পূর্বের পর ...
সমাজে প্রচলিত কতিপয় শিরক (৩য় ভাগ)
আলোচনা চলছে আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জে ও শহর-বন্দরে কুসংস্কারজনিত এমন সব শিরক সম্পর্কে যা লোকজন ধর্মীয় বিধান বা নিয়ম মনে করেই পালন করে থাকে। আজ উপস্থাপন করা হচ্ছে তার তৃতীয় কিস্তি।
প্রতিকৃতি, মূর্তি ও ভাস্কর্য ইত্যাদির হুকুমঃ কোন নেতা বা স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিবর্গের ছবি, চিত্র, প্রতিকৃতি, মূর্তি ও ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরি করা, মাঠে-ঘাটে, অফিস-আদালতে ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এগুলো স্থাপন করা, এগুলোকে সম্মান করা, এগুলোর উদ্দেশ্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ ইত্যাদি করা।
স্মৃতিস্তম্ভ ও শহীদ মিনারঃ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের স্মরণে সমাধি, স্মৃতিস্তম্ভ, স্মৃতিসৌধ বা শহীদ মিনার নির্মাণ, এগুলোকে সম্মান জানানো, সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা ইত্যাদি।
অগ্নিপূজা, শিখা চিরন্তন ও শিখা অনির্বাণঃ 'অগ্নি শিখা' অগ্নিপূজকদের উপাস্য দেবতা। তারা বিভিন্নভাবে আগুনের পূজা করে থাকে। এ অগ্নিপূজা সম্পূর্ণ শিরক ও আল্লাহদ্রোহী কাজ। 'শিখা চিরন্তন' বা 'শিখা অনিবার্ণের' নামে অগ্নি মশালকে সারা দেশে ঘুরিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা জানানো এবং এগুলোর প্রজ্জ্বলনকে অব্যাহত রাখার জন্য বিশেষ ধরনের বেদীর ওপর এগুলো স্থাপন করা এবং অলিম্পিক মশাল সহ বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠানের মশাল প্রজ্জ্বলনও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
মঙ্গল প্রদীপঃ হিন্দুদের অনুকরণে কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে বা কোন প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন উপলক্ষে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা পালন করা।
তাছাওউফের শায়খ বা পীরের কল্পনাঃ তাছাওউফের শায়খ বা পীরের চেহারা, আকৃতি ইত্যাদি কল্পনা করে মোরাকাবা, ধ্যান, যিকির বা অন্য যে কোন ইবাদত করা শিরক।
পীরকে ডাকা ও তার জন্য ঘর সাজিয়ে রাখাঃ অনেকে স্বীয় পীর বা কোন বুযুর্গ ব্যক্তিকে বহুদূর হতে ডাকে এবং মনে করে যে, তিনি এটা জানতে ও শুনতে পারছেন। অনেক সময় 'ইয়া গাওছুল আযম', 'ইয়া খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী' ইত্যাদি বলে ডাকতে থাকে এবং নিজেদের ফরিয়াদ পেশ করতে থাকে। কিছু সংখ্যক পীরের অনুসারীরা তাদের বাড়ির মধ্যে একটি ঘর পীরের জন্য সারা বছর সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। একটা বড় খাটের ওপর চাদর বিছিয়ে বড় বড় কয়েকটা কোল বালিশ সেট করে 'বিশেষ আসন' তৈরি করা হয়। পীরের ছবিকে মালা পরিয়ে সযত্নে ঐ ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়। ফুল ও জরি দিয়ে ঘরটি সুন্দর করে সাজানো হয়। সারা বছর ঐ ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না। মাঝে মাঝে মুরীদরা ঐ ঘরে ঢুকে ছবি ও আসনের সামনে আদবের সাথে চুপ করে বসে থাকে।
পীরের বাড়ি বা আস্তানার খাদেম ও জীবজন্তুর প্রতি সম্মানঃ অনেককে দেখা যায়, পীরের বা মাযারের খাদেম, গরু, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদিকে দেখামাত্র দাঁড়িয়ে যায়। এগুলোর সামনে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকে আবার এসব গরু, কুকুর, বিড়ালের পা ধরে বসে থাকে নেক মাকছূদ পূরণের জন্য। খানজাহান আলীর মাযারের পুকুরে কুমীর আছে, চট্টগ্রামে কথিত বায়েজীদ বোস্তামীর মাযারে কচ্ছপ আছে। আবার কোন কোন জায়গায় গজার মাছ, জালালী কবুতর ইত্যাদি পীর-ওলীদের স্মৃতি বহন করছে বলে মানুষের বিশ্বাস। অজ্ঞ অশিক্ষিত মানুষেরা মাযারের ব্যবসায়ী খাদেমদের খপ্পরে পড়ে এ সব কচ্ছপ, গজার মাছ, কুমীর, জালালী কবুতর ইত্যাদিকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করে এবং এদের জন্য বিভিন্ন খাদ্যবস্ত্ত পূজাস্বরূপ নিয়ে যায় ও এদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে।
পীর, ওলী-আওলিয়াদের কবরের মাটি ও সেখানে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতিকে বিভিন্ন রোগের জন্য উপকারী মনে করাঃ এ ধরনের কর্ম আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অহরহ পরিলক্ষিত হয়। তারা বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে আওলিয়াদের কবরের মাটি ও সেখানে জ্বালানো মোমবাতি অনেক উপকারী মহৌষধ মনে করে অত্যন্ত যত্নের সাথে তা ব্যবহার করে থাকে এবং এর দ্বারা কোন রোগ মুক্তি হলে তা কবরস্থ ব্যক্তির দান বা তাঁর ফয়েয বলে মনে করে।
ইনশাআল্লাহ চলবে ...
রচনাঃ নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজিদ