আগের পর্ব ...
নূহের প্লাবন ও গযবের কুরআনী বিবরণ :
এ বিষয়ে সূরা হূদে পরপর ১২টি আয়াত নাযিল হয়েছে। যেমন, চূড়ান্ত গযব আসার পূর্বে আল্লাহ নূহ (আ.)-কে বললেন, ‘তুমি আমার সম্মুখে আমারই নির্দেশনা মোতাবেক একটা নৌকা তৈরী কর এবং (স্বজাতির প্রতি দয়া পরবশ হয়ে) যালেমদের ব্যাপারে আমাকে কোন কথা বলো না। অবশ্যই ওরা ডুবে মরবে’ {হূদ ১১/৩৭}। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর নূহ নৌকা তৈরী শুরু করল। তার কওমের নেতারা যখন পাশ দিয়ে যেত, তখন তারা তাকে বিদ্রুপ করত। নূহ তাদের বলল, তোমরা যদি আমাদের উপহাস করে থাক, তবে জেনে রেখো তোমরা যেমন আমাদের উপহাস করছ, আমরাও তেমনি তোমাদের উপহাস করছি’ {৩৮}। ‘অচিরেই তোমরা জানতে পারবে লাঞ্ছনাকর আযাব কাদের উপরে আসে এবং কাদের উপরে নেমে আসে চিরস্থায়ী গযব’ {৩৯}। আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে গেল এবং চুলা উদ্বেলিত হয়ে উঠল, (অর্থাৎ রান্নার চুলা হ’তে পানি উথলে উঠলো), তখন আমি বললাম, সর্বপ্রকার জোড়ার দু’টি করে এবং যাদের উপরে পূর্বেই হুকুম নির্ধারিত হয়ে গেছে, তাদের বাদ দিয়ে তোমার পরিবারবর্গ ও সকল ঈমানদারগণকে নৌকায় তুলে নাও। বলা বাহুল্য, অতি অল্প সংখ্যক লোকই তার সাথে ঈমান এনেছিল’ {৪০}। ‘নূহ তাঁদের বলল, তোমরা এতে আরোহণ কর। আল্লাহর নামেই এর গতি ও স্থিতি। নিশ্চয়ই আমার প্রভু অতীব ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ {৪১}। ‘অতঃপর নৌকাখানি তাদের বহন করে নিয়ে চলল পর্বতপ্রমাণ তরঙ্গমালার মাঝ দিয়ে। এ সময় নূহ তার পুত্রকে (ইয়ামকে) ডাক দিল- যখন সে দূরে ছিল, হে বৎস! আমাদের সাথে আরোহণ কর, কাফেরদের সাথে থেকো না’ {৪২}। ‘সে বলল, অচিরেই আমি কোন পাহাড়ে আশ্রয় নেব। যা আমাকে প্লাবনের পানি হ’তে রক্ষা করবে’। নূহ বলল, ‘আজকের দিনে আল্লাহর হুকুম থেকে কারু রক্ষা নেই, একমাত্র তিনি যাকে দয়া করবেন সে ব্যতীত। এমন সময় পিতা-পুত্র উভয়ের মাঝে বড় একটা ঢেউ এসে আড়াল করল এবং সে ডুবে গেল’ {৪৩}। অতঃপর নির্দেশ দেওয়া হ’ল, হে পৃথিবী! তোমার পানি গিলে ফেল (অর্থাৎ হে প্লাবনের পানি! নেমে যাও)। হে আকাশ! ক্ষান্ত হও (অর্থাৎ তোমার বিরামহীন বৃষ্টি বন্ধ কর)। অতঃপর পানি হরাস পেল ও গযব শেষ হ’ল। ওদিকে জূদী পাহাড়ে গিয়ে নৌকা ভিড়ল এবং ঘোষণা করা হ’ল, যালেমরা নিপাত যাও’ {৪৪}। ‘এ সময় নূহ তার প্রভুকে ডেকে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার পুত্র তো আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, আর তোমার ওয়াদাও নিঃসন্দেহে সত্য, আর তুমিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফায়ছালাকারী {৪৫}। ‘আল্লাহ বললেন, হে নূহ! নিশ্চয়ই সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চয়ই সে দুরাচার। তুমি আমার নিকটে এমন বিষয়ে আবেদন কর না, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি যেন জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ {৪৬}। ‘নূহ বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমার অজানা বিষয়ে আবেদন করা হ’তে আমি তোমার নিকটে পানাহ চাচ্ছি। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না কর ও অনুগ্রহ না কর, তাহ’লে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ {৪৭}। ‘বলা হ’ল, হে নূহ! এখন (নৌকা থেকে) অবতরণ কর আমাদের পক্ষ হ’তে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি সহকারে তোমার উপর ও তোমার সঙ্গী দলগুলির উপর এবং সেই (ভবিষ্যৎ) সম্প্রদায়গুলির উপর- যাদেরকে আমরা সত্বর সম্পদরাজি দান করব। অতঃপর তাদের উপরে আমাদের পক্ষ হ’তে মর্মান্তিক আযাব স্পর্শ করবে’ {হূদ ১১/৩৭-৪৮}।
