ লাগতাছে তোমার?”
জগলুর মুখে একটা নির্মল হাসিফুটে ওঠে, “না ভাবী। আমি ঠিক আছি।“
ভাবী জগলুর মুখে হাসি দেখে নিশ্চিন্ত হয়। পাল্টা হাসি দিয়ে বলেন, “যাক, আমি তো চিন্তায় পইরা গেছিলাম। এইবার তাইলে বিছানা ছাইড়া উঠ। তোমার পোলারে নিয়া বাজার থেইকা একটু ঘুইরা আস।”
“পোলা?” জগলু বিস্ময় গোপন করতে পারে না।
ভাবী আবারো ঘুরে ওর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায়, “কি ব্যাপার তোমার কি মাথা নষ্ট হইয়া গেছে নাকি? পোলার কথা শুইনা এমনে চিল্লায় উঠলা ক্যান?”
ঠিক তখনই দরজা দিয়ে সোহাগী এসে ঘরে ঢুকল। মুখে হাসি, কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে। মুখ হা করে ওর দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা জগলুর কোলে বাচ্চাটাকে দিয়ে ভাবীকে সোহাগী বলে, “ভাবী আপনার ভাইকে আজকে ছাইড়া দেন। উনার আজকে মাথা ঠিক না। সারারাত মনে হয় অনেক ভয় পাইছে। ঠিকমতো ঘুম হয় নাই।” কথাটা শেষ করেই সোহাগী অদ্ভুত ভঙ্গীতে খিল খিল করে হেসে উঠে।
জগলুর কান দিয়ে তখন ধোঁয়া বের হচ্ছে। ঘটনাটা কি ঘটল সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ছে রাতের বেলা সে এশার আজানের পর দোকান থেকে বের হয়েছে। অথচ ভাবী বলছেন যে ও নাকি বাসায় ফিরেছেই এশার আজানের সময়। বেখাপ্পা একটা ব্যাপার হয়ে গেল এটা। একই সময় কি সে তাহলে দুই জায়গায় ছিল? নাকি তাঁর রূপ ধরে কোন জীন এসেছিল বাসায়? ব্যাপারটা অসম্ভব না।
আর রাতের সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলো কি তাহলে সে স্বপ্নে দেখেছিল? এও কি সম্ভব? এতো বাস্তব স্বপ্ন হতে পারে? এই তো সাপের ঠাণ্ডা লেজটা ধরার সময় তাঁর হাতটা কেমন যেন ভেজা ভেজা লাগছিল। সেই ব্যাপারটা এখনো সে অনুভব করতে পারছে। তাহলে?
কিন্তু ছেলে? তাঁর তো বিয়েই হয়নি। এই ছেলে আসল কোত্থেকে?
সব কিছু মিলিয়ে জগলু পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেল। চোখে রাজ্যের বিভ্রান্তি নিয়ে সে একবার তাঁর ভাবী, একবার তাঁর কোলের ছেলে আর সব সবশেষে সোহাগীর দিকে তাকাল। সোহাগীর চোখে মুখে তখন খুশীর একটা হাসি ঝলমল করছে যেন জগলুর এই অবস্থা দেখে সে খুব মজা পাচ্ছে। জগলুর মনে যে হাজারো প্রশ্ন এসে জড়ো হয়ে সেটা আন্দাজ করেই সেই হাসিটা যেন উছলে পড়লো। সোহাগী তাঁর মুখে সেই রহস্যময় হাসিটা মেখে, ঠোঁটে একটা আহ্লাদী ভাব নিয়ে বলল,
“সব কিছু তো আমিই করলাম। আপনি তো কেবল শুইয়া শুইয়া স্বপ্ন দেইখাই শেষ। যান এইবার পোলারে লইয়া বেড়ায় আসেন। মাথা ঠিক হইয়া যাইব।“
ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে ঘরের বাইরে সকালের মিষ্টি রোদে বের হয়ে এলো জগলু। ছেলেটা তাঁর কোলে বসেই জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি হইছে আব্বা? তোমারে এমন লাগতাছে ক্যান? আমারে নিয়ে বাজারে যাইবা না?”
শীতের সকাল। উঠোনে সকালের নরম রোদ খেলা করছে। খোঁয়াড় থেকে বের হয়ে একটা মুরগী তাঁর ছানাদের দিয়ে উঠোনময় ব্যাস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাত আটটা হাঁস তাঁর সামনে দিয়ে প্যাক প্যাক করতে করতে পুকুর ঘাটের দিকে গম্ভীর ভঙ্গীতে হেঁটে গেল। ঘরের বাইরে বেড়িয়ে নিজের সদ্যপ্রাপ্ত ছেলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জগলু। হ্যাঁ, ধীরে ধীরে তাঁর সব কিছু মনে পড়ছে। মনের ভেতর স্মৃতিগুলো যেন আস্তে আস্তে জন্ম নিচ্ছে। বিয়ে হয়েছিল তাঁর। সোহাগীর সাথেই। কিন্তু অনেক ঝড় ঝাপ্টা পেরিয়ে। করিম ব্যাপারীর কাছে সোহাগীর হাত চাইতে গিয়ে দারুণ অপদস্ত হতে হয়েছিল তাঁকে। লজ্জায় আর অপমানে মাথা নিচু করে চলে এসেছিল সে। বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থায় সেই রাতে দোকান থেকে বেড়িয়ে বাড়িতে ফেরার পথেই ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটেছিল তাঁর জীবনে। অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে মসজিদের সামনে খুঁজে পায় তাঁর বাড়ির লোকজন। ঘটনা শোনার পর সোহাগী তাঁর বাবাকে বাধ্য করে জগলুর সাথে তাঁর বিয়ে দিতে। হ্যাঁ, এই তো সব মনে পড়ছে তাঁর!
এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে ওর ভাবী গতরাতের চাদরটা হাতে নিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে বের হয়ে এলো। “তোমার চাদরে রক্তের দাগ ক্যান জগলু?”
জগলু ফ্যাল ফ্যাল করে সেদিকে একবার দেখল। তারপর সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পেছনে তাকাল। ভাবীর পেছনে, দরজার কাছে সোহাগী দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অদ্ভুত সুন্দর একটা হাসি।
১) একটি অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প
২) ফেরা
৩) জয়ানালের মধ্যরাতের কবিতা
৪) নিগূঢ় প্রতিবিম্ব
৫) পুনর্জাগরন
৬) একজন জাহেদা বেগম
৭)গল্পঃ আক্ষেপ
৮) পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রেমের গল্পটা
৯) শেষ পর্যন্ত
১০) কোন এক অনিয়ন্ত্রিত সকালে
১১) নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়