বৃষ্টি পড়ছে,ঝম ঝম শব্দে। মেঘ হতে মুক্তি নিয়ে বৃষ্টি আজ বাতাসের হাত ধরে অঝোরে ঝরছে। মনে আছে সেই দিনটির কথা? তোমার হাত ধরে অজানায় হারিয়ে যাওয়া দিনটির কথা? না, বৃষ্টির তীব্রতা ঝাপসা করতে পারে নি কিছু...বহুদুর থেকেও চোখে স্পষ্ট সবকিছুই। অর্ক, তোমার কি মনে আছে? জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম অনেকক্ষণ। আনন্দ আর বৃষ্টি একাকার হয়ে গিয়েছিলো। সেদিন বাসায় গিয়ে মার কাছে কি বকুনি টাই না খেয়েছিলাম। অথচ মাকে যেদিন প্রথম তোমার কথা বলেছিলাম,সেদিন কিন্তু মা বকেন নি। আমাদের বিয়ে টা কিন্তু অনেক ধুমধাম করেই হয়েছিলো । তোমার মনের মতো করেই সেজেছিল তোমার লাল টুকটুকে বউটা।বিয়ের রাতেও বৃষ্টি হয়েছিলো মনে আছে অর্ক? আমরা সারারাত বৃষ্টি দেখেছিলাম। তুমি বায়না ধরেছিলে আমার মুখে বৃষ্টির ফোটা গুনবে। কি পাগলটাই না ছিলে!
আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাট টি নিজেদের মতো সাজিয়ে ছিলাম।দেয়ালে দেয়ালে তোমার আমার ছবি। বেলকনিতে গোলাপের গাছ গুলো, জানালার পাশে সেই উইন্ডচাইম গুলো যেগুলো বাতাসে মূর্ছনা সৃষ্টি করতো। বিছানার সামনে ফ্লিন্ট কাঁচের সেই মস্ত জানালাটা মনে আছে? সারা দিন রাত যেটার পাশে বসে আমরা স্বপ্ন বুনতাম। লাল-নীল-সবুজ স্বপ্ন। রাতের বেলা চাঁদের আলো গায়ে মেখে ঘুমিয়ে পড়তাম।
সকালে উঠেই আমার অগোছালো বরটাকে ঘুম থেকে ওঠাতে কিই না করতে হতো। লক্ষ্মী বউ থেকে ঝগড়াটে বউ হতে সময় লাগতো না। এত অলস ছিলে কেন অর্ক,এত অগোছালো। বিয়ের পরেও তোমাকে নিয়ে হিমশিম খেতাম। সময়ের সাথে তুমি কিভাবে যেন ভালো হয়ে গিয়েছিলে। আমার লক্ষ্মী বর হয়ে গিয়েছিলে। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে অফিস যেতে,দুপুরে ফোন করে খেতে বলতে, সন্ধায় বাসায় ফিরতে প্রতিদিন সদ্য ফুটন্ত লাল গোলাপ নিয়ে। মনে আছে অর্ক? সেই লাল গোলাপ, ওই যে সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে কাক হয়ে আমাকে দিয়েছিলে।
মনে আছে আমাদের হানিমুন এর কথা? কত কষ্ট করে সময় বের করেছিলে। বিয়ের আগেই ভেবে রেখেছিলাম আমরা সাগর দেখবো।সারাদিন রাত সাগরপাড়ের এর কোন এক নির্জন জায়গায় দুজন বসে থাকবো সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়ে। মনে আছে অর্ক যেদিন প্রথম খুব ভোরে উঠে আমরা সাগরপাড়ে গিয়েছিলাম সূর্যোদয় দেখার জন্য...শুধু তুমি আর আমি ছিলাম, আর ছিল সমুদ্রের সেই ঢেউ গুলো। তুমি আমার হাত এ হাত রেখে বলেছিলে, “ হৈম, আমরা যখন অনেক বুড়ো হবো, একদম জীবনের শেষ প্রহরে,আবার কোন এক ভোরে এভাবেই এই সূর্যোদয়ের সাক্ষী হবো । এভাবেই তোমার হাতে হাত রেখে ভাবনার সাগরে ভেসে যাবো। সেদিনের কথা ভাববো যেদিন কলেজ এর বাইরে প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম, যেদিন প্রথম তোমাকে বলেছিলাম ভালোবাসি,যেদিন প্রথম বারের মতো তোমার হাতে হাত রেখেছিলাম, যেদিন প্রথম বার একসাথে বৃষ্টি দেখেছিলাম...যেদিন পুরোটা জীবন তোমার সাথে কাটানোর জন্য নিজেকে তোমার সাথে বেঁধেছিলাম”
