১. “ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা, এই মায়াবী রাতআসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার...”আজো স্পষ্ট মনে পড়ে আমার মা আমাকে বালিশে শুইয়ে মৃদুভাবে দোল দিচ্ছেন আর গান গাইছেন। অথবা যশোরের সে শীতের সকালের কথা - নরম বিছানায় ততোধিক নরম রোদে শুয়ে আছি; কানে ভাসছে যীশু দাসের গান “নাম শকুন্তলা তার...”। এর পরে বড় হতে লাগলাম, রিক্সাভাড়া বাঁচিয়ে কতজন কত কি কেনে - আমি কিনতাম গান। নিয়াজ মুহাম্মদ চৌধুরি, কুমার শানুর “পপ” হিন্দি, রিকি মার্টিনের “মারিয়া” বা লাকি আলির “সিফার”। উঠতি বয়স - নিজের ভালোলাগার উপর দন্ডি ঘোরাত স্কুলে আধুনিক হতে পারলাম কিনা, বন্ধুদের সাথে তাল মিলাতে পারলাম কিনা সে বোধ। আরো বড় হলাম - পুরনো বাংলা গান, রবীন্দ্র, নজরুল, গজল, ক্লাসিকাল আর সেমি ক্লাসিকে নিজের স্বকীয়তা খুঁজে পেলাম। ভাল লাগত এ.আর.রহমান আর জীবনমুখী। পাশ্চাত্য আমায় বেশি টানেনি। বড় জোর কান্ট্রি সংস, ডেনভার কি লোবো। গান শোনার সময় বিচার করলে আমাকে কেউ টেক্কা দিতে পারতোনা। গাইতামও না বাজাতামও না , কেবলই শুনতাম; নামায, ক্বুরান পড়া, খেলা আর ক্লাসে থাকার সময়টুকু বাদ দিলে বাকি প্রায় পুরো সময়টাতেই গান শুনতাম। পড়তে বসলে তো বটেই, ঘুমানোর সময়, ঘরে যতক্ষণ থাকতাম গানও চলতে থাকতো। সাইকেলে চড়ে ভার্সিটি যাচ্ছি - কানে গোঁজা গানের তুলো। ভারি অহংকার করে বলতাম - আমার কাছে ৩০ গিগাবাইট গান আছে - সব আমার শুনে শুনে বাছাই করা গান! এটা সে সময়ের কথা যখন আচার-অনুষ্ঠানেই আমার ইসলাম সীমিত হয়ে ছিল। পরে যখন ইসলামের স্বরূপ নিয়ে কিছুটা পড়াশোনা শুরু করলাম তখন প্রথম আমি আমার জীবন পরিব্যপ্ত করে থাকা সঙ্গীত নামক শিল্পটির সমস্যাগুলো অনুভব করতে লাগলাম।
২.ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী সবচেয়ে বড় গূনাহ হল শিরক অর্থাৎ আল্লাহর গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য ও অধিকারের ভাগ অন্য কাউকে দেয়া। সুফিদের তথাকথিত মরমী গান হল এই শিরকের আড্ডা। যেই লালন শাহের নামে আমরা এক ঢোক পানি বেশি খাই সেই লালন সাঁই প্রচার করে গেছে –
“যেহিতো মুরশিদ, সেহিতো রসূল / এই দুইয়ে নেই কোন ভুলমুরশিদ খোদা ভাবলে যুদা / তুই পড়বি প্যাচে।”অথচ ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে “আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর দাস ও বার্তাবাহক”। আল্লাহ ও তার রসুল মুহাম্মদ (সাঃ) কখনোই এক নয় বরং দু’টো সম্পুর্ণ দু”টি ভিন্ন সত্তা এবং তাদের মধ্যে প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক ছাড়া অন্য কিছু নেই।বাউল শাহ আব্দুল করিম বয়াতির একটি গান হল –
“শুধু কালির লেখায় আলিম হয় না মন রে/ কানা অজানা কে যে না জানে/আল্লাহ নবী আদম ছবি /এক সূতে বাঁধা তিন জনে”এ গান লালনের দ্বিত্ববাদকে ছাড়িয়ে ট্রিনিটিতে এসে ঠেকেছে।
বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে গানের প্রধান অবলম্বন “ভালোবাসা”। ভালোবাসার আতিশয্যে প্রায়ই ভালোবাসার বস্তুটিকে আল্লাহর জায়গায় বসিয়ে দেয়া হয়, হোক সে মানুষ কিংবা দেশ। “প্রথমত আমি তোমাকে চাই ... শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই” - কোথাও কিন্তু আল্লাহর কোন অংশ নেই, খালি “তোমাকেই” এর জয়জয়কার। কেউ ভাবতে পারেন এই “তুমি” তো আল্লাহও হতে পারে। কিন্তু সুমন আল্লাহর কথা ভেবে এই গান বাঁধেননি, এ গান যারা গায় আর শোনে তারা আর যাই হোক আল্লাহকে খুশি করতে এ গান শোনেনা।“ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা”- আমাদের অনেকেরই খুব প্রিয় একটা দেশাত্মবোধক গান। দেশাত্মবোধ মানুষের প্রকৃতিজাত একটা ব্যাপার, এটা মানুষের মধ্যে থাকবে তাই কাম্য। কিন্তু তাই বলে দেশের মাটিতে কপাল ঠেকাতে হবে কেন? গানটায় সম্বোধন করা হয়েছে কাকে? মাটিকে। এটা ঠিক আমরা মাটির উপর সিজদা করি কিন্তু সে জন্য দেশের মাটি শর্ত নয়, গোটা পৃথিবীর মাটিতে সিজদা করা যায়। সিজদা কাপড়ের উপর করা যায়, মার্বেলের উপর করা যায়; আল্লাহকে উদ্দেশ্য করলে পবিত্র যে কোন কিছুর উপরই সিজদা করা যায়। গানটাতে “তোমার পরে ঠেকাই মাথা” না হয়ে “তোমার কোলে রাখি মাথা” হতে পারত। কিন্তু রবিঠাকুর তা লেখেননি। কেন লেখেননি?এই গানটা "বন্দে মাতরম" যুগের যেখানে মা/দেবী/দেশ একটা আরেকটার সাথে মিশিয়ে মানুষকে তাঁতিয়ে দেয়া হয়েছিল। আনন্দমঠের প্রথম সংষ্করণে ইংরেজ তাড়ানোর কথা থাকলেও প্রভুর দাপটে পরের সংষ্করণগুলোতেই ইংরেজের জায়গায় যবন তথা মুসলিম তাড়াতে কলকাতার বাবুদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। বঙ্কিম যেখানে "বন্দনা"/উপাসনা বলে থেমে গিয়েছিলেন সেখানে রবিবাবু কিভাবে উপাসনা করা যায় তাই এ গানে গেয়ে গেছেন। এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা? আচ্ছা পরের লাইনগুলোও পড়ুন - “তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে, তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,তোমার ঐ শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা।”
শিরকের আরেকটি অফুরন্ত ভান্ডার হল হিন্দি গান। অনেক দিন হয়ে গেল হিন্দি গান শোনা হয়না, কিন্তু চলতি পথে মুফতে শোনা গানগুলার মধ্যে আমি যে পরিমাণ শিরকের খোঁজ পাই তাতে বলিউডের নেট শিরকের প্রোডাকশনের কথা ভাবতেও ভয় লাগে। “তুঝে রাবসে ভি জিয়াদা ভারোসা কিয়া” বা “ইয়া আলি, মদদ আলি” টাইপের চটুল গানে তো শিরক আছেই, বোম্বে ছবির “তুহি রে” এর মত কালোত্তীর্ণ গানেও “মওত ঔর জিন্দেগি তেরে হাতো মে দে দিয়া রে” বলে নিজের প্রেমিকার হাতে অবলীলায় আল্লাহর ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হয়েছে।লতা-কিশোরের একটা গান আমার খুব প্রিয় ছিল এর অসাধারণ কম্পোসিশনের কারণে-“কারভাটে বাদালতে রেহি সারি রাত হাম, আপ কি কাসাম... আপ কি কাসাম”অথচ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করা হারাম, তা শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
এই শিরক এত ভয়াবহ একটা পাপ যার সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন - “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে অংশী স্থাপনকে ক্ষমা করেননা কিন্তু তিনি এর চেয়ে ছোট (পাপ) যাকে খুশি ক্ষমা করেন”এর শাস্তি অনন্ত আগুন।
