ভাগ্য বিধাতা বলিয়া যে অপদার্থ কিংবা অপার্থিব বস্তু পার্থিব জগতে প্রচলিত আছে তাহা আমার জাগতিক কালে কোন সু সময়ের জন্য আসিয়াছে বলিয়া স্মরনে আসিতেছে না। অথচ কত জনের কাছে তাহা কি নির্নিমেষ চিত্তে ধরা দিয়াছে বলিয়া কেবল শুনিয়া শুনিয়া অস্থির হইয়াছি। তাহাদের নিকট নাকি “জাদুর কাঠি” রহিয়াছে বলিয়াও জনশ্রুতি আছে। আর আমি ঘুম থেকে উঠিয়া রান্নার কাঠি হাতে লইয়া সেই সব ভাগ্য ভোগ্যাদের কথা ভাবিতে ভাবিতে কেবল ভারাক্রান্ত হইতেছি।
এমনি সময় হঠাৎই উনুনের দিকে তাকাইয়া দেখি আগুনের লেলিহান শিখা যাহা কিছু কাল পূর্বেও ছিল তাহা কেবলই শিখায় পর্যবসিত হইয়াছে। তাহার লেলিহান টা কখন কোন কালে লোপ পাইয়াছে তাহা বলিতেও পারিবনা।
সকাল সকাল এ কোন বিপত্তি। চাল ভাতে পরিনত হইতে এখনও ঢের বাকি। বুক হইতে দীর্ঘশ্বাস আপনিই বাহির হইয়া গেল। মনে পড়িল অন্য এখকানা বোতলে দু-আঙ্গুল তেল রাখিয়াছিলাম সংকটে কাজে লাগিবে বলিয়া। নিজের বিচনতায় আজ নিজেকে লইয়া বেশ গর্ব হইল। তরিৎ বোতল হইতে অবশিষ্ট তেল ঢালিয়া চালকে ভাতে রুপান্তরকে ত্বরন্বিত করিতে লাগিলাম।
সকাল বেলা সময়টা যেন ঝাপাইয়া ঝাপাইয়া চলিয়া যাইতে থাকে। তাহার সাথে তাল মিলাইতে পেয়াঁজ ছিলিতে গিয়া খানিকটা হাতও ছিলিয়া ফেলিলাম। তথাপি তাকাইবার সময় নাই। কোন ক্রমে অন্ন পাপ করিয়া আপিস যাইবার উদ্যোগ লইলাম। কে যেন বলিয়াছিল প্রয়োজনের কালে বিষ্টাও খুঁজিয়া পাওয়া যায়না। চশমা টা খানিক আগেও কোথায় যেন দেখিয়াছিলাম। এখন পাইতেছিনা। ঘড়িতে সময় কেবলি বহিয়া যাইতেছে। ধীরে ধীরে সংযম লোপ পাইতে লাগিল। কিন্তু কাহার উপর অসংযম হইব! এই গন্ড গ্রামে আমার আমি ছাড়া আর রহিয়াছে কে?
চশমা না পাইয়া ক্ষোভে উপরের পানে অনুচ্চ স্বরে কিছু বলিয়া চাবি হাতে লইতে গিয়া দেখি চশমা খানা তাহার পাশেই চোখ খুলিয়া শোভা বর্ধন করিতেছে। কিছু আর ভাবিবার সময় হাতে নাই। দ্রুত বেগে দরজা লাগাইয়া আপিসের পথ লইলাম।
শুনিয়াছি দূভাগ্য যখন কাহারো দ্বারে হানা দেয় তখন সেই অলীর হাত হইতে রা করিবার জন্য বিধাতা নানা রূপে আসিয়া সাবধান করিয়া দেয়। তাই হয়ত পথিমধ্যে পক্ষিকূল আসিয়া মস্তকে অশির্বাদ স্বরুপ মল দান করিয়া গেল। বিধাতার ইঙ্গিত বুঝিলাম না তখন। রাগে ব্রক্ষ্মতালু উদ্বগিরন করিতে লাগিল। কোনরকমে পরিস্কার করিয়া কেদারস্থ হইলাম।
আজ যেনো সব হারাইবার দিন শুরু হইয়াছে। কোন কিছুই জায়গামত খঁজিয়া পাইতেছিনা। কলম খানার যেনো পা গজাইয়াছে, কাগজুগলোর পাখা, আর গননা যন্ত্রের যেন আজ বিশ্রাম লইবার দিন। যতবারই গুনিতে যাই উহা কোন রকম আভাস না দিয়া বন্ধ হইয়া যায়।
ইত্যকার যন্ত্রনায় যখন বিদ্ধ হইয়া বিত হইয়া যাইতেছি তখনি মনে হইল আরে! ইহা হয়ত বিধাতারই কোন ইঙ্গিত হইবে। বড় ধরনের কোন বিপদ মনে হয় সন্নিকটে। অতঃপর সাবধান বৎস। ধীর স্থির হও। কাজে মন লাগাও। মারিবার আগেই মরিয়া যাইওনা।
মনে সাহস আনিলাম। খুব সন্তর্পনে কর্মযজ্ঞে ঝাপ দিলাম। একটা জ্ঞান বাক্য শুনিয়াছিলাম কাহার কাছে যেনো। বলিয়াছিলেন, মশাই কখনো ঘোড়ার পেছনে আর বড় কর্তার সামনে দিয়া অকারনে হাটিবেন না। ঘোড়ার পেছনে থাকিলে লাথি খাইতে হইতে পারে আর বড়কর্তার সামনে থাকলে অনাবশ্যক হুকুম শুনিতে হইবে।
কথা খানা বেদবাক্যের মত মানিয়া আজ চলিতে লাগিলাম। কিন্তু তাতে কি আর দূভাগ্য পিছু ছাড়ে!!
