-কি বলছেন মশাই! দেশটা তাহলে পুরোপুরি গোল্লায় গেছে?
-তা আর বলতে!
-আরে না না, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে ভাই। এভাবে একটা দেশ রসাতলে ডুবে যেতে পারে না।
-বিশ্বাস না হলে আপনিই পরখ করে দেখুন! ঐ যে ... একটা রিকশা আসছে। ওকেই একবার যাচাই করে দেখুন। জিজ্ঞেস করে দেখুন এখান থেকে শেয়ালবাড়ির মোড় পর্যন্ত যেতে হলে ক’টাকা গোনা লাগবে। ভাড়া পনেরো টাকার এক পয়সা বেশী না। কিন্তু ও ঠিক পঁচিশ টাকা চেয়ে বসবে...
-বলেন কি! এ যে দিনে দুপুরে ডাকাতি!
-তাহলে আর কি বলছি!
-আচ্ছা, এতো করে যখন বলছেন, একবার জিজ্ঞেস করেই দেখি।
-যান।
ছাতাটা বগলে নিয়ে প্রসেনজিৎ সাহা উঠে দাঁড়ালেন। সকালে আজ বেশ মেঘ করেছিল। ছাতাটা বোধকরি সে কারনেই আনা। ভদ্রলোকের সাথে আমার এই তো খানিকক্ষণ আগেই পার্কে হাঁটতে এসে পরিচয়। বেশ লোক। ভদ্রলোকের বয়স পাথর আন্দাজ করা কঠিন। তবে ষাট পঁয়ষট্টির নিচে হবে না। কারণ এই অল্প পরিচয়েই জানতে পারলাম উনিও আমার মতোই রিটায়ারমেন্টে আছেন। অথচ কি চমৎকার স্বাস্থ্য। গায়ে একটা সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি আর পায়ে রবারের একটা চপ্পল পড়ে কি চমৎকার মচমচ করে হেঁটে যাচ্ছেন রিকশাওয়ালার দিকে। কি করতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে মনে কোন দ্বিধা নেই। যাকে বলে ক্লিয়ার কনসেপশন।
ভদ্রলোকের অবশ্য ডায়াবেটিকস আছে, আমার অবশ্য ডায়াবেটিকস এখনো ধরে নি। তবে জানালা দিয়ে প্রায়ই উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। ঝামেলা এড়ানোর জন্য সকাল বিকাল আজকাল পার্কে দৌড়াতে হয়। আমার আবার সেই ছোটবেলাকার একটা অভ্যাস আছে। অভ্যাস না বলে বোধহয় বদ-অভ্যাস বলাই ভালো। সাত সকালে কড়া লিকারের এককাপ চা না খেলে আমার চলে না। বাসায় বললে খুব কথা শুনতে হয়। এই বয়সে আর লোকজনের কথা শুনতে ভালো লাগে না।
পার্কে হাঁটতে আসি। এই পার্কেরই একটা ছোকরাকে ঠিক করে রেখেছি। সকালে আমি এলেই এক কাপ গরম চা আর সেদিনের পেপারটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে যায়। মাস শেষে আমিও ওকে আলাদা করে কিছু বখশিশ দিয়ে দেই। মামলা ডিসমিস।
-দাদা, আপনার কথা একদম ঠিক।
প্রসেনজিৎ সাহা ফিরে এসেছেন। বগলে সেই ছাতা। মুখটা লালচে। সম্ভবত রিকশাওয়ালার সাথে ঝামেলা পাকিয়ে এসেছেন।
আমি মৃদু হেসে বললাম,
-বিশ্বাস তো করলেন না।
-কি করে বিশ্বাস করি বলুন? এতো দিন ধরে এদেশে আছি, অথচ দেশটা এভাবে বর্বাদ হয়ে যাচ্ছে খেয়ালই করিনি।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, সবই সিস্টেমের দোষরে ভাই। কি আর করবেন!
