বুড়িটা দু'দিন পরপরই আসে। ক্ষুধা আর রোগে শুকিয়ে যাওয়া চেহারা, কোমরটা কুঁজো। পরনে একটি শতছিন্ন সাদা শাড়ী। ভিক্ষে চায় প্রথম, তারপর বলে
- আম্মাগো, মুরগীর সালুন খাইতে কইলজা পোড়ে! দিবেন নি আম্মা?
না বললে দ্বিতীয়বার আর চায় না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করে। গেট অবধি গিয়ে পেছন ফিরে তাকায় একবার। ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায় বাইরে। তারপর পাশের বাড়ীতে একই প্রত্যাশায়।
- আম্মাগো, মুরগীর সালুন খাইতে কইলজা পোড়ে! দিবেন নি আম্মা?
কেউ দেয়, কেউ বা বকাঝকা দিয়ে বিদায় করে। শান্তা দেয় মাঝে মধ্যে। কিন্তু কতটুকুই বা দিতে পারে? ছেলেমেয়েদের সবাইকে নিয়ে খাবার পর সামান্যই বাড়তি থাকে। জুটলেও একটা দু’টো হাড়ই হয়তো জোটে বুড়ির কপালে। সেটাই চেটেপুটে খেয়ে প্রাণভরে দোয়া করতে করতে চলে যায়। কখনো প্লাষ্টিকের বাটিতে করে নিয়েও যায়।
শিশুরা সরল-সুন্দর, নির্মমও হতে পারে। ওদের একটি দল পেছনে লাগলো বুড়ির। একজন হঠাৎ মুরগীচোর বলে তাড়া দিল। বাকী সবাই যোগ দিল তাতে। একজন ঢিল ছুঁড়ে রক্তাক্ত করে দিল বুড়ির মাথা। বাকীরা রক্ত দেখে ভয়ে থেমে গেলো। বুড়ি কিছু না বলে মাথায় হাত চেপে হাঁটতে হাঁটতে পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
বুড়িকে অনেক দিন আর দেখা গেল না। কেউ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, কেউ ভাবলো, মরেই গেছে বুড়িটা । কারো মনও খারাপ হলো। যেমন শান্তার । জাহিদ সেই সকালেই অফিসে চলে যায়, একটু পরে ছেলেমেয়েরাও স্কুলে। তারপর একা একা সময়। বুড়ি এলে ভালই লাগে। খেতে খেতে নানা ধরনের গল্প শোনায় শান্তাকে। ও কিছুটা মায়ায় পড়ে গেছে বুড়ির।
শুক্রবার ছুটির দিন, ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া এই দিনেই হয়। জাহিদ মুরগী কিনলো আজ। ছেলেমেয়েরাও বাবামায়ের সাথে থাকতে পেরে খুশী। বাড়ীতে কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব। বেশ যত্ন করেই রান্না করলো শান্তা। গোসল সেরে একসাথে মিলেমিশে খেতে বসলো সবাই। কিন্তু টেবিলে বসে এত বেশী মন খারাপ করলো ও, যে খেতেই পারলো না। মুরগীর তরকারীতে হাতই দিল না। বাকী খাবারও প্লেটে নিয়ে নেড়েচেড়ে উঠে পড়লো। দৃশ্যটা জাহিদের নজর এড়ালো না। একটা হাড় চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলো,
- কি হলো বউ, উঠে পড়লে যে? এত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ!
- মন চাইছে না।
- কেন, শরীর খারাপ?
- না না! শরীর ভালই আছে।
- আম্মার মন খারাপ! ফোড়ন কাটলো তিন্নি।
- মন খারাপ কেন? কেউ বকেছে?
উত্তর না দিয়ে কলঘর থেকে হাত ধুয়ে এলো শান্তা। বাকী সবার খাওয়াও শেষ হলো। ছেলেমেয়েরা ক্যারামের আসর বসিয়েছে বসার ঘরে। জাহিদ শুধুমাত্র ছুটির দিনেই দুপুরের খাবারের পর একটু পান চিবোয়। শান্তা ওকে পান দিয়ে খাবার টেবিল পরিষ্কার করায় ব্যস্ত। আরাম করে পান চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলো জাহিদ,
- কিগো, মন খারাপ কেন?
- এমনি।
- এমনি বুঝি মন খারাপ করে কেউ! আমাকেও বলবে না?
- না গো, বলার মতো কিছুই ঘটেনি। ঘটলে, তোমাকে না বলে থাকতে পারি?
- তাহলে মুখটা কালো কেন?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো শান্তা। এসব ছোটখাট অনুভূতির কথা বলবে কি? অনেকসময় এগুলো দুর্বলতারই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হাসির পাত্র হতে হয় কখনো। অনেকবারই হয়েছে এরকম। তবে জাহিদ মোটেও সেরকম নয়। যতটুকু পারে, ও ততটুকু নিয়েই আগলে রাখে শান্তাকে।
- আমাদের মুরগী পাগল বুড়িকে দেখেছো কখনো?
- কেন দেখব না। প্রতি শুক্রবারই তো আসে। তোমার কাছে ওর গল্পও শুনেছি।
- কিন্তু আজ আসেনি।
- তাই নাকি? কি হয়েছে?
- গত সপ্তাহ ধরে আসে না। ছেলেরা ঢিল মেরে ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।
- হায় আল্লাহ্! মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে? কি দোষ করেছে বুড়ি? একটা দু’টো মুরগীর হাড় ভিক্ষে চাওয়া ছাড়া তো আর কিছুই চাইতে শুনিনি।
- সেই তো! তারপরও ছেলেরা ওকে মুরগীচোর বলে বলে পেছনে লাগলো।
- কি আর বলবো! সময়টা ভাল নয়! শান্তবউ আমার! মন খারাপ করোনা। দেখবে কাল ও ঠিকই হাজির হবে।
শনিবার না এলেও, রোববার ঠিকই এলো বুড়ি। চেহারাটা আগের চেয়েও আরো বেশী মলিন। মাথায় একটি ন্যকড়া বাঁধা। তাতে রক্তের ছোপ্। আবারও মুরগী খেতে চাইল।
- আম্মাগো, মুরগীর সালুন খাইতে কইলজা পোড়ে! দিবেন নি আম্মা?
শান্তা রেখে দেয়া মাংসের কয়েকটি টুকরো ফ্রিজ থেকে বের করে দিল। বুড়ি প্লাষ্টিকের বাটিতে ঢেলে নিয়ে দোয়া করতে করতে চলে গেল। আবারও ছেলে মেয়েরা পেছনে লাগে কি না, সে ভয়ে দরজা অবধি এগিয়ে এলো শান্তা । এবার কিন্তু তেমন হলো না। বুড়িকে দেখেও ছেলেরা দূর থেকে তাকিয়ে রইল। বুড়ি ওদেরকে পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের রাস্তায় বাঁক নিল।
পরের শুক্রবার বাজার থেকে দু’টো মুরগী কিনে বাড়ী ফিরল জাহিদ। শান্তা অবাক হলো খুব। জিনিসপত্রের যা দাম, তাতে এতো বিলাসিতা করার সুযোগ কোথায়! ওদের তো একটিতেই বেশ চলে যায়। আর অতিথি কেউ আসার কথা থাকলে তো জাহিদ, আগেই জানাতো।
- কি ব্যাপার? দু’টো মুরগী আনলে যে আজ?
- হ্য, দু’টোই, একটা আমাদের, একটা বুড়ির।
- যাহ্!
- যাহ্ নয়। সত্যিই বউ! আজ বুড়ি ইচ্ছে মতো মুরগী খাবে। সঙ্গেও নিয়ে যাবে। ওর সামনেই জবাই করা হবে। ওর সামনেই রান্না হবে।
- আস্ত এক পাগল তুমি!
মনটা নরম মোমের মতো তরল হয়ে গেল শান্তার। এই পাগল লোকটা এত বেশী বোঝে তার তার মন! হোক না অভাবের সংসার, হোক না একঘেঁয়ে দৈনন্দিন জীবন। তারপরও এই লোকটা তার জীবনের কত বড় ঐশ্বর্য, তা প্রতিবারই সে টের পেয়েছে। এবারও আনন্দে জল গড়িয়ে এলো ওর চোখ বেয়ে।
কিছুক্ষণ পর বুড়ি এলো। তার জন্যে মুরগী কেনা হয়েছে শুনে অবাক হয়ে একবার শান্তার দিকে, আরেকবার জাহিদের দিকে তাকালো। বিশ্বাসই করতে পারছে না। তারপর কিছুক্ষণ ওদেরকে পরখ করে ঝুলিটি নামিয়ে বসলো মাটিতে।
একটি মুরগী ধরতেই কক্ কক্ করে উঠলো। শান্তা পাখা আর পা-দুটো মিলিয়ে ধরলো। জাহিদ ছুরি চালালো গলায়। রক্তের ফিনকিতে লাল হয়ে গেলো মাটি। মুরগীটি হাত থেকে মাটিতে রাখতে রাখতেই বুড়ির দিকে নজর পড়লো। আঁতকে উঠলো শান্তা। বুড়ি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে বোঁচকার উপর লুটিয়ে পড়ে আছে। ভয় পেয়ে দু’জনেই দৌড়ে গেল ওর কাছে।
মাথায় ও মুখে পানির ঝাপটা দেয়া হলো। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসলো বুড়ি। শীর্ণ, কুঁচকানো চোখের কোনে অঝোর কান্না। সে কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শীর্ণ শরীর। মুরগীটি মরণ যন্ত্রণায় তখনো ছটফট করছে ...।
- এই মুরগী আমি খামু-না আম্মা, এই মুরগী খাইতে পারুম না ...!
- তোমার জন্যে আনলাম, আর তুমি খাবে না!
- নাগো আম্মা, এই মুরগী আমার গলা দিয়া ঢুকব না।
- কেন? কি হয়েছে এই মুরগীর।
- মুরগীর কিছু অয় নাই, আম্মাগো! যুদ্ধের সময় হেরা আমার সোয়ামীরে এমুন কইরাই জবাই করছিল আমার সামনে। এই কাটা মুরগীডার মতোনই ছটফটাইয়া মরছিল আমার সোয়ামী!
- কারা করেছিল জবাই?
- রাজাকারেরা! আম্মা, রাজাকারেরা! ধইরা গলাডা কাইট্টা দিছিলগো...! কাইট্টা দিছিল...!
বলেই বোঁচকাটা নিয়ে ধীরে ধীরে কষ্টে উঠে দাঁড়ালো বুড়ি। আঘাত আর বিস্ময়ে হতবাক শান্তা ও জাহিদ কিছু বলার আগেই বাইরের গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। বেরিয়ে যাবার সময় অন্যান্য দিনের মতো আজ আর পেছন ফিরে তাকালো না।