হঠাৎ ই মেনিমুখো বড়কর্তার ঘরে ডাক। আমার কেশ লইয়া খানিক শ্লেষক্তি করিয়া একখানা কাজের ফর্দ ধরাইয়া দিলেন। যাহাতে তাহার স্বহস্তে রচিত ভুল ইংরেজিতে সমৃদ্ধ দূর্বোধ্য রচনা। উহাকে এক্ষুনি সম্পাদন করিয়া দূর দেশে পাঠাইতে হবে।
প্রমোদ গুনিলাম!! নাহ! লিখিবার ভয়ে নহে - এই রচনা খানা পড়িবার ভয়ে। কারন উহা তো কেবল মিশরীয় সভ্যতার সভ্য লোকেরাই পড়িতে পারিবে। নিজের সকল মেধাকে ডাকিয়া জড় করিয়া পড়িতে পড়িতে লিখিতে লগিলাম। এই দিকে আমার টেবিলে ক্রমেই ভিড় জমিতে লাগিল। এ অঞ্চলের তাবৎ লোকের কর্জ মনে হয় আজই লাগিবে। কাহারো বিবাহ, কাহরো শ্রাদ্ধ, হাপাঁইয়া উঠিলাম। একদিকে বড়কর্তার ফরমায়েশ, অন্যদিকের ক্রেতাদের তাগাদা। মনে হইতেছিল হাত যদি দুখানা না হইয়া চারখানা হইত তবে হয়ত সকলকে খুশি করিতে পারিতাম। ক্রমাগত একেকজনের তাড়নায় তাড়িত হইয়াও ত্বরিত গতিতে কিছুই করিতে পারিতেছিনা। অস্থির হইয়া গেলাম। তথাপি ধৈর্য্য হারাইতে হারাইতেও তাহা সংবরন করিবার আপ্রান চেষ্টা করিলাম। জানি ধৈর্য্য খানা পালাইলেই সর্বনাশ অনিবার্য।
সকলের সাথে রাগারাগি গালাগালি ও গলাগলি করিয়া শেষ পর্যন্ত ঠেকাইতে পারিলাম। সকল কর্ম যখন সমাধা হইয়ল তখন দৃষ্টি বাহির পানে লইয়া সব অন্ধকার দেখিলাম। সূর্যের আলো নিবিয়া গিয়াছে বহু আগে। রাস্তার বাতিগুলোও মৃদু আলো ছড়াইয়া তাহার সত্যতা পোক্ত করিতেছে। সারা শরীরে অববর্ননীয় অবসাদ নামিয়া আসিল। সকালের অন্নপাপ এতই অধিক হইয়া গিয়াছিল যে আর পাপ করিবার কোন সুযোগ সারাদিনে মেলেনি। কোন ক্রমে শরীর মহাশয়কে টানিয়, হেচঁড়াইয়া ঠেলিয়া ঠেলিয়া বাসা পর্যন্ত লইয়া ঠেকাইলাম।
আবার বিপত্তি। তালায় যেই না চাবি লাগাইলাম বিদ্যুতের সেই দৃশ্য যেন সহ্য হইল না। অন্ধকারে নিমজ্জিত করিয়া পালাইয়া গেল। দরজা খুলিয়া হাতড়াইয়া আতিপাতি করিয়া যখন ম্যাচ খুঁজিতেছি তখন কোথা হইতে যেন এক অকালকুষ্মান্ড জলের গেলাস হাতের ছোয়া পাইবার জন্য ছুটিয়া আসিল। অতঃপর তাহার পতন অনিবার্য হইয়া গেল। খান খান হইয়া ভাঙ্গিয়া গেল। তাহার মাঝে থাকা জল নির্দিষ্ট আশ্রয় না পাইয়া সারা ঘরময় নিজের আশ্রয় ভাবিয়া ছড়াইয়া পড়িল। অভিযোগ বা অনুযোগ জানাইবার জন্য মনের সকল শক্তি আগেই লোপ পাইয়াছে। থাকিলে তাহা কোন অভদ্র সমাজেরও শ্রবনযোগ্য হইত বলিয়াও মনে হয়না। মেঝের এক কোনে চুপটি মারিয়া বসিয়া রইলাম। আর মনে মনে সাত-পাঁচ ভাবিতে লাগিলাম। কিছুকাল পর পর কি ভাবিতেছি তাহা ভুলিয়া সেই ভুলিয়া যাওয়া ভাবনাকে খুজিঁতে লাগিলাম। মনঃপ্রদীপের তেলও ফুরাইয়া আসিতেছে - ক্লান্তি রক্ত কনিকায় মিশিয়া তার মজ্জায় মজ্জায় প্রবেশ করিয়া একাকার হইয়া গিয়াছে।
