‘যদি মরে যাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই
যে ফুলের নেই কোন ফল
যে ফুলের গন্ধই সম্বল
যে গন্ধের আয়ু একদিন
উতরোল রাত্রিতে বিলীন
যেই রাত্রি তোমারই দখল
আমার সর্বস্ব নিয়ে জ্বলে
আমার সত্তাকে করে ছাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই।’
অরুণ কুমার সরকারের লেখা এই কবিতাটা ফারিয়া লারার ভীষণ প্রিয় ছিল। যেটা আমারও এখন ভীষণ প্রিয়। ফারিয়া লারা কে, আমি জানতাম না। প্রথমআলো তে গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর 'খোলা কলম' পাতার মানে ১১নং পাতার উপড়ের ডান কোণাই 'স্মরণ' এ পড়েছিলাম তার কথা কবি কাজী রোজীর লেখায়। চোখে মনের কোনো আবেগে পানি চলে এসেছিলো সেটা পড়ে। কয় এক দিন আগে থেকেই মনে করছিলাম যে সামুতে একটা পোস্ট দিয়ে সেই প্রথমআলোর লেখা টা শেয়ার করবো সবার সাথে। এখন সময় পেলাম আর এই সেই লেখাটা -
................................................................................................
ফারিয়া লারার চতুর্দশতম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বৈমানিক ফারিয়া লারা মৃত্যুবরণ করেন বিমান দুর্ঘটনায়। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে এই স্মরণগাথা।
আমি ফারিয়া লারার কথা বলছি। আকাশ-পাতাল দলিত-মথিত করে যে আছে সর্বত্র আমার এবং আমাদের কাছে। ওর সেই ছোটবেলা থেকে বড়বেলা পর্যন্ত যা কিছু ঘটনাপরম্পরা, সবই নান্দনিক শিল্পীসত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। লারার ডায়েরি থেকে যেসব উচ্চারণ আমাদের সপ্রতিভ করছে, তার কিছু শব্দসম্ভার সবার জন্য রাখছি। ‘শুধু মেঘ আর মেঘ/শুধু আকাশ আর আকাশ/আমি শুধু জেনে গেছি/বড্ড সুন্দর এই পৃথিবীটা’—এ রকম উচ্চারণের সঙ্গে পাশে পাশে লারা লিখেছে ‘জীবন যেখানে থমকে যায়।’
লারার জন্মবার্ষিকীতে, ১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নিজের হাতে লাল কালিতে লিখে রেখেছিল নিজের জন্মের সময়, তারিখ ও সাল।
‘১৬ এপ্রিল ১৯৭০ সাল, রাত ১২.৪০ মি., বৃহস্পতিবার’
সঙ্গে সঙ্গে লারা লিখেছিল ‘সুন্দর জন্ম তুমি আরো সুন্দর হয়ে ওঠো।’ অদ্ভুত এক ঐশ্বরিক যোগাযোগের ওপর ভর করে লারা সবাইকে জানান দিয়ে ওয়ানওয়ে রাস্তা দিয়ে চলে গিয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। লারার ভেতরের নৈবেদ্যিক উপলব্ধির শক্তি সত্যিই যেন আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বিষয়টিকে ভাবতে চাই আমি, এ কেমন সত্যনির্ভর উচ্চারণ, যা হূদয়ের অন্তঃপুরে ভাঙচুর হলেও কেউ জানতে পারে না? যেটুকু জানা যায় তা হলো—‘আমি ঘ্রাণ শুঁকি অন্ধকার আলোর বাতাসে/ঘাসে ও মাটিতে/বাংলা আমার হূদয়ে হূদয়ে—ফারিয়া লারা।’
