পুরুষের মনস্তাত্বিকের সবথেকে বড় মোটিভেশন হলো যে কোন বাধা পেরিয়ে স্বাধীনতা খোঁজবার মধ্যে। আর এই স্বাধীনতা খুঁজে পাবার পরের পরম সুখের শুন্যতাটুকু অনুভব করবার মাঝেই পুরুষের মুক্তি। এবং কোন না কোন ভাবে পুরুষ সবসময় এই শুন্যতাটুকু খোজার মাধ্যমেই তার পূর্নতা পায়। হতে পারে এট মৃত্যু অথবা চরম বিপদের মুখোমুখি হয়ে জীবন নিয়ে বেঁচে আসার মধ্যে দিয়ে অথবা কঠিন কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবার মধ্যে দিয়ে। সবকিছু বাজি রেখে জেতার মধ্যে অথবা টিকে থাকার মাঝে আসলে পুরুষ তার মনস্তাত্বিকের স্বাধীনতা খোঁজ করবার রিচুয়ালটিই অবচেতনে পালন করে বলা যায়। আর তার জীবনের নারী প্রায়ই পুরুষের এই চাহিদাটুকু বুঝতে ব্যর্থ হয়। জুয়া খেলার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার পেছনে তার এই ছুটে যাওয়াকে নারীর কাছে সবসময় পাগলামোই মনে হয়েছে। অথচ প্রতিটি পুরুষের হৃদয়ের ভালবাসাকে মুক্ত করবার আগের ধাপ হলো তার এই স্বাধীনতার খোঁজ।
বেশিরভাগ খেলাই কিন্তু পুরুষ মানুষের এই টান টান উত্তেজনার ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা জয় করবার আরেকটি রিচুয়াল। সব বাঁধা পেরিয়ে প্রতিপক্ষের জালে মেসির গোল দেয়া অথবা শত সমালোচকের ভাষায় “ফুরিয়ে যাওয়া” আশরাফুলের সেঞ্চুরি- এগুলো সবই পুরুষ মানুষকে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ করে তোলে। ফুটবলে প্রতিপক্ষের সকল বাঁধা পেরিয়ে স্বাধীনতা [গোলপোস্ট] পর্যন্ত বলটি নিয়ে যাওয়া কিংবা ব্যাটিং স্বর্গে ব্রেকথ্রু উইকেট, কঠিন যুক্তিতর্কের খেলায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সব যুক্তি খণ্ডন করতে পারা এমনকি মোবাইল ফোনে থাকা অর্থহীন গেমটিতে নিজের সর্বোচ্চ স্কোর পেরিয়ে যাওয়া- এগুলো সবই আসলে পুরুষের স্বাধীনতার প্রতি যেই চাহিদা তাকেই পূর্ণ করে। আর ঠিক ঐ মুহুর্তগুলোতে আমাদের একটি স্বত্বা এমন উন্মত্তভাবে উল্লাস প্রকাশ করে থাকে যে মনে হয় আমাদের হৃদয়ের সবথেকে গভীর আকাঙ্ক্ষাটি যেন পূর্ণ হয়েছে। সব বাঁধা জয় করে স্বাধীনতার এই যে আকাঙ্ক্ষা সেটাই কিন্তু কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে পুরুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। অফিস, ব্যবসা, কি পর্বতারোহণ কি মেডিটেশন- সবকিছুর মাঝেই পুরুষ মনস্তাত্বিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে সেই স্বাধীনতাটুকুই প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়াচ্ছে।
স্বাধীনতার প্রতি তার এই চাহিদা শুধুমাত্র নিজের সামর্থ্যের চূড়ান্ত প্রান্তে গিয়েই পুরুষ অনুভব করতে সক্ষম যেখানে রুপক অর্থে আসলে সে তার মৃত্যুকেই অনুভব করে, যা মূলত পুরুষের মনস্তাত্বিকের সবথেকে বড় ভয় এবং একইসাথে স্বাধীনতার প্রতীক। জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মাঝেই তাই সে এই মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে স্বাধীনতার অনুভুতিটিকেই মনের অজান্তে খুঁজে বেড়ায়।
“At the risk of seeming ridiculous, let me say that the true revolutionary is guided by a great feeling of love.” – Ernesto ‘Che’ Guevara