-আরে রাখেন তো আপনার সিস্টেম! প্রসেনজিৎ সাহা প্রায় লাফিয়ে ওঠেন। ব্যস্তসমস্ত হয়ে আমার পাশে বসে পড়লেন। পার্কের নোনাধরা, শ্যাওলা মাখানো সিমেন্টের চেয়ারটা সেই তোড়ে খানিকটা কেঁপে উঠলো বোধ করি। বললেন,
-আমি আর আপনি মিলেই তো সিস্টেম নাকি বলেন?
-তা অবশ্য ঠিক। চা খাবেন?
ভদ্রলোক একটু বিভ্রান্ত হলেন,
-চা? বলছেন?
-আহা খেয়েই দেখুন না। এই জসিম...
নিমিষেই জসিম হাজির। এই হল পার্কের সেই ছোকরাটা। বাড়ি নোয়াখালী। খুব চটপটে।
-কিছু লাগবনি স্যার।
-দু কাপ চা দে। একটা চিনি ... আড় চোখে প্রসেনজিৎ সাহাকে একাবার দেখে নিলাম। বেচারা মনে হয় বহুদিন চিনি খান না। ভেতরটা যে চিনি দেয়া কড়কড়ে লিকারের এক কাপ চায়ের জন্য তড়পাচ্ছে সেটা বোঝাই যায়।
-...দু’কাপ চায়েই চিনি দিস, পরিমাণ মতো। বুঝলি?
জসিম কি বুঝল কে জানে! আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই উধাও।
প্রসেনজিৎ সাহেব খুশী হয়ে বললেন,
-চিনি ছাড়া চায়ে আসলে চা মনেই হয় না। মনে হয় ভাতের ফ্যান খাচ্ছি।
-ঠিক ধরেছেন। তা, কি যেন বলছিলেন...
-আরে ওই যে সিস্টেম না কি যেন।
-হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই।
-আহ! দাদা এই সিস্টেমের কথা আর বলবেন না। আমি-আপনি ঠিক থাকলে সব ঠিক।
-উহু হল না। ভুল বললেন। এই যে একটা সামান্য রিকসাওয়ালা বেশী পয়সা চেয়ে আপনাকে বোকা বানাতে চাইছিল, সে কি সিস্টেমের অংশ নয়?
-আরে দাদা, বললেই কি আর বোকা বানানো যায়! আমরা যদি সচেতন না থাকি তাহলে ওরা তো আমাদের বোকা বানাবেই। এটাই নিয়ম!
-তাই বলে মানুষের মধ্যে কোন মনুষ্যত্ব থাকবে না? ইচ্ছে হলেই লোক ঠকানো যাবে?
-না তা বলছি না। তবে, যে কিনা ইচ্ছে করে তার ঘরের সদর দরজা উদোম করে রাখে তার ঘরে তস্করের আনাগোনা হতে যে বেশী দেরী নেই সেটা আন্দাজ করাই যায়। এই জন্যই তো আমি লাখ টাকা খরচ করে নিজের বাড়িতে স্পেশাল সিকিউরিটি বসিয়েছি। আয় ব্যাটা তস্কর, কি করে তুই প্রসেনজিত সাহার বাড়িতে নাক গলাতে পারিস দেখব এবার! ঘরে একটা মাছি ঢুকতে হলেও পাখা ঝাড়া দিয়ে আসতে হবে। হে হে হে।
-বাসায় চুরি হয়েছিল নাকি?
