(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। কিন্তু নাম, পরিচয় কাল্পনিক)
কেউ জোরে জোরে দরজাটা ধাক্কা দিচ্ছে। বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল মারুফ। এসে দেখে এলিজাবেথকে। এলিজাবেথকে মারুফ সংক্ষেপে এলিজা ডাকে। এলিজা জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের শোবার ঘর থেকে চিৎকারের শব্দ আসছে, তুমি কি বউয়ের গায়ে হাত তুলেছো? মারুফ বলল, তুমি এসব বুঝবেনা। বাংলাদেশের সম্পর্কগুলো এমনই হয়। এলিজা বাংলা জানেনা বা বোঝেওনা। জার্মান ভাষাতেই এলিজা কথা বলে এবং মারুফ জার্মান ভাষাতেই তার উত্তর দেয়। একই বাসায় তারা থাকে। যদিও মারুফ লোকজনের কাছে বলে ওরা সাবলেট থাকে এলিজার বাসায় কিন্তু দ্বিপান্বিতা কখনও দেখেনি মারুফকে বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে।
মারুফ জার্মানীতে আছে প্রায় পনেরো বছর ধরে আর পাঁচবছর হয়েছে দ্বিপান্বিতা এসেছে। এসেই তিনমাস পর চাকুরীতে ঢুকে গেছে। সকালে ন'টায় বেরিয়ে যায় আর ফেরে সেই রাত দশটায়। কিন্তু সে চায়নি এত তাড়াতাড়ি সে ব্যস্ত হয়ে যাবে! সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা ছিল সাবলেট থাকাটা। নিজের প্রাইভেসি বলতে কিছু থাকেনা- সারাক্ষণ মনে হয় বাড়তি দুটো চোখ ওদের দিকেই তাক করা থাকে। নিজ থেকে দ্বিপান্বিতা বলেছিল, দেখো মারুফ আমি এভাবে থাকতে চাইনা, তুমি আলাদা বাসা নাও। মারুফ বলল, দেখো একজনের উপার্জনে এখানে আলাদা বাসা নিয়ে থাকাটা খুব কষ্টকর, তুমিও একটা চাকুরী নাও তখন আমরা আলাদা বাসা নেব। সে কথার উপর ভিত্তি করেই দ্বিপান্বিতা চাকুরী করছে।
ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই কেমন জানি চোখ লেগে আসছিল ঘুমে। এমন সময় মারুফ এসে গায়ে হাত রাখল। বেশ বিরক্তি লাগছিল তার! নিজে থেকেই বলল, প্লীজ মারুফ আমি খুব ক্লান্ত, সকালে উঠতে হবে। মারুফ কথা শুনছেনা- সে টেনে দ্বিপান্বিতার শরীর থেকে সব কাপড় খুলতে লাগল। কিন্তু দ্বিপান্বিতা আবারও আপত্তি জানাল এবং একটু সরে এল। মারুফ এবার হিংস্র হয়ে উঠল এবং রেগে গিয়ে খুব মারল তাকে। সে চিৎকার করল জোরে এবং কান্নার শব্দ পেয়েই এলিজা দরজায় ধাক্কাচ্ছে। মুখ চেপে ধরে মারুফ তার শরীরের ক্ষুধা মেটালো কিন্তু পড়ে রইল দ্বিপান্বিতা বালিশে মুখ গুঁজে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর ভাবছে এভাবে প্রতি রাতে কত কত মেয়ে স্বামী দ্বারা ধর্ষিত হয়!
সুন্দর একটা গোছানো সংসারের জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সে কাজ করছে। টাকাটা এনে স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে কারন স্বামী বলেছে চাকুরীর বেতন তার কাছেই জমা দিতে হবে। প্রথমে দ্বিপান্বিতা আপত্তি করেছিল কিন্তু মারুফের জবাব, থাকতে হলে এভাবেই থাকতে হবে নইলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবো। জার্মানীতে কোন বাঙ্গালি পরিবারের সাথে মেশার অনুমতি সে পায়নি। একা একটা মানুষ বিদেশের মাটিতে কোন কমিউনিটি ছাড়া কিভাবে চলতে পারে! স্বামীর জন্য, তার ভালবাসার জন্য, একটা সুন্দর সংসারের জন্য সব মেনে নিয়েছে সে। জীবনে এমন ত্যাগের কি কোন মূল্যই মারুফের কাছে নেই? তাহলে কেন পড়ে আছে সে মাটি কামড়িয়ে এমন সংসারে! নিজেকে হাজারো বার প্রশ্নটা করে কিন্তু মেলাতে পারেনা সে!
বাবা মা'র অমতে বিয়ে করেছিল সে। মারুফকে বাংলাদেশে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেছিল, সেই থেকেই দু'জনার পরিচয় এবং ভালবাসা। তার উপর ছেলে ইউরোপে থাকে, ঢাকাতে বাড়ি- গাড়ি সবই আছে, দেখতে বেশ। কিন্তু বাবা মাকে রাজী করাতে পারছিলনা দ্বিপান্বিতা। পালিয়ে গিয়ে কোর্টে বিয়ে করলো দু'জন। বাবা মা'র ভালবাসাকে পেছনে ফেলে হাত ধরেছিল। বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা হিসেবে বেশ আদরেই বড় হয় দ্বিপান্বিতা। কষ্ট কাকে বলে কখনও দেখেনি। বিয়ের পর প্রায় একবছর বাংলাদেশে থাকতে হয়েছে তাকে। প্রতিদিন ফোন করত মারুফ। ভালবাসার মোহে কখন যে দিন হতো আর কখন যে রাত হতো সেটা টেরই পাওয়া যেতোনা। সবাই বলত এমন বউ পাগল ছেলে হয় নাকি? সারাক্ষণ শুধু ফোনে কথা বলে কাজ করে কখন? এসব কথা দ্বিপান্বিতার কিন্তু বেশ লাগত! অপেক্ষা শুধু কবে যাবে প্রিয় মানুষটির কাছে!
ফোনে যখন মারুফের সাথে কথা বলে তখন কেমন জানি একটা পানি পড়ার শব্দ হতো। পুরো একবছর ধরে এই টিপ, টিপ, টিপ, এভাবে পড়ছেত পড়ছেই। জিজ্ঞাসার পর মারুফ বলল, আরে রান্না ঘরে কলটা ঠিকমত কাজ করছেনা তাই ওটা থেকে পানি পড়ে ফোঁটা ফোঁটা করে। এভাবেই একদিন ভিসা হয়ে যায় দ্বিপান্বিতার এবং চলে আসে জার্মানীতে। বাসা পায়নি সেটা আগে জানিয়েছিল এবং একজন বয়স্ক মহিলা যার নাম এলিজাবেথ তার বাসায় সাবলেট থাকবে সেটাও জানিয়েছিল। মারুফের সিদ্ধান্তে আপত্তি করেনি সে। জার্মানীতে এসে প্রথম দিন ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় কিন্তু কেমন জানি সেই পরিচিত শব্দটা কানে এল, যেটা সে দেশে বসেই ফোনে কথা বলার সময় শুনতে পেত।
বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল! দৌড়ে গেল রান্না ঘরে -গিয়ে দেখে পানির কলটা থেকেই টিপটিপ করে পানি পড়ছে। এসেছে মাত্র আজ, এখন এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা হলোনা তার। ব্যপারটা কিন্তু তাকে বারবার পীড়া দিচ্ছিল এবং ভাবছিল, মারুফ এতটা বছর এই বাসাতেই ছিল সাবলেট কিন্তু সে এটা কেন গোপন করল! একা থাকতো অন্য বাসায় সেটা সে বলে আসছিল কিন্তু! মারুফ তাকে মিথ্যা বলেছে এটাই তার কাছে অনেক স্পর্শকাতর একটা ব্যপার মনে হচ্ছে! কোথাও হিসাবের কি কোন ভুল হয়ে গেল- না ভাবতেই পারছেনা সে!
এলিজাবেথের বয়স প্রায় ষাট। মায়ের বয়সী একজন জার্মান মহিলার সাথে মারুফ বাসা শেয়ার করছে এটাতে দোষের কিছু দেখছেনা সে কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে মারুফ সত্য গোপন করছে কেন? এভাবেই যাচ্ছিল কিছুদিন। এরই মধ্যে কিছু বাঙ্গালির সাথে তার পরিচয় হলো। যোগাযোগ ও ফোন নাম্বার আদান প্রদান সবই হলো। ওমা এরই মধ্যে মারুফ বলল, এখানে বাঙ্গালি কমিউনিটি ভালোনা তাই কারো সাথে যেন সে না মিশে! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এবং বলল, না মিশে আমরা কিভাবে থাকবো? এটা কি সম্ভব? কিন্তু মারুফ অটল- যদি এখানে থাকতে হয় তাহলে তার কথা মেনেই থাকতে হবে নয়ত বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে!
দ্বিপান্বিতা তাকে ভালবেসেছিল, তাই তার যতসব অন্যায় যুক্তিগুলো মেনে নিয়ে সামনে আগানোর চিন্তাই করছিল! তবে কখনও স্বামীকে সন্দেহ করেনি। এলিজাবেথও তাদেরকে বেশ সহযোগিতা করতো। কিন্তু দ্বিপান্বিতার বেশ বিরক্ত লাগত যখন এলিজাবেথ কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হয়ে থাকত। এই পাঁচ বছরে ওরা বিভিন্ন দেশে ঘুরতে গিয়েছে অনেকবার কিন্তু প্রতিবারই এলিজাবেথ তাদের সাথে ছিল। মারুফ বলে, বয়স্ক মানুষ তাকে বাসায় একা ফেলে আসব কেন! আমাদের সাথে থাকলে ওনারও ভাল লাগবে কিন্তু তুমি এমন করো কেন? এলিজাবেথও কেমন জানি নির্লজ্জ টাইপের। স্বামী স্ত্রী'র মাঝখানে মাথা না গলালে তার ভাল লাগেনা! নাহ মারুফকে বোঝানো যায়নি। এই নিয়ে কিছু বললেই ইচ্ছেমত মারতো তাকে। একদিন গায়ে হাত তোলার জন্য পুলিশে কল করেছিল সে। পুলিশ এসে মারুফকে সাবধান করে দিযেছে এবং বলে গেছে এরপর গায়ে হাত তুললে মারুফকে বাসার বাহির চলে যেতে হবে এবং দ্বিপান্বিতাকে কেস করতে বলল।
এরপর থেকে মারুফ হাত তোলেনি কিন্তু তেড়ে আসে। অকথ্য বাসায় গালিগালাজ করে। দ্বিপান্বিতা নিজের কোন দোষ খুঁজে পায়না। তাহলে কি কারনে মারুফ এমন করে? সেকি তবে আমার সাথে থাকতে চায়না? তার পাঁচ বছরের সমস্ত উপার্জন মারুফকে দিয়েছে এবং দুজনের টাকাতেই ঢাকাতে ছয় তলা বাড়ি বানিয়েছে। একদিন মারুফকে বলেছিল যে, এতগুলো ফ্ল্যাট তোমার, ওখান থেকে আমাকে একটা ফ্ল্যাট লিখে দাওনা! কিন্তু মারুফ খুব রাগ করেছিল, বলেছিল- এত আমার আমার কর কেন? ভাগাভাগি শিখে গেছো?
দ্বিপান্বিতা চুপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। বলেছিল, দেখো আমি চাকুরী করছি, তো তুমি এখন আলাদা বাসা নিচ্ছোনা কেন? প্রথম যে বলেছিলে আমি চাকুরী করলে তুমি বাসা নেবে।
মারুফ বলল, আমার সময় নেই। তাছাড়া এই বাসাটা খারাপ কোথায়?
সে বলল, আমি আমার একটা সংসার চাই। একটা বাচ্চা চাই। কিন্তু অন্যের সাথে বাসা শেয়ার আমি করতে পারবোনা। মারুফ বলল, শেয়ার না করতে পারলে চলে যাও। জার্মানীর কার্ড হইসেতো তাই আজকাল গলাও দেখি বাড়সে!