মাক্কী জীবনের চরম আতংক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে সূরা হূদ নাযিল করে সেখানে যথাক্রমে নূহ, হূদ, ছালেহ, ইব্রাহীম, লূত, শু‘আয়েব ও মূসা প্রমুখ বিগত নবী ও রাসূলগণের ও তাদের সম্প্রদায়ের কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছা.) ও তাঁর সাথীদেরকে আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়েছেন। যেমন প্রথমে নূহ (আ.)-এর কাহিনী বর্ণনা শেষে আল্লাহ বলেন, ‘এটি গায়েবের খবর যা আমরা আপনার নিকটে অহী করেছি। যা ইতিপূর্বে আপনি বা আপনার সম্প্রদায় জানতো না। অতএব আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। নিশ্চয়ই শুভ পরিণাম কেবল আল্লাহভীরুদের জন্যই’ {হূদ ১১/৪৯}। বস্তুতঃ কুরআনের মাধ্যমেই পৃথিবীবাসী সর্বপ্রথম বিগত যুগের এই সব ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির খবর জানতে পেরেছে।
অন্যান্য বিবরণ :
সূরা হূদে বর্ণিত উপরোক্ত আয়াত সমূহে নূহ (আ.)-এর প্লাবনের নাতিদীর্ঘ ঘটনা বিবৃত হয়েছে। কুরআন তার বাকরীতি অনুযায়ী কেবল প্রয়োজনীয় কথাগুলিই বলে দিয়েছে। বাদবাকী ব্যাখ্যা সমূহ মোটামুটি নিম্নরূপঃ
(১) কিশতী : নূহ (আ.)-কে যখন নৌকা তৈরীর নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন তিনি নৌকাও চিনতেন না, তৈরী করতেও জানতেন না। আর সেকারণেই আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, ‘তুমি নৌকা তৈরী কর আমাদের চোখের সম্মুখে ও আমাদের অহী অনুসারে’ {হূদ ১১/৩৭; মুমিনূন ২৩/২৭}। এর দ্বারা বুঝা যায়. যে, নৌকা তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সমূহ ও নির্মাণ কৌশল জিবরীল (আ.) নূহ (আ.)-কে শিক্ষা দিয়েছিলেন। এভাবে সরাসরি অহীর মাধ্যমে নূহ (আ.)-এর হাতে নৌকা ও জাহায নির্মাণ শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। অতঃপর যুগে যুগে তার উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের মালামাল ও যাত্রী পরিবহনে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। আধুনিক বিশ্ব সভ্যতা যার উপরে দাঁড়িয়ে আছে।
একথা ধারণা করা মোটেই অমূলক হবে না যে, উক্ত নৌকা তৈরী করতে নূহ (আ.)-এর বহুদিন সময় লেগেছিল। নৌকাটি অবশ্যই বিরাটায়তনের ছিল। যাতে মানুষ, পশু ও পাখি পৃথকভাবে থাকতে পারে। কিন্তু এজন্য নৌকাটি কয় তলা বিশিষ্ট ছিল, কি কাঠের ছিল, কত গজ লম্বা ও চওড়া ছিল, এসব কাহিনীর কোন সঠিক ভিত্তি নেই। নদীবিহীন মরু এলাকায় বিনা কারণে নৌকা তৈরী করাকে পশুশ্রম ও নিছক পাগলামি বলে ‘কওমের নেতারা নূহ (আ.)-কে ঠাট্টা করত’ {হূদ ৩৮}। এ ব্যাপারে নূহ (আ.) বলতেন, তোমাদের ঠাট্টার জবাব সত্বর তোমরা জানতে পারবে {হূদ ৩৯}। দীর্ঘ দিন ধরে নৌকা তৈরী শেষ হবার পরেই আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়ছালা নেমে আসে এবং গযবের প্রাথমিক আলামত হিসাবে চুলা থেকে পানি বের হ’তে থাকে।
