আমাদের গ্রাম বাংলায় আগের দিনে বিশেষ বিশেষ কিছু খাবারের প্রচলন ছিল যা এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেরকম কিছু খাবার নিয়ে আজকের আলোচনা।
ছবি: কাউনের নাস্তা
প্রথমেই আসি "কালাই পোড়া" নিয়ে:
শীতের শুরুর দিকে। ঠিক এই সময় মসুর, বুট প্রভৃত্তি কালাই ঘরে ওঠে। শীতের সকাল। কুয়াশায় খুব বেশীদুর দেখা যায় না। সুর্য্য কেবল উঠবে উঠবে করছে। ঠিক এটাই কালাই পোড়া খাওয়ার উত্তম সময়। কালাইয়ের গাছগুলিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চারপাশে সবাই বসে বসে আগুন পোহাইয়া নেয়া কিছুক্ষন। তারপর আগুন নিভিয়ে দিয়ে ছাই এর মধ্যে থেকে কালাই বেছে বেছে খাওয়া, আর হাত মুখে কালি মাখানো। আহ্ . . .
ডইল্যা পোড়া:
এটা খাওয়া হয় গরমের শুরুতে। যখন বাঙালীর ঘরে ওঠে সোনালী গম। গমের আটা সামান্য পানি দিয়ে সিদ্ধ করে, লবন, মরিচের গুড়া, হলুদের গুড়া দিয়ে মাখিয়ে নিতে হয়। তার পর টেনিস বলের মত গোল পিণ্ডের মত বানিয়ে কলার পাতা দিয়ে মুড়িয়ে রান্না শেষ হওয়ার পর চুলার ছাই এর মধ্যে রেখে দিতে হয়। এটা বানানো হয় সাধারনত দুপুরের সময়। ছাইয়ের আগুনের তাপে বলটা পোড়া পোড়া হয়ে যাবে। কিছুটা সময় লাগে বটে। তারপর বিকেল বেলা মেয়েরা বাড়ান্দায় বসে গল্প করে আর ডইল্যা পোড়া খায়।
চাপড়া:
এটাও গরম কালের খাবার। গম এর আটা দিয়ে বানানো একরকম পিঠা। অনেকটা গমের আটার রুটির মতই। তবে বানানো হয় আরো একটু পুরু করে। শুরুতে ডইল্যার মতই সিদ্ধ করে লবন, মরিচ দিয়ে মাখিয়ে নিতে হয়। তার পর সাধারন রুটির চাইতে একটু পুরু রুটি বানানো হয়। তবে এখেত্রে সাধারন আটার রুটি বানানোর মত পিড়া, বলানী ব্যবহার করা হয়না। হাত দিয়ে চাপ দিয়েই বানানো হয়। এবার রুটির মতই কাঠখোলায় (নাম কাঠখোলা বলে ভাববেন না এটা কাঠের তৈরি, আসলে শুকিয়ে কাঠ একটা কথা আছে না? এখান থেকেই বোধহয় এই নামটা এসেছে। কারন এই খোলায় কোনোরকম তেল ব্যবহার করা হয়না) ভাজতে হয়। এটাও মেয়েদের প্রিয় খাবার।
কাউনের নাস্তা:
কাউন দিয়ে অনেক সুস্বাদু খাবারই তৈরি হয় যেমন কাউনের মোয়া। এটা অবশ্য এখনও বিভিন্ন যায়গায় পাওয়া যায়। তবে কাউনের নাস্তা প্রায় বিলুপ্ত। সাধারনত আখের গুড় দিয়ে এই নাস্তা তৈরি করা হত। বিশেষ করে ইফতারের সময় এই নাস্তা বেশী খাওয়া হতো। রন্ধন প্রণালী খুবই সোজা। কাউনের চাল দিয়ে ভাত রান্না করতে হবে। কাউনের চাল সিদ্ধ হয়ে গেলে পরিমান মত আখের গুড় আর দুধ মিশেয়ে দিয়ে আরো কিছুক্ষন চুলায় রাখতে হবে। সুগন্ধ আনার জন্য তেজপাতা, সাদা এলাচ আর সামান্য দাড়চিনি ব্যবহার করা যেতে পারে।
লাউয়ের খাট্টা:
একটা গল্প প্রচলিত ছিল, মেয়ে দেখতে এসে ছেলে পক্ষ জিজ্ঞাসা করেছে মেয়ে রান্না বান্না জানে কিনা। উত্তরে মেয়ের দাদী বিভিন্ন খাবারের কথা বলছে, এমন সময় মেয়ে বলে ওঠে "দাদী দাদী, আমি খাট্টাও রান্ধিতে জানি"। গল্পটা থেকে বোঝা যায় খাট্টা রান্না করা খুবই সহজ কাজ। আমি অবশ্য সঠিক রন্ধনপ্রণালী বলতে পারছিনা। তবে লাউয়ের খাট্টা খাওয়ার পর শরীরের ভিতরে যে একটা ঠাণ্ডা অনুভুতি হয় সেটা এখনো অনুভব করছি মনে হচ্ছে।
আলুর ঝুড়ি:
