somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমাজে প্রচলিত শিরকসমূহ - শেষ পর্ব

১২ ই মে, ২০১১ সকাল ৯:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পূর্বের পর ...
সমাজে প্রচলিত কতিপয় শিরক (শেষ ভাগ)
আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জে ও শহর-বন্দরে প্রচলিত আছে কিছু শিরক, বিদ'আত ও নানাবিধ কুসংস্কার যা এসব দেশের লোকজন ধর্মীয় বিধান বা নিয়ম মনে করেই পালন করে থাকে। ধারাবাহিক আলোচনার আজ উপস্থাপন করছি তার ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব।

নবজাতকের জন্যঃ নবজাতকের হাতে চামড়ার চিকন তার, তাগা বা গাছ বা এ ধরনের অন্য কোন কিছু চুড়ির মতো করে বেঁধে দেয়া হয় যাতে কোন অশুভ রোগ-বালাই বা বদ জিন-ভূত স্পর্শ করতে না পারে। আবার নবজাতককে জিনের অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য বাচ্চার কান ছিদ্র করা, বাচ্চার বালিশের নিচে জুতার টুকরা রাখা অথবা শিশুর মাথার চুল না কাটা। চোখ লাগা থেকে শিশুকে রক্ষার জন্য তার গলায় মাছের হাড়, শামুক ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখা, কপালে কালো টিপ বা দাগ দেয়া।

কোন মাস বা সময়কে ভাল বা খারাপ জানাঃ আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সময় ও দিনক্ষণের ভালমন্দে বিশ্বাসী। মুহাররম, কার্তিক প্রভৃতি মাসে বিয়ে-শাদী করা উচিত নয়, রবি ও বৃহস্পতিবারে বাঁশ কাটা যায় না*, সোম ও বুধবারে গোলা হতে ধান বের করা যায় না, শুক্র ও রবিবারে পশ্চিম দিকে যাত্রা করলে ক্ষতি হবে, শনি ও মঙ্গলবারে বিয়ে করা ও ঝাড়ু বাঁধা উচিত নয়, রাতের বেলা ঝাড়ু দিলে আয়-উন্নতি হয় না, রাতে আয়না দেখলে কঠিন পীড়া হয়, রাতে নখ কাটা ঠিক নয়, নতুন বউকে ভাদ্র মাসে শ্বশুর বাড়ীতে রাখা হয় না (কারণ নতুন বছরের পা ভাদ্র মাসে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর জন্য দেখা অকল্যাণকর), ভাদ্র ও পৌষ মাসে মেয়ে লোকের সওয়ারী পাঠানো যায় না, আশ্বিন মাসের শেষ দিন মুটে বানিয়ে গরুকে গা ধৌত করা ও 'গো ফাল্গুন' বলে মান্য করা ইত্যাদি।

গায়রুল্লাহ্‌র নামে কসম করাঃ আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, 'যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহ্‌র নামে কসম করল, সে কুফরী করল অথবা শিরক করল'। {তিরমিযী, হা/১৫৩৫; মুসতাদরাক হাকিম, ১/১৮, সনদ ছহীহ} মূলত আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন নামে কসম করলে কসম হয় না। যেমন- রাসূলুল্লাহ্‌র কসম, কা'বা শরীফের কসম, নিজ চোখের কসম, বিদ্যা বা বই-এর কসম ইত্যাদি।

পীর, ওলী বা বুযুর্গ ব্যক্তির অসীলা গ্রহণঃ আল্লাহকে পাওয়ার জন্য, তাঁর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে, ক্ষমা ও সাহায্য পাওয়ার আশায় কোন জীবিত বা মৃত পীর, ওলী বা বুযুর্গ ব্যক্তিকে অসীলা বা মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা।

শুভ-অশুভ আলামতঃ বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোন বস্ত্ত, স্থান, শব্দ বা সংকেতকে পছন্দ করা বা না করা মানুষের মানবীয় স্বভাব। এটা দোষের কিছু নয়। তবে ভালকে নিশ্চিতভাবে ভাল এবং মন্দকে অকল্যাণকর বলে জানতে হলে শরী'আতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন। তাওহীদের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে শুভ-অশুভ আলামতে বিশ্বাস করা স্পষ্টভাবে শিরকের পর্যায়র্ভুক্ত করা যায়। ইবনু মাস'ঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ দ্বারা এ বিধানটি আরও দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়। এ হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, 'অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শিরক, কথাটি তিনবার বলেন'। {তিরমিযী, ৪/১৬০; ইবনু হিববান, ১৩/৪৯১; হাকেম, আল-মুসতাদরাক, ১/৬৪; আবূ দাউদ, ৪/১৭।}