(২) তান্নূর ও তূফান : ‘তান্নূর’ বলা হয় মূলতঃ উনুন বা চুলাকে। এটি অনারব শব্দ, যাকে আরবী করা হয়েছে (কুরতুবী)। সহজ-সরল ও প্রকাশ্য অর্থ অনুযায়ী ইরাকের মূছেল নগরীতে অবস্থিত নূহ (আ.)-এর পারিবারিক চুলা থেকে পানি উথলে বের হওয়ার আলামতের মাধ্যমেই নূহের তুফানের সূচনা হয়। অর্থাৎ এটি ছিল প্লাবনের প্রাথমিক আলামত মাত্র (কুরতুবী)। ‘তূফান’ অর্থ যেকোন বস্তুর অত্যাধিক্য। প্লাবনকে ‘তূফান’ বলা হয় পানির আধিক্যের কারণে, যা সব কিছুকে ডুবিয়ে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা নূহকে প্রেরণ করেছিলাম তার সম্প্রদায়ের নিকট। সে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম এক হাযার বছর অবস্থান করেছিল। অতঃপর তাদেরকে ‘তূফান’ (অর্থাৎ মহাপ্লাবন) গ্রাস করেছিল। আর তারা ছিল অত্যাচারী {আনকাবূত ২৯/১৪}। যদিও অনেকে এর নানারূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যার সবকিছুই ইস্রাঈলিয়াত এবং ভিত্তিহীন।*১৬*
ভূতলের উত্থিত পানি ছাড়াও তার সাথে যুক্ত হয়েছিল অবিরাম ধারে আকাশবন্যা। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছল এবং চুলা উচ্ছ্বসিত হ’ল (অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ পানিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠল)-{হূদ ৪০}। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তখন আমরা খুলে দিলাম আকাশের দুয়ার সমূহ প্রবল বারিপাতের মাধ্যমে’। ‘এবং ভূমি থেকে প্রবাহিত করলাম নদী সমূহকে। অতঃপর উভয় পানি মিলিত হ’ল একটি পূর্ব নির্ধারিত কাজে (অর্থাৎ ডুবিয়ে মারার কাজে)’। ‘আমি নূহকে আরোহন করালাম এক কাষ্ঠ ও পেরেক নির্মিত জলযানে’। ‘যা চলত আমার দৃষ্টির সম্মুখে। এটা তার (অর্থাৎ আল্লাহর) পক্ষ থেকে প্রতিশোধ ছিল, যাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল’। ‘আমরা একে নিদর্শন হিসাবে রেখে দিয়েছি। অতএব কোন চিন্তাশীল আছে কি’? {ক্বামার ৫৪/১১-১৫}। যে কারণে নূহ-পুত্র ‘ইয়াম’ পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েও রেহাই পায়নি {হূদ ৪৩}। ঐ সময় কোন কোন ঢেউ পাহাড়ের চূড়া হ’তেও উঁচু ছিল। অতঃপর প্লাবন বিধ্বংসীরূপ ধারণ করে এবং পাহাড়ের মত ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে নৌকা চলতে থাকে’ {হূদ ৪২}।
২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সাগরতলে সংঘটিত ভূমিকম্পের সুনামিতে উত্থিত ৩৩ ফুট উঁচু ঢেউ নূহের তূফানকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
নৌকার আরোহীগণ :
তূফানের আলামত প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে নূহ (আ.)-কে হুকুম দেওয়া হ’ল, ‘জোড় বিশিষ্ট প্রত্যেক প্রাণীর এক এক জোড়া করে নৌকায় তুলে নাও’ {হূদ ১১/৪০; মুমিনূন ২৩/২৭}। এর দ্বারা কেবল ঐসব প্রাণী বুঝানো হয়েছে, যা নর ও মাদীর মিলনে জন্মলাভ করে এবং যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অতীব প্রয়োজনীয়। যেমন গরু-ছাগল, ঘোড়া-গাধা ও হাঁস-মুরগী ইত্যাদি পশু-পক্ষী।