আমি কিছুই বলি নি অর্ক...আমি জানি তুমি সূর্যের আলোয় আমার গাল বেয়ে কিছু একটা পড়তে দেখেছিলে...আমি জানি তুমি বুঝে নিয়েছিলে তোমাকে পেয়ে আমার জীবন পূর্ণ।
মনে আছে অর্ক আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর কথা? আমি কতক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম...একদম শেষ প্রহরে এসে আমার হাতে কয়েকটি গোলাপ আর র্যা পিং পেপারে মোড়ানো একটা গিফট তুলে দিয়েছিলে...গিফট খুলে মনে হয়েছিলো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হাতে পেয়েছিলাম...। আজ পর্যন্ত আমার জন্য লেখা তোমার প্রত্যেকটি না দেয়া চিঠি। আমাদের একসাথে কাটানো প্রত্যেকটি মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি।
অরণী টা আজকাল বড্ড দুষ্ট হয়েছে...খেতে চায় না...খালি ছুটোছুটি করে। জানো অর্ক তোমার মেয়ে বাবা বলতে শিখেছে। মনে আছে যেদিন প্রথম তোমাকে ওর কথা বলেছিলাম,তুমি কেঁদে দিয়েছিলে। কত আয়োজনই না করেছিলাম ওর জন্য।মনে আছে প্রথম টেডি বিয়ার যেটা নিয়ে এসেছিলে ওর জন্য?সেই ছোট ছোট জামাগুলো, মেয়ে না ছেলে তা নিয়ে খুনসুটি গুলো? অর্ক তুমি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? আমি জানি পারছো।
যেদিন আমার লেবার পেইন উঠেছিলো তুমি শহরের বাইরে ছিলে। নার্সিং হোমে কোন ভাবে গিয়েছিলাম। তোমাকে ফোন করার সাথেই সব ফেলে ছুটে এসেছিলে। পৌঁছাতে কি পেরেছিলে অর্ক?
অরণী হবার পর তোমাকে অনেক খুঁজেছি। কত সুন্দর স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। জ্ঞান ফেরার সাথেই তুমি অরণী কে নিয়ে আমার কোলে তুলে দেবে। বলবে, দেখেছো হৈম আমার অরণী একদম তোমার মতো হয়েছে।আমি পাইনি তোমায় অর্ক। খুঁজতে গিয়ে তোমাকে পেয়েছি নার্সিং হোম এর বেড এ রক্তাক্ত অবস্থায়,মৃত্যুর সাথে লড়তে।কেন এতো তাড়াহুড়ো করেছিলে অর্ক,কেন আবার অগোছালো হয়ে গিয়েছিলে?
আজ অরণীর ২য় জন্মদিন।তোমার মেয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে অর্ক,তোমায় বাবা বলে ডাকবে বলে। তোমার কোলে উঠবে বলে।অ্যাই অর্ক,দুই বছর ধরে তো ঘুমিয়ে আছো,আর কত ঘুমাবে? ওঠো এবার।আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছো।আমি জানি তুমি কোমা থেকে জেগে উঠবে।
হয়তো আজ নয় ,হয়তো এরকমই কোন বৃষ্টির দিনে। হয়তো প্রথম সূর্যোদয় কে সাক্ষী রেখে আমার হাতে হাত রেখে আবার বলে উঠবে ,রাগকুমারী তোকে খুব বেশি ভালোবাসি রে। হয়তো একদিন সকালে অরণীর হাত ধরে আমরা আবার হেঁটে যাবো উদ্দেশ্যহীন। সেদিনও খুব বৃষ্টি হবে।
(এটি একজন রাগকুমারী এবং একটি বৃষ্টিস্নাত সকাল" শেষ পর্ব)