শেষ রাতের নীরবতাকে ভেঙ্গে দিয়ে প্রচন্ড গর্জনে উড়ে যায় বিমান, ঘুম ভেঙ্গে যায় এক বৃদ্ধের। কাঁপা হাতে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে চুমুক দেন তিনি, নিজের অস্থিরতা কমানোর জন্য ... এভাবেই শুরু হয় তারেক মাসুদ পরিচালিত সর্বশেষ ছবি "রানওয়ে"।
পুরো মুভির গল্প আবর্তিত হবে যে চরিত্রকে ঘিরে সেই রুহুলের হতদরিদ্র পরিবারের একটি সকাল থেকেই শুরু হয় রানওয়ের পথ। গ্রামের ভিটেমাটি বিক্রি করে শহরে আসা রুহুলের পরিবার থাকে এয়ারপোর্টের উত্তরে, এক বেড়ার ঘরে। তার কিছুদূর সামনে বিমান বন্দরের রানওয়ে। সকাল-বিকাল গর্জন করে বিমানগুলো আকাশে উড়ে যায়, ফিরে আসে। এরই মাঝে এগিয়ে চলে কিছু মানুষের গল্প। রুহুলের বাবা বিদেশ গেছেন মাস খানেক আগে। কিন্তু এরপর আর কোন খোঁজ নেই। রুহুলের বোন ফাতেমা গার্মেন্টসে চাকরি করে। এনজিও থেকে ঋন নিয়ে গরু কিনে, সেই গরু আর সংসার সামলাতেই দিন যায় তার মায়ের। বৃদ্ধ দাদা নিশ্চল বসে থাকেন তাদের স্থবিরতা কিন্তু আপাত স্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে। মাদ্রাসায় দাখিল পর্যন্ত পড়া রুহুলের পরীক্ষা দেয়া হয় নি গ্রাম থেকে চলে আসার কারনে। প্রতিদিন মামার দোকানে কিছুক্ষন ইন্টারনেট শেখার চেষ্টা করে যে কোন রকম একটা চাকরীর সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় রুহুল। কিন্তু দিনশেষে তার ঘোরাঘুরিই কেবল সার হয়। রুহুলের বাসায় ফেরার পথে এক কিশোরের গুলতি হাতে বিমান কে তাক করার এক অসাধারন শট এর মাধ্যমে পরিচালক যে রুহুলের বিপর্যস্থ , অসহায় অবস্থা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তা প্রমানিত হয় দর্শকদের বিপুল করতালি দেখে! রুহুলের চাকরী হয় না, ফাতেমার গার্মেন্টসে বেতন নেই , রুহুলের মা গরুর দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে ঋনের কিস্তি জোগাড় করতে পারছেন না, এরকম এক দমবন্ধ অবস্থার দিকে পরিচালক যখন টেনে নিয়ে যাচ্ছেন দর্শকদের, তখনই এক ঝটকায় আবার আলোর রেখা! ফাতেমা বেতন পেয়ে তা তুলে দেয় মায়ের হাতে। শোধ হয় ঋনের কিস্তি, আবার চলতে থাকে জীবন সংগ্রাম।
ফাতেমার বান্ধবী শিউলির দিকে রুহুলের মু্গ্ধ দৃষ্টির যে চমৎকার শটটি দেখা যায় , তা মনে করিয়ে দেয় ভালো লাগার মানুষগুলোর প্রতি আবেগের প্রকাশ চিরন্তন, একই রকম উচ্চবিত্ত থেকে নিম্ন বিত্ত পর্যন্ত! তাইতো আবারো সম্মিলিত অভিনন্দনের শব্দ! একদিন কথায় কথায় রুহুল জানতে চায় শিউলীর কাছে তার কোন পছন্দের মানুষ আছে কিনা!, জবাবে শিউলী বলে, "আছে তো! কিন্তু হ্যার তো কোন চাকরী বাকরী নাই!" রুহুলের উত্তর, "ক্যান তুমি তারে চাকরী কইরা খাওয়াইবা!"।শিউলীর জবাব আসে, "সে যদি রাজি না হয়! "উত্তরে রুহুলের মুচকি হাসি এবং আবারো বিপুল করতালির শব্দ! পরক্ষনেই শিউলীর কথা, "আইচ্ছা ওই এয়ারপোর্টে তুমি চাকরী করতে পারো না? আমার খুব ভালো লাগে!" উত্তরে হাসে রুহুল। আপাত ভাবে খুব সামান্য এই কথাটিতেই যে পুরো সিনেমার কলকাঠি নড়বে তা বোঝা যায় একটু পরেই!
