যমুনার জলস্নাত দুরন্ত বাতাস ইছামতির বুক ছুয়ে ছুয়ে বয়ে যাচ্ছে বাহুকা গ্রামের উপর দিয়ে । গ্রামের উত্তর পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতি, পুর্বপাড়া থেকে যে মেঠোপথটা বেড় হয়ে এসেছে তা গ্রামের ঠিক মাঝখানে এসে দুইভাগ হয়ে একটা গিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় নদীর সাথে মিশেছে, আরেকটা মসজিদের পাশ দিয়ে চলে গেছে চৌধুরী বাড়ীর দিকে । আমার প্রিয় গ্রাম, আমার তিন পুরুষের জন্মস্থান।
এখানে জীবন মানে যুদ্ধ, অমাবশ্যার অন্ধকারের মাঝে জোনাকীর আলোতে বুকের ভিতর মৃদু কম্পন নিয়ে পথ চলার চেষ্টা । এখানে নেই ভবিশ্যতকে জানার ইচ্ছা, নেই অতীতকে নিয়ে গবেষনা, নেই বিলাসিতার ভেলায় জীবন ভাসিয়ে দেয়ার মত সামর্থ, আছে শুধু আজকের জন্য ভাবনা । তবুও এখানে ভালবাসা আছে, আছে সহমর্মিতা, আছে একজনের প্রতি আরেকজনের বিশ্বাস, তেমনি আছে বিশ্বাসঘাতকতার মত পাপাচার, আছে প্রভাবশালীর বিস্তার করা হস্ত, আছে অথ্যাচার, আছে অনাচার যা আমরা যুগ যুগ ধরে বুকের মধ্যে লালন করে আসছি।
এখানেও আছে রাজনৈতীক প্রতিহিংসা । এখানে আছে মুসলমান আছে হিন্দু আছে কামার, কুমার, কলু, জোলা, আছে শেখ, চৌধুরী, তালুকদার আরো আছে কত জাতী-বর্ণের মানুষ। আছে বিএনপি, আওয়ামীলীগ, জামাত, জাতীয় পার্টি। তাই আছে মারামারি আছে হানাহানি। গেলবছরের আগের বছরই পুর্বপাড়ার নজরুলরা মোহাম্মদ মাষ্টারের বাড়িতে হামলা করে কয়েকজনকে আহত করেছিল, থানায় মামলাও হয়েছিল শুনেছিলাম, পরে আর কিছু হয়নি। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন হাই, বক্কার রা কয়েক ভাই মিলে রশিদের ছোট ভাইকে কি নির্যাতন করেই মারল - নিজ চোখে দেখেছি। মামলা হয়েছিল, সাজাও হয়েছিল, আবার জামিন পেয়ে এখন তারা দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গ্রামোন্নয়ন ক্লাবে বসে বসে এসব ভাবছিলাম। আজ হাই স্কুলের মাঠে গ্রামের সকল রাজনৈতীক দলের, সকল গণ্যমান্য লোক নিয়ে একটা সমাবেশ ছিল। সমাবেশে আমার ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। আমি গ্রামোন্নয়ন ক্লাবের সভাপতি। সমাবেশে বিশেষ কেউ ই আসেনাই। জানি কেন আসে নাই। আমাকে সবাই সম্মান করে, গ্রামের মধ্যে একটা ভদ্র রুচিশীল ছেলে বলে সবাই স্বিকার করে। আবার ছাত্রশিবিরের লোক বলে দুএকবার রাস্তায় দৌড়ানিও দিছে। আমি বহুবার ওদের বুঝাতে চেয়েছি যে আমি আর সবার মত সাধারন একটা মানুষ। আমি চাই গ্রামের মানুষের উন্নতি হোক। সবাই এগিয়ে যাক।
মনটা ভীষণ খারাপ। ক্লাব থেকে ধীরে ধীরে বের হলাম। চেয়ারমেন(প্রাক্তন) কাকার বাড়ীর দিকে যাচ্ছি। আমার আর চেয়ারমেন কাকার ভিতরে তেমন কোন পার্থক্য নাই শুধু বয়স ছারা। তাকেও আর কেউ মানে না। তবুও মুরুব্বিদের বুদ্ধি অনেক সময় ভালো কাজে দেয়। চেয়ারমেন কাকার সাথে আলোচনা করে একটা বুদ্ধি বের করলাম।