৩.আধ্যাত্মিক গানগুলোর আরেকটি ভয়াবহ সমস্যা হল এগুলোতে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী অনেক আদর্শ প্রচার করে থাকে। যেমন “এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া এত যত্নে বানাইয়াছেন সাঁই” - গানটির পরতে পরতে কুফরি মতবাদ ছড়িয়ে আছে। আল্লাহ জ্বীন এবং মানুষকে যে তাঁর ইবাদাতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে - এই সত্যটাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বিভিন্ন বিভ্রান্ত দর্শনের সাহায্যে। “যেমনি নাচাও তেমনি নাচে, পুতুলের কি দোষ” - এই চিন্তাধারা মানুষের কর্মফল ও পরপারে জবাবদিহীতার মূলে কুঠারাঘাত করে। আবার “তুমি বেহেশ্ত তুমি দোযখ তুমি ভালো-মন্দ” - এই দর্শন সবকিছুতেই আল্লাহর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়ে প্রকারান্তরে আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে। রবিবাবুও এ ধারণা প্রচার করে গেছেন এমন এক গানে যা আমাদের কাছে খুব নিরীহ মনে হয় - “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, নইলে মোদের রাজার সনে মিলবো কি শত্তে ”। রবীন্দ্রনাথের পূজার গান আর নজরুলের শামা সংগীত বাদ দিলেও আমরা খুব ভালোবেসে শুনি এমন অনেক রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলগীতিতে ভুরি ভুরি শিরক আর কুফর ছড়িয়ে আছে।
“তারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবেনা মন ভরবেনা” বাংলার সিনেমার খুব জনপ্রিয় এই গানে খুব স্পষ্টভাবেই হিন্দু-বৌদ্ধ দর্শনের জন্মান্তরবাদ প্রচার করা হয়েছে।
কাউকে যদি বলা হয় “তোমার বাবা খুব নিষ্ঠুর, মনে কোন দয়া-মায়া নেই”, তাহলে তেড়ে-ফুঁড়ে মারতে না গেলেও মনে ব্যাথা কি সে পাবেনা? আমরা দাবী করি আমরা মুসলিম অথচ পবনদাস বাউলের গান শুনি-শুনাই -“দিন-দুনিয়ার মালিক খোদা, দিল কি দয়া হয়না? তোমার দিলকি দয়া হয়না?” উদার মুসলিম হতে গিয়ে আল্লাহকে আর কত অপমান করব আমরা?
আমরা নিত্তদিন যে গানগুলো শুনছি তার শিরক আর কুফরের তালিকা করতে গেলে পিএইচডি করা লাগবে। আসলে ইসলামের মৌলিক জিনিসগুলো সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই কম। সে জ্ঞান থাকলে এই গানগুলোর ইসলামবিধ্বংসী রূপ আমাদের চোখে পড়ত।
৪.অনেকের মনে হতে পারে আমি বাড়াবাড়ি করছি। অনেকে যুক্তি দেখাতে পারে গায়ক তো আর ঐ অর্থে গাইছেননা। আমরা মুখের কথায় মানুষকে বিচার করি, তার মনে কি আছে সেই খবর নেয়া দুরুহ কাজ। কেউ যদি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নোংরা ভাষায় তাকে অপমান করে একটা গান গায় তবে সে চাপাতির কোপ না খেলেও লাঠির বাড়ি যে খাবে তা নিশ্চিত এবং তার “আমি তো আসলে এটা ‘মিন’ করিনি” - এ জাতীয় কোন অজুহাতই ধোপে টিকবেনা। মনে যদি ভালো থেকেই থাকে তবে মুখে খারাপ কেন বলা?আমি নিজেই দাবী করতাম যে আমি তো আর হিন্দি বুঝিনা, শিরকওয়ালা গান শুনলে আমার কেন পাপ হবে। যদি কোন উর্দু না জানা মানুষ সারাদিন “পাক সার জমিন সাদ বাদ” শুনে এবং জোর ভল্যুমে অন্যদেরও শোনায় তবে সে ঠিক কি জাতের বাঙ্গালী তা বিবেচ্য। তেমনই গান থেকে যদি কেউ শিরক-কুফরি শিক্ষা না নিয়েও থাকে বা শিরক/কুফরির নিয়ত না করেও থাকে তবুও সে আখেরে কিভাবে আল্লাহর কাছে পার পাবে তা ভাববার বিষয়। কারণ আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে যে রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন -“A person may speak a word, not realizing what he is saying, and he will fall because of it into the Fire further than the distance between the East and West.” Bukhaari (5996) and Muslim (5304)