একটা বাচ্চা নিতে চেয়েছিল কিন্তু মারুফ চায়না বলে হয়নি। মারুফ বলে, বাচ্চা হইলেত ঘরে বইসা যাবা কিন্তু শরীরে এনার্জি থাকতে থাকতে কিছু পয়সা কড়ি কামাও।
কেমন জানি তার কথাগুলো আত্মাতে গিয়ে লাগে, কিছুই বলতে পারেনা সে। কতবার মারুফ তাকে হুমকি দিয়েছে কারো কাছে মুখ খুললেই জানে মেরে ফেলবে।
কাজ করতে গিয়ে বড় একটা দুর্ঘটনায় দ্বিপান্বিতা'র হাত পুড়ে যায়। বেড রেস্ট প্রায় এক বছর। এই ফাঁকে সে ভাবছে একটা বাচ্চা নিয়ে নিলে মন্দ হয়না। কোনমতে রাজি করাতে পারল মারুফকে। কিন্তু প্রায় বছর হতে চলল তারা বাচ্চার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছেনা। মারুফ বলছে, বাচ্চা না হলে কিন্তু আমি আবার বিয়ে করবো।
কথাটা শুনে সে বলেছিল, কিভাবে এটা সম্ভব? তুমি কি আমাকে তবে ভালবাসোনা?
মারুফ বলেছিল, বাচ্চা না হইলে তোমার চেহারা, ভালবাসা দিয়া কি আমি পূজা করবো?
সে বলেছিল, যদি তোমার সমস্যার কারনে বাচ্চা না হয় তাহলে?
মারুফ বলেছিল, সে সম্ভাবনা নাই, আমার কোন সমস্যাই নাই।
এসব নিয়ে মান অভিমান নিয়ে কথা বলা বন্ধ দুজনের। আলাদা রুমে থাকছে। এক দুদিন রুমে গিয়ে জোর করে সেক্স করে এসেছে কিন্তু কথা বলেনি। মারুফ ভয় দেখায় সেক্স করতে না দিলে সে পতিতালয়ে যাবে! এটা বললে চুপসে যায় দ্বিপান্বিতা! যত খারাপই লাগুক সে আপত্তি করেনা ভাবে যাহ একটা জানোয়ারের সাথেই না হয় থাকলাম!
বাবা মাকে খুব মিস করছে সে।তাদের ভালবাসা ত্যাগ করে এসেছিল মারুফের কাছে। এখন এসব কোনকিছুই তাদের সাথে শেয়ার করতে পারেনা দ্বিপান্বিতা। এলিজাবেথকেও তার অসহ্য লাগে। সব ব্যাপারেই নাক গলায়। সেদিন বাসা ছাড়ার কথা বলতেই মারুফ বলে, আমি তোকে ছাড়বো প্রয়োজনে কিন্তু এই বাসা ছাড়বোনা। এলিজাবেথ পেনশনে গিয়েছে। তার একটি ছেলে আছে অন্য শহরে নানী'র সাথে থাকে। বয়স ১৩ বছর। কিন্তু তাকে দেখেনি দ্বিপান্বিতা। মাঝে মাঝে মারুফ এলিজাবেথকে সাথে নিয়ে দেখে আসে ছেলেকে।
রাগ করে বের হয়ে গিয়েছিল সেদিন দ্বিপান্বিতা। তার একটি নতুন বান্ধবী হয়েছে। তার বাসায় গিয়ে উঠেছিল। তবে বান্ধবী বুঝিয়ে শুনিয়ে দুদিন পর বাসায় নিয়ে এসেছিল। একটা চাবি নিজের কাছেই থাকে। দরজা খুলে কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে গিযেছিল দ্বিপান্বিতা। বাথরুম থেকে মারুফ আর এলিজাবেথ দুজনই হাসতে হাসতে একসাথে বেরুচ্ছে। তাদের কারো গায়েই কোন কাপড় ছিলনা!
রাগ আসেনি তার বরং একদলা ঘৃণা বেরিয়ে এসেছিল ভেতর থেকে। এত ভালবাসা, এত বিশ্বাস, নিজের সকল উপার্জন এবং অনিচ্ছা স্বত্তেও নিজের শরীরটাকে সপে দেয়া--এসব ত্যাগের বিনিময় মূল্য হচ্ছে এই!
দ্বিপান্বিতা হাসপাতালে। একটু আগে ডাক্তার বলে গেল সে মা হতে যাচ্ছে.....