মামার দোকানে ইন্টারনেট চালানো শিখতে গিয়ে রুহুলের পরিচয় হয় আরিফের সাথে। মার্জিত , ভদ্র , ভার্সিটিতে পড়ুয়া (যদিও সে জানায় এখন আর সে পড়ছে না) এই তরুন খুব সহজেই তার ব্যবহার দিয়ে প্রভাবিত করে ফেলে রুহুলকে। শুরু হয় এবার অন্য গল্প আরিফের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে থাকে রুহুল। ইসলামের সঠিক পথ দেখানোর নামে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তাকে নিয়ে যায় আরিফ। ধর্মের নামে মিথ্যাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে রুহুল। এখানে উল্লেখ্য যে পরিচালক আরিফকে কিন্তু একজন শিকারী হিসেবে উপস্থাপন করেননি, বরং আরিফ নিজেও অন্যদের শিকার, বিভ্রান্ত, যে আরো অনেককে তার পথে আনতে চায় নিজের আদর্শের প্রতি বিশ্বাস রেখেই! অর্থাৎ এতটাই ভয়াবহ ব্রেইন ওয়াশের শিকার এক সময়কার মেধাবী , ভার্সিটি পড়ুয়া এই তরুন! এর মধ্যেই এক ব্যক্তির কাছে রুহুলকে নিয়ে যায় আরিফ। যিনি নাকি, "উর্দু ভাই" নামে পরিচিত। সেখানে রুহু্লের দরিদ্রতার সুযোগ নিতে এক মুহুর্ত ও দ্বিধা করে না সেই উর্দু ভাই। তাকে দেয়া হয় এয়ারপোর্টে সিকিউরিটির চাকরীর টোপ! এই টোপ ফেলেই রুহুলকে নিয়ে যাওয়া হয় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশিক্ষনের জন্য এক প্রত্যন্ত এলাকায়। এই ক্ষেত্রে খুব চমৎকার এক শট দেখান আমাদের পরিচালক। নৌকা থেকে নেমে যখন অন্য সবাই হাঁটা পথ ধরেছে সেখানে সেই "উর্দু ভাই" এবং তার সাগরেদ হুন্ডায় চড়ে বসে! তারা চলে যায় হুন্ডায় আর দরিদ্র রুহুল কিংবা বিভ্রান্ত আরিফ দৌঁড়তে থাকে তাদের সাথে তাল মিলাতে! মাত্র একটা শটের মাধ্যমে এই উর্দু ভাই এর সুবিধাবাদী , ভন্ড চরিত্রের যে উপস্থাপন পরিচালক করেছেন তা সত্যি অসাধারন।
পরিবার থেকে ক্রমেই দূরে সরতে থাকে রুহুল। এমন ভাবেই বিভ্রান্ত আজ সে, শিউলী যখন তাকে বলে তার বাবা তাকে এক নেশাখোরের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে তখন ও রুহুল থাকে নির্বিকার। ওদিকে আরেকটি শটে আমরা দেখতে পাই আরিফের স্ত্রীকে। সে এসে জানায় ,আরিফের মা অসুস্থ । বিষন্ন আরিফ কিছুক্ষন চুপ থেকে জানায় , এ পথ থেকে ফেরার উপায় তার নেই। রুহুলের আচরন তার পরিবারের কাছে হতে থাকে রহস্যময়। পরিবার অন্তঃপ্রান এ ছেলেটাকে বোঝানোর , জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তার দাদা, রুহুল পুরো্পুরি জড়িয়ে যায় জঙ্গীবাদের সাথে।