পরদিন একে একে গেলাম প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাগোছের লোকদের কাছে। সবাইকে একটা কথাই বুঝালাম - আমরা যে একে অন্যের সাথে মারামারি কাটাকাটি করছি এতে শুধু ক্ষতি হচ্ছে, কারো কোন লাভ হচ্ছেনা। লাভ হচ্ছেনা গ্রামের। আজ একদল ক্ষমতায় আছে তারা তাদের ক্ষমতা দেখাচ্ছে অন্যের উপর আবার যখন অন্যরা ক্ষমতা পাচ্ছে তখন তারা আগের অত্যাচারের বদলা নিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দুজনই। জাতীয় রাজনীতিতে আমরা কোন ভুমিকা রাখতে না পারি গ্রাম্য পর্যায়ে তো আমরা শুধরে নিতে পারি। শক্তি দিয়ে নয় যুক্তি দিয়ে লড়াই করি। প্রত্যেক মানুষের তার কৃতকর্মের প্রতি একটা যুক্তি থাকে। অপরাধীকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেই যে সে ভুল করেছে। শরীরে আঘাত করে অন্যায়ের প্রতিশোধ হয়ত নেয়া যায়, অন্যায়কারীকে বুঝানো যায় না যে সে অন্যায় করেছে তাই সুযোগ পেলে সে আবার পুর্বকর্মের পুনরাবৃত্তি করে।
অবশেষে অনেক কে বুঝাতে সক্ষম হলাম। পরবর্তী সপ্তাহে আবার সমাবেশ এর আয়োজন করা হল। উপস্থিতি আশানুরুপ। সকলকে দেখে প্রাণটা ভরে গেল।
কে বলে আমরা অবুঝ। আমরা আসলে নেতৃত্বশুন্যতায় ভুগছি। আমাদের সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার মত নেতার অভাব। গ্রামের ৩ হাজার মানুষ যদি এটা বুঝতে পারে তবে কেন দেশের সকল মানুষ বুঝবে না। আসলে বুঝানোর মত মানুষের অভাব।
আমি সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হলাম যে আমাদের উচিৎ গ্রামের উন্নয়নে কাজ করা। হানাহানি মারামারি করে নিজেদের ক্ষতি করা উচিৎ নয়।
প্রায় বছর দুয়েক পরে -
আমার গ্রামে এখন একটা যুব উন্নয়ন ক্লাব যেখানে গ্রামের যুবকদের ফ্রি কম্পিউটার সহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আছে ৪র্থ থেকে ১০ম শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য ফ্রি কোচিং ব্যবস্থা। একটা পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে প্রায় হাজার খানেক বই আছে, প্রতিদিন পেপার রাখা হয়, আছে ইন্টারনেটের সুব্যবস্থা। আছে স্যাটেলাইট টিভি। আছে হাসপাতাল, মাদ্রাসা, স্কুল কলেজ। গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা ছুটিতে বাড়িতে আসলে গ্রামের বিদ্যালয় গুলোতে ক্লাস নেয়। আর এক দল আরেক দলকে মারে না। আমরা এখন রাজনীতি করি গ্রামের জন্য ব্যাক্তির জন্য নয়। এখন আমার গর্ব হয় আমার প্রিয় বাহুকা গ্রামকে নিয়ে, গ্রামের মানুষগুলোর জন্য।
গ্রামের মাঝখানের মেঠোপথ দিয়ে হেটে যাচ্ছি। দুপাশের সবুজ বৃক্ষগুলো যেন আজ আরো সবুজ হয়েছে, যমুনার জলস্নাত বাতাস আর শরতের রোদ দুয়ে মিলে এক অন্যরকম অনুভুতি জাগাচ্ছে শরীরে। এমন সময় পকেটের ফোনটা বেজে উঠল.......
********************************
বৈদ্যুতীক পাখা উপরে আস্তে আস্তে ঘুড়ছে, বিছানাটা এলোমেলো, বউ আমার বাড়ি গেছে - চাচাশশুর প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করছে বলে। দিলাম ধমক বউকে, উহ্ !!!! এত সকালে ফোন করেছ কেন? দিলে তো সুন্দর সপ্নটা ভেঙ্গে।
আমি নেতা হতে চাইনা, আমি চাই কেউ একজন নেতা হয়ে আমার সুন্দর সপ্নটা পুরন করুক। আশায় রইলাম।
আজ গ্রামের বাড়ী যাচ্ছি। ফিরে এসে উপস্থিত হব আমার প্রিয় গ্রামের সুন্দর সুন্দর ছবি নিয়ে - আর সাথে থাকবে শীতের পিঠা। সবাই আমন্ত্রিত। ব্লগে নয় - আমার প্রিয় বাহুকা গ্রামে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:১০