আমাদেরকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু কেন? আমাদের শক্তি কি অন্য প্রাণীদের তুলনায় বেশী? আমরা কি পারি পাখির মতো আকাশে উড়তে কিংবা মাছের মতো পানিতে সাঁতার কাটতে? আমরা কি পারি চিতাবাঘের মতো দৌড়াতে? আমাদের ঘ্রানশক্তি, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি কোনো কিছুইতো অন্য প্রাণীদের তুলনায় প্রখর না। তারপরও কেন আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব? শ্রেষ্ঠত্ব যদি থাকে তা শুধু একটা কারনে। আমরা চিন্তা করতে পারি। আমরা পারি আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। আমরা পারি আমাদের সৃজনশীলতাকে ব্যাবহার করে নতুন নতুন রহস্যের উন্মোচন করতে। যা অন্য কোন প্রানী পারে না। আর দাবা খেলাটা সম্পূর্ণ চিন্তা শক্তিরই খেলা। তাই যারা ভাবে দাবা একটা অলস কিংবা অপ্রয়োজনীয় খেলা তাদের উদ্দেশ্যে বলব, দাবাই এমন একটা খেলা যার মাধ্যমে মস্তিস্কের নিউরনে সবচেয়ে বেশি অনুরণন ঘটে। শুধুমাত্র চিন্তাশক্তির কারনে আমরা যদি হই সৃষ্টির সেরা জীব তাহলে দাবা হওয়া উচিৎ সব খেলার সেরা খেলা। একদম ছোট বেলা থেকেই যদি কেউ দাবা খেলাটা রপ্ত করে এবং নিয়মিত এই খেলার চর্চা করে তাহলে অনেকভাবেই সে উপকৃত হতে পারে। কারন এই খেলার ফলে আমাদের ব্রেনের কার্যক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি তৈরি হয় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা,বাড়ে ধৈর্য, মনঃসংযোগ ও সৃতিশক্তি। যা ভবিষ্যতে আমরা যে পেশাতেই যাই না কেন আমাদের সাফল্য লাভে সহায়তা করবে। কারন একজন মানুষ তার সাফল্যের চুড়ায় তখনি উঠতেপারে যখন সে তার চিন্তাশক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে। আমাদের দেশেতো এই খেলাটার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশী কারন যত্রতত্র বিল্ডিং, কল-কারখানা হওয়ার ফলে ঢাকাসহ অন্যান্য বড় বড় শহরে এখন মাঠ নেই বললেই চলে। তাই দাবাই হতে পারে আমাদের ছেলেমেয়েদের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম।
দাবা খেলার উৎপত্তি হয়েছিলো কিন্তু এই ভারতবর্ষেই। তবে কে বা কারা এই খেলার আবিষ্কারক তা কেউ জানতে পারেনি। যেই হোক সে যে অনেক বুদ্ধিমান ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। দাবা খেলা আবিষ্কারের প্রচলিত একটা গল্প চালু আছে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে একজন ক্রিড়ানুরাগি রাজা ছিলেন। রাজকার্যের ভারিক্কী বিষয়ের চেয়ে খেলাধুলার প্রতিই তার আগ্রহ ছিল বেশী। কিন্তু সেই সময়ের সাদামাটা খেলাগুলো রাজাকে খুব বেশী টানত না। রাজা চাইতো আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামুলক মজার কোন খেলা। সেই রাজ্যে বাস করতো খুব বুদ্ধিমান একজন গণিতবিদ। সে অনেক মাথা খাটিয়ে যুদ্ধের আদলে তৈরি করলো খুব মজার একটা খেলা, নাম দিলো তার চতুরঙ্গ। । চৌষট্টি ঘরে বুদ্ধির মারপ্যাঁচে রাজাকে মাত করার সেই চতুরঙ্গই আজকের দাবা। রাজামশাই এই খেলা দেখেতো যারপরনাই মুগ্ধ। গণিতবিদের কাছে