আমার আজকের লেখাটা বাংলাদেশে জন্ম নেয়া ভিনদেশী পতাকা উত্তোলনকারী ক্রিকেট প্রেমীদেরকে উৎসর্গ করলাম।
আজকে খুব মনে পরছে আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের এক রুম মেটকে। ক্রিকেট প্রেমী বললে কম বলা হয়ে যায়। ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাতে ৪ টা পর্যন্ত খেলা দেখা পাবলিক। সেদিন ওকে খুব বকা দিয়েছিলাম। ক্রিকেট খেলা মানুষ দেখে। কি লাভ হয় সারাদিন-রাত বসে বসে খেলা দেখে?
আমি ক্রিকেট খেলা একদম পছন্দ করতাম না, এমনকি যারা ক্রিকেট খেলা দেখত তাদেরকেও পছন্দ করতাম না। আমি জানিনা আমার সেই বন্ধুটি আজ এই লেখাটা পড়ছে কিনা তবুও বলছি - বন্ধু কিছু মনে রাখবি না তোকে অনেক বকা দিয়েছি, ক্ষমা করিস।
আজ আমি সেই আমিই আছি, শুধু পরিবর্তন হয়েছে আমার কিছু চিন্তাধারা, পছন্দ-অপছন্দ। আজ আমি একটানা বসে ক্রিকেট খেলা দেখি।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ফাইনাল খেলা। আমি আমার বউ, সাথে কয়েক বন্ধু। ওদেরকে খেলা দেখার আমন্ত্রন করেছিলাম। স্টেডিয়ামে যাওয়া হয়ে ওঠেনি - হয়তবা এখনও এতটা প্রেমে পড়িনি অথবা ৪০০ টাকটার টিকেট ব্লাকে ৩০০০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় সামর্থহীনতায়।
বাংলাদেশ টসে জিতে ফিল্ডিং নেয়ায় আমরা সবাই খুব খুশি হলাম। আমাদের একটা ব্যাপার হল - সামনে কোন টার্গেট থাকলে সেখানে চেষ্টা করে পৌছাতে পারি।
ধির গতিতে খেলা চলছে। হঠাৎ পাকিস্তানের প্রথম উইকেটের পতন হল। আমি নিজের অজান্তেই লাফিয়ে উঠেছি। একটু পর খেয়াল করলাম আমাদের মাঝ থেকে একজন পাশের রুম এ গিয়ে বসে আছে। সময় যেতে না যেতেই দ্বিতীয় উইকেটের পতন। এবার আমাদের মাঝে সে ফিরে এসেছে - তবে তার চেহারায় কিছুটা বেদনার ছায়া পড়েছে। আমার সন্দেহ পরিষ্কার হয়ে গেল যখন তাকে জিঙ্গাসা করে জানতে পারলাম - সে চাচ্ছে পাকিস্তান জিতুক।
সবাই মিলে প্রথমে সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে বাসা থেকে বের করে দেবো। বউয়ের অনুরোধে এবেলা যদিও মাফ করলাম এই ভেবে যে অতিথিকে অসম্মান করতে নেই তবে শর্ত দিলাম আমাদের সাথে খেলা দেখতে হলে বাংলাদেশের সাপোর্টার হতে হবে। জোর করে হলেও আমাদের সাথে হাসতে হবে, উচ্ছসিত হতে হবে। বেচারা অন্তত তার প্রিয় দলের খেলাটা দেখার খাতিরে শর্ত মেনে নিল, তাছাড়া রাতের খাবারের লোভটা সে সামলাতে পারলোনা - কারন আমার বউ আবার খুব সুন্দর রান্না করে ।
যাই হোক খেলা চলতে থাকল, সাথে থাকল আমাদের উচ্ছসিত হৃদয়, আর ওর মনের কষ্ট প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রনা। এরই মাঝে ৩৩ রান হতে না হতেই পাকিস্তানের ৩ টি উইকেটের পতন। বুকের ভিতরটা বারবার যেন নেচে উঠছিল।
এভাবেই উচ্ছাস আর উৎকন্ঠার মাঝে শেষ হল প্রথম ইনিংস।
হাল্কা নাস্তার আয়োজন হলো, আর হলো কাপ জেতার পর আমরা কি করব তা নিয়ে প্রাণখোলা আলোচনা।
বাংলাদেশ খেলা শুরু করল। শুরুতে একটু ধির গতিতে রান নিচ্ছিল। টেনশান ছিলনা একটুও - আমরা জিতে যাচ্ছিই, ধিরে ধিরেই খেলুক। খেলা যতই শেষের দিকে যায় উত্তেজনা ততই বাড়তে থাকে। এর মাঝে আর সেই বন্ধুটির দিকে খুব বেশী নজর দিতে পারিনাই। তবে মনে হচ্ছিল সে খুব কষ্ট করেই আমাদের আনন্দের সাথে তাল মিলাচ্ছিল।
আর মাত্র ২ ওভার, রান নিতে হবে ১৯ - সাহস রাখছি বুকে, আমরা জিতে যাচ্ছি। রক্তচাপ যেন ধিরে ধিরে বেড়ে যাচ্ছে। একবল একবল করে চলে যাচ্ছে আর আমার হার্টবিট বাড়ছে।
আহ
এভাবে আমরা হেরে গেলাম
মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। আমার মুখ থেকে যেন কথা বেরোচ্ছে না। আমার বুক ফেটে কান্না বের হয়ে আসছে। টিভি অফ করে দেব এমন সময় সাকিবের অশ্রুসজল চোখে চোখ পড়ে গেল । মনটা আরো ভারী হয়ে গেল
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার সেই বন্ধুটির চোখে জল। আমি অবাক হয়ে গেলাম, কিভাবে সম্ভব। ও পাকিস্তানের গোড়া সাপোর্টার। ওকে জিঙ্গাসা করায় যে উত্তরটা দিল তা ঠিক এরকম -
"আগে কখনও এভাবে ভাবিনিরে দোস্ত। খেলাকে কেবলই খেলাই মনে করেছি। এর মাঝেও যে দেশপ্রেম আছে চিন্তা করিনাই। তোদের সাথে তাল মিলাতে মিলাতে শেষে এসে বাংলাদেশ হেরে যাওয়াতে চোখ থেকে সত্যি সত্যিই পানি বের হয়ে গেল। "
আমি জিতে গেছি, আমরা জিতেছি, আমরা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে পেরেছি আমরা সত্যি সত্যিই টাইগার।
অবশেষে, বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে যারা বাংলাদেশের সাথে অন্য দলের খেলায় সেই দেশের পতাকা তুলে ধরে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি - একবার আমাদের লাল সবুজ পতাকা টা বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে বলেই দেখ বাংলাদেশ। সাকিব, তামিম, মুশফিকের এত কষ্টে খেলার পরও যখন চোখে জ্বল চলে আসে তা আমরা দেখতে চাইনা। আমরা জিতবই। একবার আমাদের সাথে একাত্ব হয়েই দেখো, তোমার হৃদয় উচ্ছসিত হবেই হবে।
বি: দ্র: বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবং সকল ক্রিকেট প্রেমীকে আমার আন্তরিক ভালোবাসা । আমি হয়ত আর সবার মত ক্রিকেট প্রেমী হতে পারব না। তবে এটুকু জানি বাংলাদেশের কোন খেলায় আমার মুখ থেকে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ধ্বনি নির্দিধায় মনের অজান্তেই বেড় হয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১২ রাত ১০:২৭