আরিফ ও তার সহযোগীরা মিলে বোমা হামলা চালায় সিনেমা হলে। এরপর তারা তৈরি হতে থাকে বিচারক হত্যার আত্বঘাতী মিশনে। এর মধ্যেই উন্মোচিত হয় সেই উর্দু ভাইয়ের আসল মুখোশ। এক রাজনৈতিক নেতার সাথে কথোপথনে স্পষ্ট হয় আসলে ইসলাম নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই তার এই কর্মকান্ড! সেই রাজনৈতিক নেতা তাকে হুমকি দেন বিচারকদের কিছু না করতে। যদি তারা কিছু করে তবে তিনি তাদের ছাড়বেন না। কিন্তু ততক্ষনে তৈরি হয়ে গেছে ফ্রাঙ্কেস্টাইন। তাইতো যিনি এই উর্দু ভাই তৈরি করেছিলেন তার হাতে এখন আর নিয়ন্ত্রন নেই!। এদিকে লুকিয়ে থাকার জন্য বিশ্ব ইজতেমায় মিশে যায় উর্দু ভাই এবং রুহুলেরা। কিন্তু এখানেই এক অসাধারন কাজ করেছেন তারেক মাসুদ! ধর্মের নামে এই সহিংসতা যে ইসলাম সমর্থন করে না, তা তিনি জানিয়ে দিলেন তাবলীগের সময়ে কয়েকটা মাত্র লাইন দিয়ে। তখন বয়ান চলছে, সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠে ইংরেজি সাবটাইটেল, বাংলা শব্দ কানে আসে দর্শকের, " ইসলামের নামে যা (সহিংসতা , বোমাবাজি) শুরু হয়েছে এখন তা ইসলাম সমর্থন করে না। এসব শুধু মুসলমানদের দুর্দশাই বাড়াবে, শত্রুরা আমাদের জন্য ফাঁদ পেতেছে এগুলোর মাধ্যমে। তারা চায় আমরা যাতে এই ফাঁদে পা দেই ....." কি অসাধারন! পরিচালক কি নিপুন দক্ষতায় দেখিয়ে দিলেন ইসলাম আমাদের প্রতিপক্ষ না, আমাদের প্রতিপক্ষ এই ইসলামের নামে সুবিধাবাদী , ভন্ড "উর্দু ভাই " এর মত লোকেরা।
কিন্তু থেমে থাকেনা উর্দু ভাই। আরিফ প্রস্তুত হয় হামলার জন্য। নির্ধারিত দিনেই হামলা হয় বিচারকদের উপর। এই সময়ে একটা শটে দেখা যায় , আরিফ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, দু'পাশে অদ্ভুত সুন্দর সরিষা ক্ষেত। আরিফ চলে যেতে থাকে, লং শটের ভাষা দিয়ে আরিফের এই চলে যাওয়াকে এত সুন্দর বিষন্নতায় দেখিয়েছেন পরিচালক তা সত্যিই সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়ার মত। হামলার পর দেখা যায় আরিফের সাইকেলটি ছিন্ন ভিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। উর্দু ভাই এর সাথে বসে টিভিতে আরিফের আহত , ছিন্ন-ভিন্ন দেহ দেখে শিউরে ওঠে রুহুল। সেই রাতেই সরে পড়ে উর্দু ভাই সহ তার চ্যালারা, পুলিশের ভয়ে। অনেক করে বলার পর ও সেখানেই রয়ে যায় রুহুল। পুলিশ আসে না। সারা রাত নিজের সাথে বোঝা পড়া হয় রুহুলের। নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর পায় রুহুল, যার নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে এক নেশাখোরের হাত থেকে রক্ষার ক্ষমতা নেই সে কিভাবে পুরো জাতিকে রক্ষা করবে? যার নিজের পরিবারকে নিয়ে চিন্তা নেই, তার কারনে জেলে যাওয়া মামার জন্য আফসোস নেই , যে নিজে স্বার্থপরের মত শুধু বেহেশতের কথা চিন্তা করছে সে কোন উপকারে আসবে জাতির?? ধর্ম কি তাকে এই শিখিয়েছে?? এভাবে বোকার মত মরে যাওয়া উচিত নাকি বেঁচে থেকে সবার জন্য কিছু করা উচিৎ? রুহুল বুঝতে পারে নিজেকে।