-উফফ, সেকথা আর বলবেন না। কোথা থেকে সেদিন কি হয়ে গেল। গিন্নির সাড়ে পাঁচ ভরির স্বর্ণের হারটা বাসা থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেল।
-বলেন কি! , আমি আঁতকে উঠি এবার।
-আর বলছি সে কথা। আগে দু’চুমুক চা গলায় ঢেলে নেই।
চা এসে গেছে। জসিম সম্ভবত আমার জন্যই স্পেশাল কাপ আনিয়েছে। কাপগুলো ঝকঝকে পরিষ্কার। ছেলেটার রুচির প্রশংসা না করে পারা যায় না।
চা খেতে খেতে দাদা বাবু গল্প শুরু করলেন,
-ঠাঠারী বাজারে সাহা গোল্ড অ্যান্ড জুয়েলারি নামে আমার আটটা স্বর্ণের দোকান আছে ভাই। কিন্তু আমার গিন্নি কখনোই কোন স্বর্ণের হার পড়েন না। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, গিন্নির বয়স আমার চাইতে কম, তাই হয়তো আমার কাছে কিছু চাইতে লজ্জা পায়। সে কারনেই পূজা পার্বণে আমি নিজে থেকেই জোর করে তার হাতে এটা সেটা গুজে দেই। মেয়ে মানুষ বলে কথা। তার উপর বয়স অল্প। একটু সাজগোজ করতে তো চাইবেই।
গত পুজোয় আমি খুব শখ করে গিন্নিকে হারটা গড়িয়ে দিয়েছিলাম। তার যেন তেন হার নয় দাদা। পাকা বাইশ ক্যারটের খাঁটি সোনায় তৈরি সনাতনী হার। যে সে জিনিষ নয় সেটা!
হঠাৎ করেই সেটা চুরি হয়ে গেল! নেই তো নেই। সারা বারই তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। নাহ। একদম হাপিশ হয়ে গেছে দিনে দুপুরে।
হারটা চুরি যাবার পরই আমরা বাসাটাকে চারপাশ থেকে আটক করে ফেললাম যেন চোর বাসা থেকে বের হতে না পারে। আমি তো ধরেই নিয়েছি মালটা বাসা থেকে পাচার হয়ে গিয়েছে। তারপরও শেষ ভরসা হিসেবে যা যা করা লাগে আর কি!
বাসার সবাইকে, যাকে বলে চারটা কাজের লোক, বাবুর্চি, মালি আর কেয়ারটেকার সহ মোট সাতজন; সবাইকে নিচের হল ঘরে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু ঐ যে আপনি বলেছিলেন ভদ্রলোকের জামানা এখন আর নেই। আসলেই তাই। সাত চড়েও কারো মুখে কোন রা নেই। কেউ নাকি হারটা কস্মিনকালে দেখেই নি।
ঘটনা দেখেই আমি বুঝলাম সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। ডাকা হল পুলিশ। ওদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। পুলিশের আর যাই হোক এই সব ব্যাপারে বুদ্ধিশুদ্দি খুব ভালো। ওরা বাসায় এসেই কাজে নেমে গেল। সারা বাসা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। শেষমেশ সেই হারটা পাওয়া গেল ড্রেসিং রুমের জানালার কাছে। আর একটু হলেই পার হয়ে গিয়েছিল।
আমার আবার কি মনে হওয়াতে গিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম ওদিকে হারটা পড়ে গিয়েছিল কিনা। গিন্নি বলল সে নাকি গত এক সপ্তাহ হল ওদিকে কখনোই যায় নি। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ালো? চোর ঘরের মধ্যেই আছে। পুলিশ সে রাতেই মালি আর বাবুর্চিকে রেখে ঘরের চার চাকরকে ধরে দিয়ে গেল থানায়। শুনেছি যম ধোলাই দিয়েছে! কেয়ারটেকারকেও নিতে চেয়েছিল। আমি মানা করে দিলাম। এতো দিন ধরে আছে, একটা মায়া পড়ে গেছে।
এর পর আর দেরী করিনি, আমিও বাসায় সিকিউরিরিটি বসালাম।
-উফফ আর বলবেন না ভাই। আমার তো গায়ে কাটা দিচ্ছে। আমার বাসাতেও তো একই অবস্থা। কোন দিন যে কি হয়!
-এই ছোটলোকগুলোকে নিয়ে আর পারা গেল না।
-তা যা বলেছেন। এই আমার কথাই ধরুন। নিজের নামেই আমার গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি চালাই আমি। কায়সার গ্রুপের যে কয়টা ইন্ডাস্ট্রি আছে - কায়সার নীট ওয়্যার, কায়সার ফ্যাশন, কায়সার গার্মেন্টস আরও কি কি যেন সব মনেও থাকে না আজকাল। হঠাৎ করে রিসেশনের দোহাই দিয়ে, কিংবা হয়তো খামাখাই ধরেন আমার একটা চালান আটকে গেল। এখন আমি ভাই এই যে গার্মেন্টসে এতগুলো লোক কাজ করে তাদের বেতন দেই কিভাবে? আমাকে একটু সময় তো দিতে হবে, নাকি?