ফারিয়া লারার ডায়েরির পাতাগুলো কবিতার শব্দসম্ভারে ভরপুর। যেমন, ‘টাকার রোজগার না করতে হলে জীবনটা বেশ আশ্বিনের মিষ্টি রোদের সকালেরই মতো ধানী লাল ঘাসের মাঠে শিশির মাড়িয়ে আলতো সুখের পা ফেলে ফেলে হেঁটে বেড়িয়ে কাটিয়ে দিতাম। নদী থেকে নদীতে। মাঠ থেকে মাঠে। সকাল থেকে সন্ধ্যে।’ ‘চারদিকে টাকার জন্যে বড়ই দৌড়াদৌড়ি। তাড়াহুড়ো এই পৃথিবীতে। আমি সম্পূর্ণই বেমানান।’ এ লারার সংবেদনশীল উচ্চারণ তার নিজের মতো করে। অপর এক উল্লেখযোগ্য ভাষা তার, ‘পাগলের মনও মাঝেমধ্যে পাগল পাগল করে।’ এ ছাড়া অদ্ভুত এক উপলব্ধিতে তার উচ্চারণ, ‘মাঝেমধ্যে একা না থাকলে মানুষের মানুষী বুদ্ধিগুলো নষ্ট হয়ে যায়।’ এসব সরল বাক্য-বিনিময় লারাকে আজকের এই দিনেও প্রচণ্ড জীবন্ত করে আমাদের হূদয়তন্ত্রীতে নাড়া দেয়। লারা দেখে নেয়, বুঝে নেয় সবটা আমাদেরকে।
লারাকে নিয়ে কত কথা, কত শব্দবিন্যাস, কত নির্ভরযোগ্য উচ্চারণ। ড. হালিমা খাতুনের শিল্পবোধে সাজানো কথার কিছুটা এ রকম, ‘তুমি কবিতা হতে পারতে লারা/হতে পারতে আকাশ সমুদ্র অথবা নীলিমা/ হতে পারতে বিশ্বজয়ী শিল্পী/তুমি প্রজাপতি হতে পারতে/হতে পারতে সুসময় সারা পৃথিবীর জন্যে/হতে পারতে পরিপূর্ণ শস্যক্ষেত/...কেন তুমি পাখি হতে চেয়েছিলে লারা/তুমি তো আকাশে ছিলে দ্বিতীয়ার চাঁদ, সম্ভাবনায় উজ্জ্বল/কেন তুমি পাখি হয়ে হারিয়ে গেলে।’
মানুষের জন্য লড়াই করা মানুষ নাসরীন হক যখন দিব্যি উচ্চারণ করেন, ‘লারা/রাইজ আপ এগেইন/ইউ উইল নট বি গ্রাউন্ডেড/ইওর স্পিরিট ইজ ফ্রি/ডু ইওর ম্যাজিক/ফ্লাশ আস্ দ্যাট ম্যাগনিফিকেন্ট স্মাইল/সো দ্যাট উই টু ক্যান লার্ন টু ফ্লাই/অ্যান্ড রিচ আউট ফর দ্যা স্কাই।’ ভেতরের তীব্র দহনজ্বালা ভুলিয়ে লারা যেন স্বর্গ থেকে উঁকি দেয় আমাদের মাঝে। তৈরি করে শুচিশুভ্র বেড়াজাল, মায়াবী পর্দার মতো যা দুলে ওঠে।
এখন আমি ফারিয়া লারা স্মারক গ্রন্থখানির পাতায় পাতায় চোখ রাখছি। ভিজে যাচ্ছে চোখের পাতা। আজ এত বছর পরে শুধু নয়, যে যখন বিষখালী নদীর পানি ছুঁয়ে কথা বলবে, লারা জবাব দেবে, ও সেখানেই আছে। বরগুনায় আছে, ডৌয়াতলায় আছে, লারা ফাউন্ডেশনে আছে, শ্যামলীর ঘরময় সর্বত্র আছে। কত নাম, কত জন, কত জানাশোনার কথা বিধৃত হয়েছে ফারিয়া লারা স্মারক গ্রন্থ-এ। মা সেলিনা হোসেন, বাবা আনোয়ার হোসেন, বড় বোন লাজিনা মুনা, ছোট ভাই সাকিব আনোয়ার—যাঁদের নিয়ে ফারিয়া লারার সাজানো জীবন, তাঁরা সব সময়ই নড়েচড়ে কথা বলে ওঠেন—ফারিয়ার কথা, লারার কথা। সারা দিন সারা রাত সারাক্ষণ জুড়ে তুমি আছ ফারিয়া লারা। তুমি আছ একটু একটু করে চিরে চিরে সবটা অস্তিত্বজুড়ে।
লারা, তোমার ডায়েরির পাতায় জনৈক কবি অরুণ কুমার সরকারের লেখা কবিতার অংশ, যা তোমার ভীষণ প্রিয়, পাঠকের জন্য নিবেদন করলাম—
‘যদি মরে যাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই
যে ফুলের নেই কোন ফল
যে ফুলের গন্ধই সম্বল
যে গন্ধের আয়ু একদিন
উতরোল রাত্রিতে বিলীন
যেই রাত্রি তোমারই দখলে
আমার সর্বস্ব নিয়ে জ্বলে
আমার সত্তাকে করে ছাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই।’
টোকা দিলেই ঝরে যাবে এ রকম ফুল তুমি নও লারা, আমি জানি। তুমি সবার কাছে এক ঐশ্বরিক আনন্দের ফুল।
কাজী রোজী
কবি
ফারিয়া লারার জন্য - প্রথমআলো
ফারিয়া লারা - উইকিপিডিয়া
লারাকে কি মনে পড়ে? - প্রথম আলো
পাইলট ফারিয়া লারার স্মরণ সভা - দৈনিক যুগান্তর
লারা
পাঠকের ডায়েরীঃ লারা
আকাশে ওড়ার স্বপ্ন - দৈনিক ইত্তেফাক
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ৩:০৩