আমরা চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি কিন্তু তার মানে এই না যে তাহলে সমস্যাটা চলে যাবে। আমরা কোন কিছুকে শিরক আর কুফর বলে চিনতে পারছিনা মানে এই নয় যে সেটা শিরক বা কুফর নয়। আর শয়তানের পদ্ধতি এটাই যে সে খারাপ জিনিসগুলোকে আমাদের সামনে সুশোভিত করে তোলে। আমরা দেখেও দেখিনা, শুনেও শুনিনা - অন্য কেউ ভুলটাকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলে গোস্বা করি।
৫.আমাদের প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন - “আমার উম্মাতের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কিছু মানুষ আসবে যারা ব্যভিচার, রেশমি কাপড়, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে” (সহিহ বুখারি - ৫৫৯০)বাদ্যযন্ত্র শুধু নিষিদ্ধই নয়, কোন মাত্রার নিষিদ্ধ তা এ হাদিস থেকে বেশ বোঝা যায়। আরো বেশি বোঝা যায় এ ভবিষ্যদ্বাণী কতটা সত্যি।সুরা লুক্বমানের ষষ্ঠ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন - “আর মানুষের মধ্য থেকে অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহর পথ থেকে (মানুষকে) বিভ্রান্ত করার জন্য অসার বাক্য ক্রয় করে এবং তারা আল্লাহর প্রদর্শিত পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে; তাদেরই জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।”এই “অসার বাক্য” এর মধ্যে যে গান-বাজনা অন্তর্গত তা সকল মুফাসসির একমত। খেয়াল করলে দেখা যায় এখানে আল্লাহ ভয়ংকর বা মর্মন্তুদ শাস্তির কথা বলেননি, বলেছেন অবমাননাকর শাস্তি। সারা পৃথিবীতে মুসলিমরা সঙ্গীত সাধনায় মত্ত থাকতে গিয়ে নিজেদের উপর লাঞ্চনা-গঞ্জনা আর অপমানের শাস্তি চাপিয়ে নিয়েছে।
৬.নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি - গান শোনা ছেড়ে দেয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু শিরক-কুফরি ভর্তি গানের সাথে কোন আপোষ থাকতে পারেনা। আর বাজনা আছে এমন গান শোনা ইসলাম সম্মত নয় একথা আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। আমাদের মেনে নিতে হবে মিউজিক শুনে আমরা পাপ করছি, নয়তো রসুলের ভবিষ্যদ্বাণী করা দলে আমরা পড়ে যাব। আর যদি আমরা মেনে নেই এটি পাপ তবে সেটা ছাড়ার একটা চেষ্টা আমাদের মনে মনে থাকবে। নয়তো কোনদিনই গান বন্ধ করে মিশারির কন্ঠের ক্বুরান কিংবা ইউসুফ এস্টেসের একটা লেকচার শোনার সুযোগ আমাদের হবেনা।
আমি হাজ্বে গিয়ে আল্লাহকে বলেছিলাম তিনি যেন আমাকে গান থেকে মুক্তি দেন। হাজ্ব থেকে ফিরে এসে দেখলাম যেই আমি গান শোনা ছাড়া একটি দিনও কাটাইনি সেই আমার মধ্যে গান শোনার কোন ইচ্ছাই জাগেনা। এজন্য আমি বলি আমি গান ছাড়িনি, গানই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
আমাকে ছোটবেলায় মা বলতো, আজ ভাল করে পড়, পরীক্ষা শেষ করে কাল থেকে যত খুশি খেলবি। আমি দশ দিন খেলবো বলে একদিনের খেলা তুলে রাখতাম। আমি অনন্তকাল ধরে অজাগতিক অদ্ভুত সুন্দর সব সুর শুনবো বলে যেকটা দিন বাঁচি সে ক’টা দিন যদি বাজনাওয়ালা গান না শুনে কাটিয়ে দেই তাহলে কি খুব বোকামো করা হবে?