তার এই স্বাধীনতার প্রতি চাহিদার আরো ডার্ক বা চূড়ান্ত রুপই হলো যুদ্ধ, যা আসলে স্বাধীনতাকামী পুরুষের মৃত্যুর মুখোমুখি হবার সাধনা থেকেই অনুপ্রাণিত একটি রিচুয়াল মাত্র। আর খেলাধূলা অথবা প্রতিযোগিতাগুলো এই যুদ্ধেরই সামাজিক ভার্শন। এরপরও কিন্তু পুরুষের মনস্তাত্বিকে চূড়ান্ত আবেদন রাখে সত্যিকারের যুদ্ধ অথবা সে পর্যায়ের যে কোন কিছু। যুদ্ধের ওপর নির্মিত সিনেমাগুলো দেখে হৃদয়ের একদম গভীরে চরম উত্তেজনা অথবা আবেগ অনুভব করেনি এমন পুরুষ মানুষ মনে হয়না খুঁজে পাওয়া যাবে। মানবতার স্বাধীনতার তরে সবকিছু বাজি রেখে মৃত্যুর মুখোমুখি হবার বাসনা মনের অবচেতনেই ধারণ করে প্রতিটা পুরুষ, তবে হৃদয়ের এই গভীরতম পালসটির সাথে কানেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এই অনুভূতিটিই আমরা বাইরে খুঁজে বেড়াই, যুদ্ধের সিনেমা অথবা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নায়কের আসনে বসিয়ে। আর ব্যর্থ হলে তাকে দোষ দেই, কারণ নিজেকে দোষারোপ করবার কথা ভুলেও চিন্তা করি না আমরা। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনাটা এভাবেই পুরুষের অবচেতনের গভীরতম স্থানটিতে অবস্থান করে, আর বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে এই রিচুয়ালটিই সে সচেতন বা অবচেতনভাবে পালন করে থাকে- হোক সে সত্যিকারের যুদ্ধে, দাবার বোর্ডে কিংবা বাজির টেবিলে অথবা পর্বতচূড়ায়। এভারেস্টের অলিখিত নায়ক জর্জ ম্যালরীর একটি বিখ্যাত উক্তি-
“So, if you cannot understand that there is something in man which responds to the challenge of this mountain and goes out to meet it, that the struggle is the struggle of life itself upward and forever upward, then you won’t see why we go. “
মৃত্যুর মুখোমুখি হবার এই সামর্থ্যটাই প্রতিটা পুরুষের আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সবথেকে বড় উপাদান। তার ভালোবাসাকে সীমিত করে এরকম প্রতিটি ভয়ের মুখোমুখি হয়ে তাকে পরাজিত করবার মাধ্যমেই তার মনস্তাত্বিক স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব আর মুক্ত করা সম্ভব নিজের একদম ভেজালহীন সত্তাটিকে। তার প্রতিপক্ষ সে নিজেই এবং আরাম-আয়েস ও নিরাপত্তার কৃত্রিম অনুভূতি হলো প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের সামনে দাঁড়ানো কঠিন প্রতিরক্ষাবূহ্য। যুদ্ধ নিজের সাথে। স্পিরিচুয়াল ফ্রিডম সম্ভব একমাত্র নিজের তৈরি খাঁচা ভেঙ্গে বের হয়ে আসবার মাধ্যমে। আর এটা তখনই ঘটে যখন নিজের ভেতরে থাকা কৃত্রিম সত্তাটিকে পুরোপুরি বর্জন করতে সক্ষম হয় একটি পুরুষ।
“How to get the best of it all? One must conquer, achieve, get to the top; one must know the end to be convinced that one can win the end - to know there's no dream that mustn't be dared. . . Is this the summit, crowning the day? How cool and quiet! Have we vanquished an enemy? None but ourselves.“ - George Mallory
বিভিন্ন ধর্মে নানা উপমা এবং রূপক ব্যবহার করে বারবার এ কথাটি বলা হলেও কালের বিবর্তনে হয় তা হারিয়ে যাচ্ছে নয়তবা তার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে আরো একদল বিভ্রান্ত মানুষ। সাইকোলজির ভাষায় নিজস্ব ইগোকে পরাজিত করবার মাধ্যমেই শুধু অর্জিত হয় পুরুষের মনস্তাত্বিক স্বাধীনতা। আর তখনই মুক্ত হয় তার হৃদয় এবং তার মাঝের অসীম ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারে সে তার বাস্তবতাকে। তবে নিজের মুখোমুখি হবার এই চরম ঝুঁকিটি খুব কম সংখ্যক লোকই নিতে সক্ষম, কারণ সমাজ তাকে সচেতন এবং অবচেতন ভাবে ভিন্ন শিক্ষা দিয়েছে যেখানে সমর্থন করা হয়েছে কষ্ট বা ব্যাথাকে সবসময় এড়িয়ে চলাটাকেই। অথচ কষ্ট ছাড়া বিবেচনা বা চিন্তা সম্ভব নয়, যা ছাড়া নিজস্ব গন্তব্য অনুধাবন করারও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর এখানেই পুরুষ হারিয়ে ফেলে তার অবচেতনের সবচাইতে গভীর চাহিদাটির সাথের যোগাযোগ।
