পূর্বের পর ...
সমাজে প্রচলিত কতিপয় শিরক (২য় ভাগ)
গত পর্ব থেকে আলোচনা শুরু করেছিলাম আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জে ও শহর-বন্দরে কুসংস্কারজনিত এমন সব শিরক সম্পর্কে যা লোকজন ধর্মীয় বিধান বা নিয়ম মনে করেই পালন করে থাকে। আজ তার আরো কিছু উপস্থাপন করছি।
রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে ধাতব আংটি ও বালা পরিধান করাঃ রাজধানী সহ বিভিন্ন শহরের ফুটপাতে এবং বড় বড় পাইকারী বাজারে এমন কিছু ব্যবসায়ের দোকান পাওয়া যায়, যারা ধাতব নির্মিত আংটি ও বালা বিক্রি করে থাকে। অনেক লোকদেরকে তা বাত রোগ নিরাময়, যে কোন উদ্দেশ্য সফল হওয়া, শনি ও মঙ্গল গ্রহের কুদৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা ইত্যাদির জন্য করে আংগুলে ও হাতে ব্যবহার করতে দেখা যায়। আল্লাহ্ ইচ্ছার বাইরে কোন বস্ত্তই নিজস্ব গুণে কোন রোগের ক্ষেত্রে উপকারী বা অপকারী হতে পারে না। এতে রোগীর অন্তরে ধাতব বস্ত্তর প্রতি উপকারী হওয়ার ধারণার সৃষ্টি হয় এবং রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ পরিবর্তে বস্ত্তর উপর ভরসা করা হয়। তাই কোন বস্ত্তকে কোন ক্ষেত্রে উপকারী বা অপকারী ধারণা করে ব্যবহার করা।
তা'বীয ব্যবহার করাঃ জিনের অশুভ দৃষ্টি এবং বিভিন্ন রোগের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ মুসলিমদের মাঝে তা'বীয ব্যবহার একটা সাধারণ রীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ সকল ধরনের তা'বীয ব্যবহার করা শিরক।
যাদু-টোনা, বাণ মারা বা বধ করাঃ আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যদি কারো সাথে কারো শত্রুতা সৃষ্টি হয় এবং এ দু'পক্ষের কোন এক পক্ষ যদি দুর্বল হয়, তবে দুর্বল পক্ষ সাধারণত বিভিন্ন জিন সাধকের মাধ্যমে যাদুর আশ্রয় গ্রহণ করে সবল পক্ষকে বাণ মারে বা বধ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সবল পক্ষও দুর্বল পক্ষকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে যাদুর আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এভাবেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অধিকতর ভালবাসা সৃষ্টি, কারো সাথে শত্রুতা সৃষ্টি, কারো বিবাহ হতে না দেয়া, কারও প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি, কাউকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে চলে যাদুর খেলা। আবার এ সকল যাদুকে নিষ্ক্রিয় করতে পুনরায় আশ্রয় গ্রহণ করা হয় যাদুমন্ত্রের। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট তথা জিন, পীর, ওলী-আওলিয়া, এমনকি হিন্দুদের দেব-দেবী প্রভৃতির নিকটেও আশ্রয় প্রার্থনা করা, নির্দিষ্ট দিনে লাল বা কালো মোরগ জিন বা ভূতের নামে রোগীকে যবহ করতে বলা কিংবা মিষ্টি ও ফলমূল গায়রুল্লাহ্র নামে এমনকি হিন্দুদের মন্দিরে অবস্থিত দেব-দেবীকেও মানত করা।
কবর ও মাযারের সম্মান করাঃ মাযার স্পর্শ করা, শরীর মাসেহ করা বা চুমু খাওয়া, কবরের মাটি বরকতের নিয়তে নিয়ে তা'বীযে করে গলায় বাঁধা, গায়ে মালিশ করা, রওযা শরীফ, মাযার বা কবর ইত্যাদির ছবি বরকতের জন্যে রাখা, চুমু খাওয়া, সম্মান করা। বিপদাপদ, বালা-মুছীবাত থেকে বাঁচার জন্য ঘর-বাড়িতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বরকতের জন্য দোকান, অফিস, হোটেলে ছবি রেখে আদবের সাথে দাঁড়িয়ে এগুলো করা। মাযারকে মাঝে মাঝে মহা ধুমধামের সাথে ধোয়া হয়। আর এ কবর ধোয়া পানি বোতলে করে নিয়ে যাওয়া এবং নেক মাকসূদ পূরণের নিয়তে পান করা।
মাযারে গিলাফের তা'যীমঃ বিভিন্ন পীর, ওলী-আওলিয়া, বুযুর্গানে দ্বীনের মাযারে বা কবরের ওপরে আজকাল গিলাফ পরানো হয়। অজ্ঞ, অশিক্ষিত মানুষ অনেক ক্ষেত্রে এসব গিলাফে চুমু খায়, গিলাফ ধরে ফরিয়াদ জানায়, আদবের সাথে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এ গিলাফের সুতা তা'বীযে ভরে গলায় বাঁধে। এমনকি অনেকেই আরো একধাপ এগিয়ে গিলাফের কাছেই দো'আ চেয়ে বসে।
ওরশঃ অনেক মাযারে ও পীরের দরবারে অমাবস্যা, পূর্ণিমা, পীরের জন্ম বা মৃত্যু তারিখ নির্দিষ্ট করে ওরশ হয়ে থাকে। বিজলী বাতি, গেট, চকমকি কাগজ ইত্যাদি দিয়ে প্যান্ডেল, স্টেজ সাজানো হয়। বেপর্দা অবস্থায় নারী-পুরুষ একত্রে বসে যিকির করে, কাওয়ালী-সামা শোনে। ভন্ড পীর, ফকীররা এ সব ওরশে ওয়ায নছীহতের নামে শরী'আত বিরোধী আক্বীদা-বিশ্বাস প্রচার করে। শাহী তবারক রান্না করা হয়। ওরশের পরে যে টাকা অবশিষ্ট থেকে যায়, তা পীর ও তার খাদেমদের পকেটে চলে যায়। ওরশ মূলত আনন্দোৎসব ও বিনা পুঁজিতে টাকা উপার্জনের পন্থা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
খাজা বাবার ডেগঃ একদল লোক বিশেষত যুবকেরা রজব মাস এলেই পথে-ঘাটে, বাজারে যেখানেই সুযোগ পায় সেখানেই একটা ডেগ বা বড় হাড়ি বসায়। লালসালু কাপড় বিছিয়ে, বাঁশ দিয়ে ছাউনি দিয়ে, বিজলী বাতি জ্বালিয়ে, চকমকি কাগজ এবং বিভিন্ন ধরনের রং লাগিয়ে ঘর সাজিয়ে তার মধ্যে স্থাপন করে ডেগ। তারা একে বলে 'খাজা বাবার ডেগ'।
ইনশাআল্লাহ চলবে ...
রচনাঃ নূরজাহান বিনতে আব্দুল মজিদ