পাখি ও প্রাণীর চলাচলের গতিপথকে প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের লোকেরা সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের আলামত বলে গণ্য করত এবং তাদের জীবনের পরিকল্পনা গ্রহণের প্রক্রিয়া এ সব আলামতকে ঘিরেই কেন্দ্রীভূত ছিল। শুভ বা অশুভ আলামত নির্ধারণের এই চর্চাকে আরবীতে তিয়ারা (উড়াল দেয়া) বলা হত। যেমন- কোথাও যাবার উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি যাত্রা শুরু করলে যদি একটি পাখি তার উপর দিয়ে উড়ে বামে চলে যেত, তাহলে সে ভাবত যে তার দুর্ভাগ্য অবশ্যম্ভাবী; ফলে সে পুনরায় ঘরে ফিরে যেত। ইসলাম এ ধরনের সকল কুপ্রথাকে বাতিল করেছে। সকল মুসলিমকে এ ধরনের বিশ্বাস হতে উদ্ভূত অনুভূতিকে পরিহার করতে বিশেষভাবে যত্নশীল হতে হবে। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞাতসারে যদি কেউ কোন কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে যা এ প্রকৃতির বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাহ'লে অবশ্যই আল্লাহ্ নিকটে এর থেকে পরিত্রাণ চেয়ে নিম্নের দো'আ দ্বারা আকুল প্রার্থনা জ্ঞাপন করা উচিত, 'আল্লাহুম্মা লা খায়রা ইল্লা খায়রুকা ওয়া লা ত্বায়রা ইল্লা ত্বায়রুক ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা'। অর্থ : হে আল্লাহ্! আপনার কল্যাণ ব্যতীত কোন কল্যাণ নেই এবং আপনার দেয়া শুভাশুভ ব্যতীত কোন শুভ বা অশুভ নেই এবং আপনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। {আহমাদ, ২/২২০; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১০৬৫; সনদ সহীহ।}

শুভ-অশুভ আলামত বিষয়ে বেশি রকমের বাড়াবাড়ি করা নিরর্থক। বৃহৎ শিরকের উৎসমূলে পরিণত হওয়ার আশংকায় ইসলাম এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। মূর্তি, মানুষ, তারা, সূর্য ইত্যাদি পূজার উৎপত্তি হঠাৎ করে হয়নি। এ ধরনের পৌত্তলিকতার চর্চা দীর্ঘকালব্যাপী ক্রমান্বয়ে বিকাশমান হয়েছে। বৃহৎ শিরকের শিকড় যত বিস্তার লাভ করে, আল্লাহ্ একত্বের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকে। এভাবে শয়তানের কুমন্ত্রণার বীজ অঙ্কুরিত হয়ে মুসলিমদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূল ধ্বংস করার পূর্বেই তা সমূলে উৎখাত করতে হবে।

শিরক সম্পর্কে সর্বদা স্মর্তব্য হল,
১. জীবন বিপন্ন হলেও শিরক করা যাবে না,
২. শিরকের পাপের কোন ক্ষমা নেই,
৩. শিরকের পরিণতি ধ্বংস,
৪. শিরক সমস্ত নেক আমলকে নিষ্ফল করে দেয়,
৫. মুশরিকরা চিরস্থায়ী জাহান্নামী,
৬. মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নিষেধ,
৭. শিরক মিশ্রিত ঈমান কখনোই ঈমান হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়,
৮. শিরক অতি সন্তর্পনে আগমন করে।

সুতরাং শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য সবসময় আল্লাহ তা'আলার নিকটে প্রাণখুলে দো'আ করা ও সাহায্য প্রার্থনা করা কর্তব্য। রাসূল (ছাঃ) শিরক হতে বাঁচার জন্য আমাদেরকে দো'আ শিখিয়েছেনঃ 'আল্লাহুম্মা ইন্না না'ঊযুবিকা আন নুশরিকা শাইআন না'লামুহু, ওয়া নাসতাগফিরুকা লিমা লা না'লামুহ।' অর্থ: হে আল্লাহ্, জেনে বুঝে শিরক করা থেকে আমরা আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং আমাদের অজ্ঞাত শিরক থেকে আপনার নিকটে ক্ষমা চাচ্ছি। {আহমাদ ও আত্ব-ত্বাবারানী, ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৩৬, সনদ হাসান।} আল্লাহ আমাদের সবাইকে ছোট-বড় সকল প্রকার শিরক হতে রক্ষা করুন, আমীন!

* এ ধরনের বিশ্বাসের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের অনেক এলাকা যেখানে বাঁশের হাট রয়েছে, সেসব হাটগুলো সাধারণত রবিবার ও বৃহস্পতিবার ছাড়া অন্য দিনগুলোতে হয়।

সবগুলো পর্ব একসাথে একটি পিডিএফ ডাউনলোড (সাইজ ১৬২ কেবি)

~~~সমাপ্ত~~~

রচনাঃ নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজিদ
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১১ বিকাল ৩:৫০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×