(১)
আমেরিকার ওহাইও ষ্টেটের স্প্রিংফিল্ড নামে ছোট্ট একটা শহরে থাকেন জাহেদা বেগম। শহরটা আমেরিকার অন্য পাঁচটা শহরের মতোই একদম সাজানো গোছানো ছবির মতো, এদেশের ভাষায় যাকে বলা হয় “আমেরিকান ড্রিম সিটি”, স্বপ্নের শহর। বলার কারণও আছে। এরা তাদের শহর সাজিয়েছেও স্বপ্নের মতো করে। কোথাও এক টুকরো ময়লা আবর্জনা নেই, সব ঝকঝকে তকতকে। মূল রাস্তার পাশে আছে চওড়া ফুটপাথ। ফুটপাথ ঘেঁসে উঁচু উঁচু ওক গাছ রাস্তার ওপর ছায়া হয়ে আছে।
শীতের শেষে যখন গাছের পাতা ঝরতে থাকে তখন বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়ে হাঁটলে সত্যি সত্যি স্বপ্নের মতো মনে হয়। ফুটপাথের পাশেই পরপর দোতালা তিনতালা দোচালা, চৌচালা বাড়ি, সব গুলোই কাঠ দিয়ে বানানো। অনেকটা বাগান বাড়ির আদলে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে আছে চমৎকার করে সাজানো বাগান, তারপর ঘাসে ঢাকা সবুজ লন। সেই লনের মাঝ দিয়ে বাড়ির ভেতর চলে যাওয়া যায়। বাগানগুলোতে যত্নের ছাপ স্পষ্ট, এমনকি লনের ঘাসগুলোতেও কোন ধুলো বালি লেগে নেই।
সকাল না হতেই ছেলে,বুড়ো, এমনকি মেয়েরা জগিং করতে বেরিয়ে যায়। জগিং শেষে সময় মতো বাসায় ফিরে সবাই যার যার কাজে চলে যায়। স্কুলের হলুদ বাসটা এসে সকাল সকাল বাচ্চাদের নিয়ে চলে যায়। এখানে সব কিছুই রুটিন বাঁধা, ছন্দবদ্ধ। বিকেলে সব কয়টা বাচ্চা হইহই করতে করতে রাস্তায় নেমে আসে। সারাটা বিকেল যেন সামনের রাস্তাটায় মেলা বসে থাকে। বারান্দায় বসে এসব দেখতে জাহেদা বেগমের বড় ভালো লাগে।
হাতের তসবিটা গুনতে গুনতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। এলিনা আসার কথা সকাল আটটায়। ওর জন্যই অপেক্ষা করছেন তিনি। শরীরটা ভালো নেই বলে আজ আর বারান্দায় বসেননি। ড্রয়িং রুমেই পর্দা টানিয়ে অন্ধকার করে বসে আছেন। জেল ডিভিশনের স্টাফ, লেফটেন্যান্ট এলিনা তাকে নিয়ে যাবে নর্থ ফাউন্টেইন অ্যাভিনিউ, কাউন্টি শেরিফের অফিসে। সেখানে তার ছেলে শুভ্র অপেক্ষা করছে তার জন্য।
আটটা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে ঘরের বাইরে হর্নের আওয়াজ পাওয়া গেল। জাহেদা রেডি হয়েই বসে ছিলেন। আজ তিনি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়েছেন। নামাজ শেষ করার পর তার মনে হল ইবাদতে আজ তিনি ফাঁকি দিয়েছেন। নামাজ আদায় হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার মন পড়েছিল ছিল অন্যখানে। হর্নের শব্দ শুনে তিনি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এলিনাই হবে। এরা কিভাবে এতো সময়নিষ্ঠ হয় কে জানে? এজন্যই এরা এতো উন্নতি করেছে।
দরজায় তালা লাগিয়ে ঘরের বাইরে এসে সূর্যের আলোতে জাহেদা বেগমের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। চোখ ছোট করে তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন প্রখর রোদের সাথে তার দৃষ্টিকে মানিয়ে নিতে। খানিকক্ষণ পর দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এলে চারপাশে তাকিয়ে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সকাল সকাল ঝকঝকে রোদ উঠেছে। ঘরের সামনে অত্যন্ত যত্ন করে সাজানো বাগানে সেই আলো যেন ঠিকরে পড়ছে। দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। জাহেদা বেগম সেদিকে তাকিয়ে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এদেশে সব কিছুই সুন্দর লাগে তার কাছে। কিন্তু সুন্দরের মাঝেই তার ঘরে বাসা বেঁধেছে অসুন্দর।
(২)
পনের বছর আগে তার একমাত্র ছেলে শুভ্রর হাত ধরে আমেরিকায় আসেন তিনি। সেও এক অবাক করা ঘটনা। তারা তখন থাকতেন ঝিগাতলার দু’রুমের ছোট্ট একটা বাসায়। শুভ্র মাত্র কলেজ পাশ করেছে। একদিন বাসায় তিনি রান্না করছেন, এমন সময় শুভ্র তার সামনে এসে কিছু একটা বলার জন্য ইতস্তত করছিল। ছেলের দিকে না তাকিয়েই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে কিছু বলবি?”