এরপর নূহ (আ.)-কে নির্দেশ দেওয়া হয় কেবল তাঁর পরিবারসহ ঈমানদার নর-নারীকে নৌকায় তুলে নিতে। যাদের সংখ্যা অতীব নগণ্য ছিল {হূদ ৪০}। কিন্তু সঠিক সংখ্যা কুরআন বা হাদীছে উল্লেখিত হয়নি। তবে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের সংখ্যা ছিল চল্লিশ জন করে পুরুষ ও নারী মোট আশি জন। প্লাবনের পর তারা ইরাকের মূছেল নগরীর যে স্থানটিতে বসতি স্থাপন করেন, তা ‘ছামানূন’ বা আশি নামে খ্যাত হয়ে যায়।*১৭* প্লাবনে মুক্তিপ্রাপ্তদের ‘সূমর’ জাতি বলা হ’ত। ‘জূদী’ পাহাড়ে গিয়ে নৌকা নোঙর করে {হূদ ১১/৪৪}। এ পাহাড়টি আজও ঐ নামেই পরিচিত। এটি নূহ (আ.)-এর মূল আবাস ভূমি ইরাকের মূছেল নগরীর উত্তরে ‘ইবনে ওমর’ দ্বীপের অদূরে আর্মেনিয়া সীমান্তে অবস্থিত। বস্তুতঃ এটি একটি পবর্তমালার অংশ বিশেষের নাম। এর অপর এক অংশের নাম ‘আরারাত’ পর্বত। প্রাচীন ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে যে, ইরাকের বিভিন্ন স্থানে উক্ত কিশতীর ভগ্ন টুকরা সমূহ অনেকের কাছে সংরক্ষিত আছে। যা বরকত মনে করা হয় এবং বিভিন্ন রোগ-ব্যধিতে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।
উল্লেখ্য যে, নূহের পুত্র কাফিরদের দলভুক্ত হওয়ায় মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু নূহের স্ত্রী সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয়নি। এতে স্পষ্ট হয় যে, তিনি আগেই মারা গিয়েছিলেন {ইবনু কাছীর, হূদ ১১/৪০}। তিনি গোপনে কুফরী পোষণ করতেন ও কাফিরদের সমর্থন করতেন। নূহের স্ত্রী ও লূত্বের স্ত্রী স্ব স্ব স্বামীর নবুঅতের উপরে বিশ্বাস স্থাপনের ক্ষেত্রে খেয়ানত করেছিল বলে স্বয়ং আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। নবীদের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কুফরীর কারণে তারা জাহান্নামবাসী হয়েছেন {তাহরীম ৬৬/১০}। সম্ভবতঃ মহাপ্লাবনের সময় নূহের স্ত্রী জীবিত ছিলেন না। সেকারণ গযবের ঘটনা বর্ণনায় কেবল পুত্র ইয়ামের কথা এসেছে। কিন্তু তার মায়ের কথা আসেনি।
নূহ (আ.)-এর জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :
১. প্রথম রাসূল নূহ (আ.)-এর সত্যতার বিরুদ্ধে যে পাঁচটি আপত্তি তোলা হয়েছিল, সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদ (ছা.)-এর সত্যতার বিরুদ্ধেও ঐ অভিযোগগুলি তোলা হয়েছিল। শেষনবীর প্রকৃত দ্বীনী উত্তরাধিকারী হিসাবে সমাজ সংস্কারক মুত্তাক্বী আলেমগণের উপরে নবুঅতের বিষয়টি বাদে বাকী চারটি অভিযোগ যুগে যুগে উত্থাপিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
২. নূহ (আ.) যেমন দীর্ঘকাল যাবত নিজ জাতির পক্ষ হ’তে অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করা সত্ত্বেও তাদের হেদায়াতের ব্যাপারে নিরাশ হ’তেন না, প্রকৃত সমাজ হিতৈষী আলেম ও নেতাগণেরও তেমনি নিরাশ হওয়া উচিত নয়।
৩. নবী পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ঈমান না থাকার কারণে নূহের স্ত্রী ও পুত্র যেমন নাজাত লাভে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি এ যুগেও হওয়া সম্ভব। কাফির ও মুশরিক সন্তান বা কোন নিকটাত্মীয়ের মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করা জায়েয নয়।
