চারিদিকে দেদারসে উইকেট পড়ছে। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট টিমের না, আমার বন্ধু মহলের। আজকাল আড্ডায় বসতে রীতিমত ভয় লাগে, গল্পের বিষয়বস্তু যথারীতি সেই চিরচারিত “আমার ও” কেন্দ্রিকই হয়! আমার আবার ‘ঠিক-বেঠিক’ জ্ঞ্যান বড্ড বেশি টনটনে তো, তাই ও পথে কখনও পা মাড়াইনি – অতএব নীরব দর্শক হয়েই শুধু বসে থাকি, অংশগ্রহণ করি না – মাঝে মধ্যে কেবল সন্তর্পনে ভবিষ্যতের জন্য নোট নেই, এই যা
ছোট থাকতে ইংরেজী সাহিত্যে আমাদের “রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট” নাটকটি পড়িয়েছিল। স্পষ্ট মনে আছে, যেখানে গোটা ক্লাস এই বেহেশ্তী ভালোবাসার গুণকীর্তণ করেছিল, আমি প্রায় ৪ পাতার এক ‘থিসিস’ জমা দিয়েছিলাম যার মূল উপপাদ্য বিষয় ছিল – ১৪ বছরের কচি মেয়ে আর ১৭ বছরের বাচ্চা ছেলের এই ভাল লাগায় কোন ফায়দা নাই, বড় হোক, তখন দেখা যাবেনে! আমাদের ম্যাডাম একটু রোমান্টিক টাইপ ছিলেন। এই কাঠখোট্টা ব্যাখ্যা পড়ে ওনার অনুভূতি কল্পনা করে একটু কষ্টই লাগছে আজ!
যাহোক, আমি এখনও বয়সে অনেক ছোট বিধায় এসব ব্যাপারে আমার মাথা ব্যাথা বাস্তবিকই কম। তবে academic interest প্রচুর সেই রেশ ধরেই recently ভাবলাম একটু চেষ্টা করেই দেখি না – এই “love” ব্যাপারটা কি-ই তা বুঝতে।
যে-ই কথা সে-ই কাজ… কিন্তু বুঝতে হয়, মোল্লার দৌঁড় ওই মসজিদ পর্যন্তই! আমার সোর্স-রিসোর্স দু’টোই সীমিত। তাই ঘুরে ফিরে শেষে আমার সবচেয়ে ছোট ভাই, এগার বছরের খালিদের শরনাপন্ন হলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “Do you love আপু?” বেশ কিছুক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করে অবশেষে মহাশয় বেতার বাণী করলেন, “হুউউম”। আনন্দে আমি আটখানা! এইবার এইবার উত্তর মিলবেই! ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, এই love জিনিসটা কি?” খালিদ তো পুরোই সিরিয়াস। ভুরু-টুরু কুঁচকে, সে কি মনযোগ তার! অতঃপর আমার এই বুদ্ধিজীবি ভাই বললেন, “Love is a feeling that is greater than Like.”
বাআআআআপস! এ দেখি এক্কেরে equation আকারে!
Love > Like.
শেক্সপিয়ারের আমলে খালিদ ছিল না বলেই ভদ্রলোক এসব সনেট-টনেট লিখে নাম কামাই করতে পেরেছেন, নাহলে ভাতে মরতেন!
এবার গবেষণার দ্বিতীয় পর্ব। Theory তো হল, এখন Practical চাই – সত্যিকারের “love”এর একটা উদাহরণ বের করা লাগবে। এই পর্বে আসতেই হঠাৎ কাজ অনেক সহজ হয়ে গেল। “একাত্তরের চিঠি” বইটায় আমার সবচেয়ে-এ-এ-এ প্রিয় চিঠিই তো “love”এর এক চমৎকার উদাহরণ হতে পারে!
(যারা বইটা পড়েননি তাদের জন্য বলছি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লিখিত চিঠির সংকলন এই বইটি অসাধারণ। সুযোগ করে প্লিজ একবার অন্তত পড়বেন।)
স্ত্রী অনুর কাছে লেখা মুক্তিযোদ্ধা নয়নের চিঠিটা এত সুন্দর, শুধু উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝান মুশকিল। তবুও দিচ্ছিঃ
“তোমার মনের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে বলব, লক্ষী আমার, মানিক আমার, চিন্তা করো না। তোমার নয়ন কুশলেই আছে। বিধাতার অপার করুণা।…তোমার শরীরে পরিবর্তন এসেছে অনেকটা বোধহয়। নিজের প্রতি বিশেষ যত্নবান হয়ো। মনকে প্রফুল্ল রেখ।…বুঝি, আমার কথা তুমি একটু বেশি করেই ভাব। সত্যি বলছি, ভাববার কিছুই নেই। আজ আমি ধন্য এই জন্য যে আমি আমার দেশকে ভালোবাসতে শিখেছি। আমার এ শিক্ষা কোনো দিন বিফলে যাবে না। তোমার সন্তানেরা একদিন বুক উঁচু করে তাদের বাবার নাম উচ্চারণ করতে পারবে। তুমি হবে এমন সন্তানের জননী, যে সন্তান মানুষ হবে, মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে জানবে”।
চিঠিটা অনেক বড়, কিন্তু অনায়াসে, এক নিশ্বাসে পড়া যায়। বইটি একবার উল্টিয়ে দেখেন – শুধু কি এই চিঠিই?