ভোর হয়। সেই ভোর, যেমন ভোর দিয়ে শুরু হয়েছিলো সিনেমার গল্প। রুহুল বাসায় ফিরে আসে। আনন্দে কেঁদে ফেলেন রুহুলের মা, চিৎকার করে বোন। কিছুক্ষন পরেই বাড়ির উঠোনে এসে বসে রুহুল। মায়ের কাছে জানতে চায় শিউলীর কথা। তার মা জানায়, শিউলী বিয়ে করবে না বলে বাসা ছেড়ে মেসে গিয়ে উঠেছে। সার বেঁধে যাওয়া পিপড়ার দল কিংবা আনমনে উড়ে বেড়ানো ফড়িং সব কিছুই আজ এত ভালো লাগে রুহুলের! সদ্য গরুর দুধ দুইয়ে এনে ছেলের মুখ তা দিয়ে ধুয়ে দিতে থাকেন রুহুলের মা, ঠিক যেন মুছে দিতে চাচ্ছেন সব মিথ্যা , ভন্ডামি , সহিংসতাকে । শুভ্র হয়ে যেতে থাকে সিনেমার পর্দা!এরই মধ্যে দেখা যায় ব্যাগ হাতে ফিরে আসছেন রুহুলের বাবা! দর্শকের তুমুল করাতালিতে কান ফেটে যাবার অবস্থ!
পুরো সিনেমায় ক্যামেরার কাজ ছিলো অতুলনীয়। কেননা সেখানে ছিলেন মিশুক মনীর। এই মানুষটিও আজ আর নেই। সংলাপের প্রানবন্ততা ছিলো দারুন। লং শটগুলো কখনোই অর্থহীন হয়নি। সবগুলো চরিত্র এসেছে , প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তায়। আমি সমালোচক নই , তা হওয়ার ইচ্ছেও নেই। আমার নিজের কাছে অন্তত রানওয়ের কোন খুঁত চোখে পড়েনি।
দিন দুয়েক আগে পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে গিয়ে দেখেছিলাম রানওয়ে। মুভিটা দেখার জন্য টিকেট কেটে আধ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো। কিন্তু দেখা শেষ হওয়ার পর বুঝলাম দুই ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ও যদি এই মুভি দেখতে হয় তবে সেটা হবে সৌভাগ্যের ব্যাপার। । মুভিটা দেখা শেষ করে যখন রিকশায় করে হলে ফিরছিলাম তখন মনটা প্রচন্ড রকম খারাপ হয়েছিলো। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এই তারেক মাসুদ আর নেই। তিনি আর মুভি বানাবেন না। একজন জহির রায়হানকে আমরা হারিয়েছিলাম। আজো তার বিকল্প পাই নি। এবার হারালাম তারেক মাসুদকে । জানি না আবার কবে একজন তারেক মাসুদ আসবেন আমাদের সিনেমা জগতে।
তারেক মাসুদ আপনাকে এই দেশ যোগ্য সম্মান দিতে পারেনি। আপনার পরিচালিত আরেকটি অসাধারন ছবি "মাটির ময়না" কে রীতিমত অপমান করা হয়েছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পীর পুরস্কার দিয়ে। কিন্তু বিশ্বাস করুন এ দেশের মানুষের আপনার প্রতি অসাধারন ভালোবাসা রয়েছে। আমি জানি না দর্শকের সম্মিলিত করতালি আপনি শুনতে পেয়েছেন কিনা কিন্তু আমাদের তীব্র ভালোবাসা আপনি নিশ্চই অনুভব করবেন। আমি খুব সামান্য একজন, তবুও আপনার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ সকাল ৭:১৫