জানতে চাইল, কি চায় সে? যা চাবে তাই তাকে দেয়া হবে। গণিতবিদ উত্তর দিল, “আমি শুধু চাই আমার চতুরঙ্গের প্রথম ঘরে একটা চালের দানা, দ্বিতীয় ঘরে দুটি, তৃতীয় ঘরে ৪টি এইভাবে ৬৪টা ঘরে চালের দানা দিয়ে পূর্ণ করে দেয়া হোক”। রাজা অবাক হয়ে বলল, “শুধু এই? তুমি চাইলে তোমাকে আমি সোনারূপা, মণিমুক্তা দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারি” গণিতবিদ জানালো এই চালের দানাই তার জন্য যথেষ্ট। রাজা তার কর্মচারীকে আদেশ দিল গণিতবিদের শর্তমতো তাকে যেন সব চাল দিয়ে দেয়া হয়। কিছুক্ষন পর রাজ্যের সব উজির-নাজিররা এসে জানালো রাজ্যে যে পরিমান সম্পদ আছে তার সবকিছুর বিনিময়েও গণিতবিদের এই দাবি পুরন করা সম্বব না। এখন আপনারা যদি জানতে চান আসলে ঠিক কি পরিমান চাল এই ৬৪ ঘরে প্রয়োজন তাহলে একটু কষ্ট করে তা নিজেরাই হিসেব করে বের করে ফেলুন। রাজার পক্ষে গণিতবিদের এই পাওনা মিটানো সম্ভব ছিল না তবে তার কৌশলে মুগ্ধ হয়ে গনিতবিদকে তার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। গল্পটা যদিও কাল্পনিক কিন্তু বেশ মজার।
এখন আমাদের দেশে ক্রিকেট নিয়ে অনেক মাতামাতি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক সাফল্য বয়ে আনছে ক্রিকেট। সাকিব, তানিম, মাশরাফিদের চিনে না এরকম লোক খুজে পাওয়া মুশকিল। অথচ আমাদের দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রে প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য আসে কিন্তু দাবার হাত ধরে। ১৯৮৭ সালে নিয়াজ মোরশেদ এই উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে রানি হামিদ অর্জন করেন মহিলা আন্তর্জাতিক মাস্টার খেতাব। তখন শুধু দাবাতেই নয় দেশের পুরো ক্রীড়াঙ্গনেই সাফল্যের কাণ্ডারি ছিল এই দুজন। তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই অনেক খেলোয়াড় (আমি নিজেও) দাবাকে নিজের পথ হিসেবে বেছে নেয়। এরপর আমরা পাই আরও ৪ জন গ্র্যান্ডমাস্টার, ৩ জন আন্তর্জাতিক মাস্টার, ১৪ জন ফিদে মাস্টার, ১ জন মহিলা আন্তর্জাতিক মাস্টার, ৬ জন মহিলা ফিদে মাস্টারসহ ২৪২৯ জন আন্তর্জাতিক রেটিংপ্রাপ্ত দাবা খেলোয়াড়। বিশ্বের ১৭৩ টা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৬৫তম। বিশ্ব দাবায় আমাদের বর্তমান অবস্থান এখন অনেকটা নিম্নগামী। কারন দীর্ঘসময় ধরেদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো নতুন কোনো খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না। গত ২০ বছর যাবত প্রায় একই খেলোয়াড় নিয়ে বিশ্ব দাবায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে। দাবা যদিও বয়সের খেলা না তারপরও তারুণ্যের মেধা ও শক্তির কাছে কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। তাই এই লেখার মাধ্যমে আমি সমস্ত শিশু-কিশোরদের এই বুদ্ধির লড়াইয়ে শামিল হওয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে আমাদের দেশের দাবার পতাকা দেখতে চাই তরুন প্রজন্মের হাতে। তাহলে আর দেরি কেনো? আজ থেকেই শুরু হয়ে যাক বুদ্ধির লড়াই।