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুর রহিম তাঁর মা’কে লিখেছিলেন, “সুবেদার মেজর আব্দুল লতিফ আমার অজ্ঞান রক্তাক্ত দেহকে কাঁধে করে কাদা ও পানির মধ্যে কয়েক মাইল হেঁটে নিয়ে এসেছিল।…জানো মা, আমার তলপেট ও দুই ঊরু হতে মোট পাঁচটি স্পিন্টার ডাক্তারগণ অপারেশন করে বের করেছেন। বাকি তিনটা এখনো আমার শরীরে বিদ্ধ আছে”।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস কামাল উদ্দীন মাহমুদ লিখেছিলেন, “মা, তুমি এই মুহূর্তে আমাকে দেখলে চিনতে পারবে না। বিশাল বাবড়ি চুল, মুখভর্তি দাড়ি গোঁফ।…মিহির বলে, আমাকে নাকি আফ্রিকার জংলিদের মতো লাগে। মিহির ঠিকই বলে, কারণ…সেই আগের আমি আর নেই। তোমার মনে আছে মা, মুরগি জবাই করা আমি দেখতে পারতাম না। আর সেই আমি আজ রক্তের নদীতে সাঁতার কাটি”।
আচ্ছা বলেন তো, কোন “love”এর বলে তাঁরা এত সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন? কিসের টানে, কেন তাঁরা এই কাজটি করেছিলেন?
প্রতি স্বাধীনতা দিবসে-বিজয় দিবসে আমরা সবাই হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি। একেক দল একেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। আমরা সাধারণ মানুষ এই চতুর্মুখী টানে পড়ে শেষে মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই আর মাথা ঘামাই না। নিয়ম মতো সবুজ শাড়ি, লাল পাড় পরে একটা সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে দেশের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রমাণ করি।
কিন্তু একবার ভেবে দেখি কি – মুক্তিযোদ্ধা নয়ন কোন ভালোবাসার টানে মায়াবতী স্ত্রীর ভালোবাসা তুচ্ছ জ্ঞান করে ছুটে গিয়েছিলেন?
তাদের ভালোবাসা ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসা। সেই বীর সৈনিকদের চেতনা ছিল – দেশের সেবা করা।
তাহলে আজ যদি আমরা সত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাই – সবুজ শাড়ি/লাল পাড়-ই কি যথেষ্ঠ? স্বাধীন বাংলা বেতারের বিপ্লবী গানের সাথে গলা মেলালেই কি আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারব? (স্বীকার করছি গানগুলো আমারও খুব প্রিয়! আর ওই রঙের শাড়িও ভালই লাগে! )
মুক্তিযুদ্ধের বাণিজ্যিকরণের থেকে বড় অপমান মনে হয় আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের করতে পারব না। কিন্তু একবার চিন্তা করে দেখেন – আমজনতা আজ মুক্তিযুদ্ধের স্বাদ পায় টেলিকম কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে। এটা নিন্দনীয় তা বলছি না কিন্তু – তবে বিজ্ঞাপন-ই যখন একমাত্র সোর্স হয়ে যায়, সেটা তো নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার বিষয়।
এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে : কেন এরকম হল? আমার নিজস্ব ধারনা হল (অবশ্য আপনাদের ভিন্ন মত থাকতেই পারে) মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাসা আমরা বুঝি নি, তাদের ভালোবাসাকে যথার্থ সন্মান প্রদর্শনের কোন বাস্তবমুখী রোডম্যাপ আমরা কখনও পাইনি। রাজনৈতিক দলীয়করণের স্বার্থে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস আমাদের হাত থেকেই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা নয়ন কি লিখেছিলেন?
“আজ আমি ধন্য এই জন্য যে আমি আমার দেশকে ভালোবাসতে শিখেছি। আমার এ শিক্ষা কোনো দিন বিফলে যাবে না।”
যখন আমরা দেশের প্রতি ভালবাসার কোন বাস্তব পরিস্ফূটন না ঘটাই, তখন ভয় হয় আমরা হয়ত নিজেদের অজান্তেই মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগকে অপমান করছি, তাঁদের চেতনাকে/ভালবাসাকে হেয় প্রতিপন্ন করছি।
তবে এরকম লেখা আপনারা আগেও ভুরিভুরি পড়েছেন, তাই না? আমারও খুব বিরক্ত লাগে যখন একজন অনেক তত্ত্ব কথা বলে, কিন্তু কোন সমাধান দেয় না!!
তাই, গত বছর, আমরা সম্পূর্ণ সমাধান বের না করতে পারলেও, সমাধানের সূচনা করেছিলাম বটে! এই বছর আপনাদেরও আহবান করছি আমাদের সাথে যোগ দিতে।
সমাধানের সূচনা কোথায়? কমিউনিটি অ্যাকশন সহ অন্যান্য বেশ কিছু সংগঠন আয়োজিত “সেবার মাধ্যমে বিজয়ের প্রকাশ” (ভিডিও দেখুন অথবা ব্লগ পড়ুন)
আমরা বলছি না এটাই একমাত্র পন্থা, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ সেবার চেতনা সমুন্নত রাখতে হলে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সমাজ সেবায় ঝাপিয়ে পড়া ছাড়া আর কি-ই বা বিকল্প পথ আছে আমাদের?
এবারের সংগ্রাম দারিদ্র বিমোচনের সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম দেশ গড়ার সংগ্রাম।
“Love কি?” এর উত্তর মনে হয় আমি পেয়ে গিয়েছি। “Love” হল নিঃস্বার্থ ভাবে নিজেকে কোন কিছুর সেবায় সপে দেওয়া – সেটা কোন ব্যাক্তি বিশেষের সেবাও হতে পারে (আমরা অনেকেই এই কাজে বেশ পারদর্শী ) অথবা দেশের সেবাও হতে পারে… বা দু’টোই হতে পারে! সেবা হোক আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ।
আপনি সামনের বিজয় দিবস কিভাবে কাটাবেন?