বিদ্যুত আসিবা মাত্র তড়াক করিয়া উঠিয়া দাড়াইলাম। রোখ চাপিয়া গিয়াছে। এমন পরিহাসকে আমি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাই।
উনুন ধরাইয়া রাধিতে লাগিলাম। আর ভাবিতে লাগিলাম সকলে কত অবহেলা অবজ্ঞা করিয়া মায়ের হাতের রান্না গলদঃগরন করে। আমি নিজেও কতবার তাহার রান্না লইয়া কটা করিয়াছি। অথচ ইহার মাঝে যে কত কঠিন শিল্প সাধনা, কত নিবিড় কর্মযজ্ঞ, কি সু তাহার সমন্বয় তাহা এখন বেশ বুঝিতে পারি। মায়ের জন্য একটু বেদনার্ত হইয়া গেলাম। আর সেটাই হল কাল। আমি দেখিয়াছি যখনই আমি বেদনায় অচ্ছন্ন থাকি তখনই বিধাতা তাহাতে প্রলেপ লাগাইবার বদলে খুঁিচয়া খুঁচিয়া আরো বাড়াইবার চেষ্টায় লিপ্ত হইয়া যায়। জানিনা আমার সাথে তাহার কি শত্রুতা নাকি সখ্যতা রহিয়াছে। আর তাহারই ফল স্বরূপ ভাত নামাইতে গিয়া কাপড় জড়াইবার কথা বিস্মৃতি হইয়া গেল। খালি হাতে পাতিল ধরিয়াছি। ছ্যাৎ করিয়া গোটা চারেক আঙ্গুল পুড়িয়া গেল। হাত হইতে পাতিল ফস্কে উনুনের উপর পড়িয়া গেল। উনুন তাহার ভার সহ্য করতে না পারিয়া চিৎকার করিয়া চিৎপটাং হইয়া গেল। আর ভাতে যেন তাহা কোন ক্রমেই সহ্য হইলনা। তীব্র অপমানের জ্বালায় পাত্র হইতে বাহির হইয়া মেঝেময় গড়াগড়ি করিতে লাগিল। খুব আনন্দে মানুষের যেমন আনন্দাশ্রু আসে, অতি দুঃখে আমার তেমনি দুঃখহাস্য আসিল। যতখানি পরিস্কার সম্ভব উঠাইযা লইলাম। হাতে যে মলম লাগাইব তাহাও নাই। তথাপি পানিতে অনেন চুবাইয়া তাহার কিছুমাত্র সংস্কার করিবার চেষ্টা করিলাম।
অনেক হইয়াছে। আর সহ্য হয়না। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির লাগিতেছে। মাথা বন বন করিয়া ঘুরিতেছে। আহার্য্য যাহাই খাইবার যোগ্য রহিয়াছে তাহা লইয়া বসিয়া পড়িলাম।
ভাবিতে লাগিলাম, দিন তো অতিক্রান্ত হইয়াছে। রাত্রিও বেশ হইয়াছে। সকাল হইতে অদ্যবধি যাহা অনিষ্ট হইয়াছে তাহা এক দিনের হিসেবের কোটা তো পূরন হইয়াছে সঙ্গে উপরিও মিলিয়াছে। এইবার তো ক্ষন্ত দাও বিধাতা।
বিধাতা শুনিলেন আমার সেই অমোঘ উক্তি। কচাৎ করিয়া দন্তপৃষ্টে পিষ্ট হইয়া তীব্র ঝাল নির্গত হইল মরিচ হইতে। বহু কাল ঝাল খাইয়া অভ্যস্ত হইবার পরও আমার চোখ মুখ বোধ করি লাল হইয়া উঠিল। দম যেন বন্ধ হইয়া যাইতে নিল। ঝট করিয়া হাতে পাশের বোতলে মুখ লাগাইয়া দুই ঢোক জল গিলিয়া তাহা নিবৃত করিবার চেষ্টা করিলাম। চুপটি করিয়া বলিয়া রখি। উহাও জলের পরিচয় বদলাইয়া সোয়াবিন তেল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করিল। বাদবাকি যাহা হইল তাহা বোধকরি না বলাই বিচক্ষন হইবে।