মেলা থেকে ঝুড়ি কিনে খেয়েছেন কখনও? ওটাকে আমাদের এলাকায় বলে নয়ন ঝুড়ি। আলুর ঝুড়ি দেখতে সেরকমই। আলুর ঝুড়ি বানানোর জন্য প্রথমেই মিষ্টি আলু সিদ্ধ করে নিতে হয়। তার পর সিদ্ধ আলুর খোসা ছাড়িয়ে চিপে ভর্তা করে নিতে হয়। মুড়ি ভাজার পর বালি থেকে মুড়ি আলাদা করার জন্য জেমন একধরনের মাটির পাতিল ব্যবহার করা হয় যাতে অসংখ্য ছিদ্র থাকে সেরকম একটা মাটির পাতিল ব্যবহার করা হয় আলুর ঝুড়ি বানানোর জন্য তবে এতে ছিদ্রগুলো একটু বড় বড় হয়। ছিদ্র করা মাটির পাতিলটাকে উল্টো করে রেখে ভর্তা করা সিদ্ধ আলু পাতিলের উপরে চাপ দেয়া হয়। ফলে সেটা ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে ঝুড়ি হয়ে নিচে পড়ে। এবার ঝুড়িগুলোকে রোদে ভালোভাবে শুকানো হয়। তারপর শুকনো ঝুড়ি কাঠখোলায় বালি দিয়ে ভেজে নেয়া হয়।
চিংড়ির পিটুলি:
অত্যন্ত সুস্বাদু একটা তরকারী। এটা মুলত শীতকালীন খাবার। চিংড়ির পিটুলি তৈরিতে লাগে কচি মুলার শাক, ছোট ছোট চিংড়ি, চালের গুড়া। মুলার শাক ছোট ছোট করে কেটে চিংড়ি রান্না করা হয় যার মাঝে একবাটি চালের গুড়া দেয়া হয়। ফলে তরকারীটা একটু ঘন হয়।
চাউলের নাস্তা:
এটাকে গরিবের পায়েস বলা যেতে পারে। সাধারন ভাতের চাল দিয়ে এই নাস্তা রান্না করা হয়, মাঝে নারকেল ছোট ছোট করে কেটে দেয়া হয়। সাধারনত আখের গুড় ব্যবহার করা হয়। সামান্য দুধ দেয়া যেতে পারে। একটা গাছ হত আমাদের গ্রামের দিকে যার পাতা থেকে সুগন্ধি বের হত। পাতাটা দেখতে অনেকটা আনারসের পাতার মত লম্বা, তবে বেশ নরম। আমাদের এলাকায় বলা হত নাস্তা পাতা। ওই পাতা দেয়া হত চালের নাস্তার ভিতরে।
সেউ এর নাস্তা:
এই নাস্তাটা বানানো রিতিমত ঝামেলার কাজ। আগে দেখতাম ঈদ আসার আগেই মা-চাচীরা সেউ বানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তো। এখন আর দেখিনা। সেমাই আর লাচ্ছার যুগে সেউ হারিয়ে গেছে। সেউ বানানো হত চালের গুড়া দিয়ে। চালের গুড়া বলতে আতপ চালের গুড়া। গুড়া সিদ্ধ করে একটা পিড়ির উপড় হাত দিয়ে ডলে সেউ বানানো হত। অত্যান্ত সময়সাপেক্ষ কাজ ছিল এটা। সেউ দেখতে ঠিক টুথপিকের মত। দুইপাশে সরু মাঝখানটায় মোটা। লম্বায় এবং ব্যসার্ধে টুথপিকের সমানই। এরপর সেউগুলোকে রোদে শুকিয়ে নেয়া হত। তারপর ঈদের দিন রান্না করা হত সেউ এর নাস্তা। এখেত্রেও নারকেল ছোট ছোট করে কেটে দেয়া হত নাস্তার ভিতরে।
কড়কড়া ভাত:
শীতের সকালে আগে ঠাণ্ডা ভাতই বেশী খাওয়া হত। তিনবেলা গরম ভাত খাওয়ার রীতি গ্রামগঞ্জে চালু হয়েছে খুব বেশীদিন হয়নি। রাতের খাবারের বেচে যাওয়া ভাত শীতের দিনে গামলায় রেখে দেয়া হত। সকালবেলা সেই ভাতকে বলা হত কড়কড়া। রসুনের পাতা, শুকনা মরিচ আর শরিষার তেল দিয়ে সেই ভাত মাখানো হতো (ভর্তা করা হতো)। অত্যান্ত সুস্বাদু এই কড়কড়া ভাত। আমার তো এখনি জ্বিবে জল চলে আসলো বলে।
এছাড়াও বিকেল বেলা মগ এ করে গম ভাজা, চাল ভাজা নিয়ে খেতে খেতে ঘুড়ে বেড়ানো, আখের গুড় দিয়ে কাউনের মোয়া, গম এর ভাত কতকিছু। এসবের আর চলন নেই। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে, হয়েছে খাদ্য তালিকার সাথে মানও। তবু কেন যেনো মনে হয় এই ফরমালিন আর ভেজাল খাবারের যুগে আগের সেই গেয়ো খাবার গুলোই ভালো ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৪ বিকাল ৪:৫১