“মা, আমি একটা স্কলারশিপ পেয়েছি।”
জাহেদা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এটা তো ভালো খবর! এমন চোরের মতো মুখ করে রেখেছিস কেন?”
“মা, এটা আমেরিকান একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ। স্কলারশিপ্টা পেতে হলে আমাকে ওখানে যেতে হবে।”
জাহেদা চুপ করে গেলেন। তারপর কি ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, “ওরা কি প্লেনের ভাড়া দেবে না?”
শুভ্র কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেলল, যেন কোন অপরাধ করে ফেলেছে।
জাহেদা অন্যমনস্ক হয়ে পেতলের খুন্তি দিয়ে খামাখাই কড়াইতে তরকারি নাড়তে লাগলেন। ছেলে বলে কি? ও একা একা আমেরিকা যাবে কিভাবে? আর এতো টাকাই বা সে পাবে কোথায়?
শুভ্র মাথা নিচু করেই জিজ্ঞেস করল, “মা, তুমি কি শুধু প্লেনের টাকাটা দিতে পরবে?”
জাহেদা সেদিন ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নি। শুভ্রও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের কাজে চলে গেছে। তিনি তারপর দু’দিন ভাবলেন। শুধু বললেই তো হল না প্লেনের টাকা দিলেই হবে। একটা কিছু ব্যাবস্থা হবার আগে, কিছুদিন চলার জন্য সামান্য হলেও কিছু টাকাও প্রয়োজন। বিদেশে কত রকম বিপদ আপদ হতে পারে। হিসেব করে তিনি যা বুঝলেন তাতে প্রায় লাখ পাঁচেক টাকা দরকার। সেটা একরকম অসম্ভবই বলা যায়। কিভাবে কি করা যায় ভাবতে ভাবতে তিনি প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন। পরামর্শ করবেন এমন কেউই নেই। শুভ্রর বাবা মোকাম্মেল সাহেব সংসারের এতো মার প্যাঁচ বোঝেন না। মাস শেষে সরকারি চাকরীর বেতনের কয়টা টাকা তার হাতে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। তার সাথে পরামর্শ করা আর গাছের সাথে কথা বলা একই কথা।
সংসারে বহু টানাটানি ছিল। তা সত্ত্বেও জমিজমা, গয়না পত্র বিক্রি করে, বহু ধার দেনা করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে তিনি অসাধ্য সাধন করেছিলেন। সেজন্য মনে মনে একটা আত্মতুষ্টি আছে তার। আর তার ছেলেও সেই প্রতিদান দিয়েছে তাকে। নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সংসারের অভাব দূর করেছে। সুযোগ মতো মা কে সাথে করে নিয়ে গেছে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। মোকাম্মেল সাহেবের কপাল খারাপ, ছেলে প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই তিনি গত হয়েছেন।
প্রথম প্রথম এখানে তার খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই তিনি চমৎকার মানিয়ে নেন। দেশের কথা এক সময় প্রায় ভুলেই গেলেন। তাছাড়া এখানে আশার পর ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনের সাথেও তেমন একটা যোগাযোগ থাকেনি। দেশের প্রতি টানটা এ কারনেই হয়তো ফিকে হয়ে এসেছিল তার। ফলে দেশে আর ফেরা হয়ে ওঠেনি, ইচ্ছাও করেনি।
প্রায় দু’বছর আগের কথা। সেদিন ছিল শুভ্র আর তন্নির বিবাহ বার্ষিকী। সে উপলক্ষ্যে তিনি ভাবছিলেন আজ নিজেই রাঁধবেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রসারি সপে গিয়েছিলেন মুরগির মাংস,তরকারী আর সালাদ কিনে আনতে। কপাল খারাপ শুঁটকি মাছ পাওয়া গেল না। শুভ্র শুঁটকি মাছ খুব পছন্দ করে। খাওয়ার সময় শুঁটকির ঝালে ওর ফর্শা মুখ লাল হয়ে যাবে, নাক দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরতে থাকবে। কিন্তু খাওয়া থামবে না। নাকের কাছে একটা ন্যাপকিন ধরে রেখে সে খাওয়া চালিয়ে যাবে আর “উহ” “আহ” জাতীয় শব্দ করতে থাকবে। খাওয়া শেষে শুভ্রর চেহারা দেখে মনে হবে যেন কোথা থেকে মারামারি-ধস্তাধস্তি করে এসেছে। মাথার চুল এলোমেলো, চোখ মুখ লাল। মায়ের দিকে ভুবনভোলানো একটা হাসি দিয়ে বলবে, “মা, আজ একটু বেশী খেয়ে ফেললাম। শুটকিটা যা মজা হয়েছিল না!”