কিন্তু এই ছোটলোকগুলো এইসব কিসসু বুঝবে না। এরা জানে শুধু মারপিট করতে আর ঝগড়া করতে। সব বাটপার। আরে ব্যাটা, আমি যদি ইন্ডাস্ট্রি না বানাতাম তাহলে তো বস্তিতে বসে দিন রাত শুধু মাটি খেতি। তোদের জন্য যে টাকা রোজগারের ব্যাবস্থাটা আমি করে দিচ্ছি তার জন্য এই প্রতিদান দিবি আমাকে? অ্যাঁ?
-আর বলবেন না, এই ছোটলোকের জাতকে কোন বিশ্বাস নেই। আপনার কথাই ঠিক দেশটা রসাতলেই গেছে।
সকালের চিড়বিড়ানি রোদটা ওঠা শুরু করেছে। গরম লাগছে বেশ। ওঠা দরকার। প্রসেনজিৎ সাহেবও মনে হয় ওঠার পাঁয়তারা করছেন।
-দাদা, আজ তাহলে উঠি চলুন। রোডটা বেশ গায়ে লাগছে। বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নেয়া দরকার।
-আজ্ঞে, আমিও তাই ভাবছিলুম। তা, দাদা আপনি কোথায় থাকেন সেটাই তো জানা হল না।
পার্কের সদর দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল আমাদের মধ্যে।
-আমি থাকি এই তো কাছেই গুল-ই-শানের কায়সার প্যালেসে। আপনি?
-আমি থাকি ভাই গরীবের আড্ডায়। বৃষ্টিধারার ছোট সাহা কটেজে। ভাবি আর ছেলে মেয়েদের নিয়ে আসবেন একদিন।
-বেঁচে থাকলে আসবো অবশ্যই।
আমাদের যার যার গাড়ি চলে এসেছে। সাহা সাহেবের সাদা মিতসুবিশি পাজেরোর পাশেই আমার কালো মার্সিডিজ দাঁড়ানো। ভদ্রলোকের যে সম্ভ্রান্ত সেটা বোঝাই যায়। তাছাড়া বেশ রসিক লোক। দেশ সম্পর্কেও অনেক ভাবে সেটা তার কথা শুনেই বুঝলাম। তাছাড়া এমন নরম মনের মানুষ পাওয়াই যায় না। যাক, আমার সাদামাটা পার্কের হাঁটাহাঁটির দিন বোধহয় শেষ হয়ে এলো। সাহা সাহেবের সাথে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আগামীকাল জম্পেশ আড্ডা দেয়া যাবে। ভালোই হল।
আমি আর প্রসেনজিৎ সাহেব হাত মিলিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবো এমন সময় জসীম পার্কের ভেতর থেকে দৌড়ে এলো।
-স্যার স্যার! দাঁড়ান!
আমরা দুজনই একসাথে ঘুরে দাঁড়ালাম ব্যাপারটা বোঝার জন্য।
-কিরে, কি হয়েছে?
-স্যার আপনার মানিব্যাগ পইড়া গেছিল।
আমি আর প্রসেনজিত অবাক হয়ে একবার জসীম, তার হাতের মানিব্যাগ আর একে অন্যের দিকে তাকালাম।
কোথায় যেন একটা বিশ্রী কাক ডেকে উঠলো কা-কা করে।
নাকি হাসল আমাদের দেখে?
বুঝলাম না।
===========================================
আমার অন্যান্য লেখাঃ
১) একটি অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প
২) ফেরা
৩) জয়ানালের মধ্যরাতের কবিতা
৪) নিগূঢ় প্রতিবিম্ব
৫) পুনর্জাগরন
৬) একজন জাহেদা বেগম
৭)গল্পঃ আক্ষেপ
৮) পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রেমের গল্পটা
৯) শেষ পর্যন্ত
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৮