ছোট্ট একটা বাচ্চা, বয়স দুই কি তিন, বীরদর্পে হাটা দিল রাস্তা পার হবে বলে। তুমি পিছন থেকে ধরে ফেললে। সে যতই দাবী করুক সে সব গাড়ি চেনে এবং সে দেখেশুনে পার হতে পারবে তুমি কি তাকে ছেড়ে দেবে? সে এবার যদি বলে রাস্তা তো পার হবার জন্যেই তবুও কি তুমি তাকে ছেড়ে দেবে? আমি হলে ছাড়তামনা। কারণ হয়ত সে পার হতেও পারে কিন্তু সম্ভাবনা বেশি যে সে পড়ে যাবে বা খুব জোরে চলা একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খাবে। এমনও হতে পারে বাচ্চাটাকে বাচাঁতে গিয়ে একটা গাড়ি হার্ডব্রেক করলো আর সেটা উলটে গেল। ব্যস্ত রাস্তা হলে তো কথাই নেই সেটাকে পিছন থেকে আরো কয়েকটা গাড়ি ধাক্কা মারবে। এ সব কিছুই যে হবে এমন কথা নেই কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি কারণ দু’তিন বছরের একটা শিশুর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। সে যতই দাবী করুক তার সামর্থ্যের কথা -আসলে তার সেটা নেই এবং সে সেটা জানেনা। আমরা মানুষেরা আসলে এই ছোট্ট বাচ্চাটার মত যে ভাবে সে জানে তার জন্য কি ভাল; আসলে সে জানেনা।
সুর আসলে কি? খেয়াল করলে দেখা যাবে এটা আসলে সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি - এ সাতটা নোটের অসংখ্য পারমুটেশন-কম্বিনেশন। কিভাবে সাজালে এটা মনকে ছুঁয়ে যাবে তা খুব মেধাবী কিছু মানুষের বিমূর্ত সৃষ্টি। এটা কিন্তু টেইলর-মেড, এমনভাবে ডিজাইন করা যেন তা মানুষের মনে দাগ ফেলে, তাকে আলোড়িত করে। কিন্তু প্রাকৃতিক সুর যেমন ঝর্ণার শব্দ বা পাখির ডাক কিন্তু মানুষকে মুগ্ধ করে কিন্তু মনকে ঘন্টার পর ঘন্টা ভুলিয়ে রাখেনা। এই সুর মানুষের আত্মার জন্য সেই কাজ করে যা মদ শরীরের জন্য করে, সেটা হল ভুলিয়ে রাখা। গান-বাজনা মানুষকে সেই অমোঘ সত্যটা ভুলিয়ে রাখে যে এই পৃথিবীর সময় খুব কম, একে ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে অন্য ধামে। আর সেখানে ভাল থাকার জন্য আমাদের অনেক কিছু করতে হবে - জানতে হবে, শিখতে হবে, মানতে হবে। কিন্তু কাউকে যদি ভুলিয়ে রাখা যায় সেই অবধারিত সত্য সম্পর্কে তবে সে না সতর্ক হবে না তার উচিত কাজগুলো সে করবে। তুমিই বল গান আর ক্বুরান কি এক সাথে শোনা যায়? কোন গানের অনুষ্ঠানের শুরুতে কি কেউ ক্বুরান তিলাওয়াত করে? তোমাকে আল্লাহর বাণী ক্বুরান থেকে দূরে রাখার জন্যই যে নিত্য-নতুন সুর আবিষ্কৃত হয় তা কি তুমি বোঝনা? এক মিউজিক তুমি কতবার শুনতে পারবে - কয়েকশ বার? হাজারবার? তারপর তুমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যাবে। তোমার মন নতুন কম্বিনেশন খুঁজবে। তোমার অসম্ভব প্রিয় সুরটি তোমার অসহ্য লাগবে। অথচ তুমি কি জান সুরা ফাতিহা একজন মানুষ শুধু ফরজ নামাজেই ৩৪ বার পড়ে, নফল মিলিয়ে তা ৬০ ছাড়িয়ে যায়। এটা সে ৩৬৫ দিন পড়ে, বছরের পর বছর পড়ে, তাও কিন্তু বিরক্তি আসেনা - একি নেহায়েত কাকতালীয় ব্যাপার?