প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে ছেলের আহ্লাদের কথা ভাবছিলেন তিনি। লনটা পেরিয়ে সদর দরজার কাছে এসেছেন, এমন সময় তিনি একটা গুলির আওয়াজ পেলেন। এতো কাছ থেকে গুলির আওয়াজ হল যে তার হাত থেকে প্যাকেটগুলো ছিটকে পড়ে গেল।
দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন তিনি। বসার ঘরে শুভ্র হতভম্ব হয়ে বসে আছে। হাতে একটা চকচকে পিস্তল। ওর সামনে মেঝেতে, তন্নি কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। রক্তে সারা ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে।
জাহেদা চিৎকার করে বললেন,
“শুভ্র! কি হয়েছে বাবা? তোর হাতে পিস্তল কেন?”
“আমি ওকে মেরে ফেলেছি মা।”
“কি বলছিস তুই এসব?”
“হ্যাঁ মা। সব শেষ।”
শুভ্র মায়ের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় বলল, “মা, এটা আমি কি করলাম?”
তারপর ঘরটার ভেতর যেন সময় থেমে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ এলো, তাদের জেরা করলো, ছবি তুললো। তারপর শুভ্রকে হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে গেল। সব কিছুই এতো দ্রুত হল যে তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি জেগে আছেন না দুঃস্বপ্ন দেখছেন।
সবাই একসময় চলে গেল। তিনি একা রয়ে গেলেন।
পরবর্তী সময়টা আরও দ্রুত আর অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে পার হল। ট্রায়ালে জানা গেল জাহেদা বাইরে যাবার পর, সামান্য ঘটনাকে নিয়ে তন্নি আর শুভ্রর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। ঝগড়াঝাঁটির এক পর্যায়ে শুভ্র রাগ সামলাতে না পেরে তন্নিকে গুলি করে বসে। বিচার প্রক্রিয়া শেষে মিউনিসিপাল কোর্টে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের অভিযোগে শুভ্রকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে এতো বড় অপরাধ ঘটানোর কারনে জুরীরাও শুভ্রর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্যারোলে মুক্তির সম্ভাবনা নাকচ করে, শাস্তি বহাল রাখা হয়।
(৩)
“আর ইউ অল রাইট?” ভুরু কুঁচকে এলিনা তাকে জিজ্ঞেস করে। মাথা ঝাঁকিয়ে জাহেদা জানায় সে ঠিক আছে। এলিনা তাকে একবার দেখে ঘাড় ঝাঁকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।
গতকাল রাতে এলিনা তাকে ফোন করেছিল একটা খবর দিতে। রাতে খাওয়ার পর শুভ্র গলায় বেডশিট পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সকালে সে তাকে কাউন্টি শেরিফের অফিসে নিয়ে যাবে। শুভ্রর মরদেহ সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করেছে।
প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে শীত বিদায় নিচ্ছে। স্প্রিংফিল্ডের ওকগাছগুলোর পাতাগুলো ঝরতে শুরু করেছে। জাহেদা অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে দেখলেন। তারকাছে মনে হল তিনি সত্যি সত্যিই স্বপ্ন দেখছেন।