এরপরেও এই কষ্টহীন স্বাধীনতাকেই আমরা প্রতিনিয়ত খুঁজে চলেছি বিভিন্নভাবে- হয়তোবা জীবনে সহজেই প্রচুর অর্থ-সম্পত্তির প্রত্যাশা করে অথবা কম কাজে ব্যবসায় বেশি লাভের মাধ্যমে আর নয়তবা জীবনসঙ্গী হিসাবে শুধু বাহ্যিক ভাবে সুন্দরী কোন নারীর সহজসাধ্য ভালোবাসা পাবার মাধ্যমে। আর এরকম স্বাধীনতায় মৃত্যুর ভয়কে জয় করতে হয় না বলেই হয়ত তার মূল্যও আমাদের কাছে এত কম হয়। যদিও প্রতিটি স্বাধীনতারই অনুভুতি একদম ক্ষনিকের জন্য, তবে এই ছোট্ট অর্জনগুলো এতই সহজলভ্য যে তা সেই ক্ষনিকের পরিতৃপ্তি দিতেও ব্যর্থ হয়। আর নিজস্ব স্বাধীনতার চাহিদাকে এভাবে সীমিত করে ফেলার প্রভাব আমাদের মনস্তাত্বিকে রেখে যায় এক অবচেতন অসন্তোষ।
মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবার এই অবচেতন প্রক্রিয়া তাই পুরুষ সবসময়ই উপভোগ করে যাবে, হয় মুষ্টিযুদ্ধ-ক্রিকেট-ফুটবল ও অ্যাকশনধর্মী সিনেমা এবং মার্শাল আর্টের মত প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে নয়তোবা নিজস্ব দার্শনিক মতবাদের সব বাধা পেরিয়ে মনস্তত্বের আরোও গভীর কোন অংশকে আবিস্কার করবার মধ্যে দিয়ে। তবে নিজেকে স্বাধীনতা দেবার এই প্রক্রিয়াটিকে অবচেতন থেকে বের করে সচেতনভাবে অনুভব করবার পূর্বে নিজস্ব গন্তব্য জানা সম্ভব নয় বেশিরভাগ পুরুষের বেলায়। বিশুদ্ধ স্বাধীনতার প্রতি এই চাহিদাটাকে হৃদয়ের গভীরেই রেখে না দিয়ে বরং তাকে নিজের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্যতে পরিণত করবার মাধ্যমে প্রতিটা মুহুর্ত অনুভব করেই ব্যক্তিত্বকে আরো পূর্ণতার পথে নেয়া সম্ভব, কারণ শুধুমাত্র এই বিশুদ্ধ স্বাধীনতা অর্জন করেই একজন পুরুষ পারে তার পৃথিবীকে অসীম এবং শর্তহীন ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে।
অপরদিকে নারীর অবচেতন স্বাধীনতা নয় বরং ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পন করে পুর্নতা খুঁজে পায়। নারী তার জীবনের প্রতিটা শুণ্যস্থান পূরণ করে ভালোবাসা দিয়ে আর শূন্যতাকে ঘৃণা করে। আর শুন্যতাকে সে পূরণ করবে তার শো কেস অথবা পড়ার টেবিল বিশেষ কোন জায়গায় কুড়িয়ে পাওয়া ঝিনুক অথবা পাথর এবং নুড়ি দিয়ে সাজিয়ে। যুদ্ধ বা মুষ্টিযুদ্ধের মত অ্যাগ্রেসিভ প্রোগ্রাম না দেখে সে বরং সোপ অপেরা অথবা রোমান্স নভেলের মাঝে নিমজ্জিত হবে, অথবা আইসক্রিম এবং চকলেটের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইবে। তার আধ্যাত্মিক শুন্যতা সে পূরণ করতে চায় তার হৃদয়কে ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করে, যা পুরুষের স্বাধীনতার দিকে চলবার সম্পুর্ণ উল্টো। পুরুষ যেমন স্বাধীনতা থেকে প্রাপ্ত শুণ্যতার দিকে ধাবিত, সেখানে নারীর পুর্নতা আসে ভালোবাসায় হারিয়ে যাবার মাঝে। আর এই দুইয়ের মাঝে সাময়িক পূর্নতা আসে তাই একজন সত্যিকারের স্বাধীন পুরুষ যখন স্বাধীন ভাবে সম্পূর্ণ উপস্থিত থেকে তার প্রেমিকাকে ভালবাসতে সক্ষম হয় তখন।
নারীর ভালোবাসার খোঁজ এবং পুরুষের স্বাধীনতার অনুসন্ধান আপাত দৃষ্টিতে ভিন্নমুখী হলেও কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ঠিকই তাদের এক জায়গায় এনে দাড় করিয়ে দেয়। এমনকি নিজেদের অস্তিত্বকে আবিস্কার করবার পথে সাময়িক ভাবে তাদের বিচ্ছেদ হলেও তাই একসময় তারা আবার একে অপরের কাছেই ফিরে আসতে বাধ্য। কারণ তারা এক না হলে যে প্রকৃতি পূর্নতা পাবে না কখনোও।
https://www.facebook.com/DoctorXBD
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ১১:২৯