৪. ঈমানী সম্পদই বড় সম্পদ। আল্লাহর নিকটে ঈমানদারের মর্যাদা সর্বপেক্ষা বেশী। যদিও সে দুনিয়াবী জীবনে দীনহীন গরীব হয়।
৫. ঈমানহীন সমাজ নেতা ও ধনী লোকদের খুশী করার জন্য ঈমানদার গরীবদের দূরে সরিয়ে দেওয়া যাবে না।
৬. মৃত নেককার মানুষের অসীলায় পরকালে মুক্তি পাওয়ার ধারণার ভিত্তিতে সৃষ্ট মূর্তিপূজার শিরক বিশ্ব ইতিহাসের প্রাচীনতম শিরক। এই শিরকের কারণেই নূহের কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়েছিল। তাই যাবতীয় প্রকারের শিরক থেকে তওবা করা কর্তব্য। সাথে সাথে এই মহাপাপ থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য আলেমদের এবং সমাজ ও রাষ্ট্র নেতাদের এগিয়ে আসা যরূরী।
৭. সমাজ নেতাদের পথভ্রষ্টতার কারণেই দেশে আল্লাহর গযব নেমে আসে। অতএব তাদেরকেই সবার আগে হুঁশিয়ার হওয়া কর্তব্য।
৮. বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করার সাথে সাথে সাধ্যমত বাস্তব প্রচেষ্টা চালাতে হয়। যেমন নূহ (আ.) প্রথমে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেন। অতঃপর গযব থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর হুকুমে নৌকা তৈরী করেন।
৯. আল্লাহ পাক স্বীয় অহী দ্বারা বিভিন্ন নবীর মাধ্যমে যুগে যুগে বিভিন্ন শিল্পকর্মের সূচনা করেছেন, যেমন আদম (আ.)-এর মাধ্যমে কৃষিকর্ম ও চাকার প্রচলন করেছেন এবং নূহ (আ.)-এর মাধ্যমে জাহায শিল্পের সূচনা করেছেন।
১০. দুনিয়াবী জৌলুস সত্ত্বেও যালেমরা সর্বযুগেই নিন্দিত ও ধিকৃত হয়। পক্ষান্তরে নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও ঈমানদারগণ সর্বযুগে নন্দিত ও প্রশংসিত হন।
১১. কিসে মানুষের প্রকৃত মঙ্গল নিহিত রয়েছে, মানুষ নিজে তা নির্ণয় করতে পারে না। তাকে সর্বদা আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। তাই ‘আল্লাহর অহি’ তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের হেদায়াতই প্রকৃত হেদায়াত এবং চূড়ান্ত সত্যের মাপকাঠি।
১২. পূর্বতন সকল নবীর দাওয়াত ছিল এক ও অভিন্ন এবং তা ছিল নির্ভেজাল তাওহীদের প্রতি দাওয়াত। মানুষের সার্বিক জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠাই হ’ল প্রকৃত অর্থে ইক্বামতে দ্বীন।
১৩. আল্লাহ স্বীয় নেককার বান্দাগণের পক্ষে তাদের শত্রুদের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে থাকেন এবং নেক বান্দাদের মুক্ত করেন। যেমন নূহের শত্রুদের থেকে আল্লাহ বদলা নিয়েছিলেন এবং নূহ ও তাঁর ঈমানদার সাথীদের মুক্ত করেছিলেন।
১৪. ঈমানদারগণের বিরুদ্ধে বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম তোহমত ছিল এই যে, তারা হ’ল সমাজের দীনহীন ও স্বল্পবুদ্ধির লোক {হূদ ২৭}। এ যুগেও তার ব্যতিক্রম নয়।
১৫. নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারী সমাজ সংষ্কারকগণ সমাজের গালমন্দ খেয়েও সমাজ ত্যাগ করেন না। কিন্তু তাঁরা বদ দো‘আ করলে আল্লাহর গযব নেমে আসে।
~o~0~o~ সমাপ্ত ~o~0~o~
রচনাঃ
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
*১৬* কুরতুবী, হূদ ৪০ আয়াতের টীকা দ্রষ্টব্য।
*১৭* কুরতুবী, ইবনু কাছীর; হূদ ৪০ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।