মজার ব্যাপার হল নেশার যেমন স্তর বাড়ে সুরের ক্ষেত্রেও তাই। যে সিগারেট দিয়ে শুরু করে সে গাঁজা, চরস, কোকেইন, হিরোইন ধরে। মাদকের মানও বাড়ে, মাত্রাও। ঠিক তেমনি তুমি যদি ওয়ার্ল্ড মিউজিকের ক্রমবিবর্তন দেখ তাহলে দেখবে সুর শেষ হয়েছে অসুরে (ডেথ, থ্র্যাশ, ব্ল্যাক, স্লাজ মেটাল) আর ভালোবাসা শেষ হয়েছে ঘৃণা আর উন্মাদনায়। হালের ইংরেজি ব্যান্ডের গানগুলোর মধ্যে ধ্বংস, ধর্ষণ আর ধর্মহীনতার কেতন ওড়ে। এরা আল্লাহকে অস্বীকার করে কিন্তু শয়তানকে পূজা করে, অনুকরণ করে। শয়তানকে গানের কথায় ধারণ করে, স্টেজের অঙ্গভঙ্গীতে, মিউজিক ভিডিওগুলোতে, এলবামের কাভারে, পরণের গেঞ্জিতে, মুখের মুখোশে। এনিগমা থেকে শুরু করে আয়রন মেইডেন, ব্ল্যাক সাবাথ, লেড যেপেলিন... আর কত বলব?
বিলাস, ব্যভিচার, মাদক কিন্তু সঙ্গীতের হাত ধরে আসে। তুমি কি কখনো তোমার বাবাকে বলতে পারবে - “I want a double boom…. Together in my room”? অথচ এমটিভিতে এগান শুনতে শুনতে তুমি সেই গায়িকার উদ্দাম নাচ দেখছ, তোমার বাবাও হয়ত দেখছে, কেউ কিছু মনে করছে না। খুব বেশি লজ্জা লাগলে তুমি এক টিভিতে দেখছ, তোমার বাবার টিভি অন্য ঘরে। তোমাকে কি কেউ বলতে সাহস পাবে - “আসো আমার ঘরে, আমরা ঘরের দরজা বন্ধ করে রাত কাটাই” ? জেমস কিন্ত বলছে “চাল চালে আপনি ঘর” তুমি শুনছ, সুরের তালে তালে মাথা দুলাচ্ছ। কত নোংরা একটা কথা সুন্দর সুরে গিটার বাজিয়ে বলায় তোমার কত ভালো লাগছে! তোমার স্কুল পড়ুয়া ছোট বোনটি কি কখনো তোমার সামনে অন্য কোন ছেলেকে বলতে সাহস পাবে “আসো আমার শরীরে হাত দাও, আমাকে চুমু খাও” ? অথচ সেই মেয়েটি যখন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নাচের তালে তালে দশটা ছেলের দিকে তাকিয়ে গাইছে “যারা যারা টাচ মি টাচ মি, কিস মি কিস মি” তুমি খুশিতে হাততালি দিচ্ছ।
তুমি দাবি করতে পার তুমি ক্লাসিকাল গান শোন, এ সব গা-গরম গান তোমার ভালো লাগেনা। তুমি না হয় উতরে গেলে কিন্তু তোমার ভবিষ্যত প্রজন্ম? আমার বোন রবীন্দ্র শোনে সবসময় কিন্তু ভাগ্নে শোনে রিহানা! তুমি যদি বাঁধে ছোট একটা গর্ত করে অল্প পানি আসতে দাও তবে সেই ছোট্ট ছিদ্র কিন্তু ছোট্ট থাকবেনা, বড় হবে। যে বাধঁ ভাঙার আওয়াজ আজ চারদিকে পাওয়া যায় তার শুরু কিন্তু ছোট্ট একটা ফাটল দিয়েই।
পঞ্চাশের দশকে সারা পৃথিবীতে বছরে যে ক’টা এলবাম বের হত আজ শুধু বাংলাদেশেই তার চেয়ে বেশি বের হয়। পঞ্চাশের দশকে সারা পৃথিবীতে বছরে যে ক’টা রেপ হত আজ শুধু বাংলাদেশেই তার চেয়ে অনেক বেশি হয়।
শিল্প-সংষ্কৃতি অনেক এগিয়েছে, মানুষের মানসিকতা? জগজিত সিং-এর কন্সার্টের টিকিট বিক্রি হয় ১০,০০০ টাকায়। সেইসময় কুড়িগ্রামে একটা মেয়ে না খেতে পেয়ে গলায় দড়ি দেয়। এই ১০,০০০ টাকার মধ্যে কি সেই মেয়েটাকে শুষে খাওয়া টাকা নেই?
প্রযুক্তির কল্যাণে সুর ছড়িয়ে পড়েছে, তবে অসুরই বেশি। ললিতকলা মানুষকে বন্য করেছে, সভ্য করেনি। প্যারিস হিলটনকে কি তোমার সভ্য মনে হয়? ম্যাডোনাকে? ব্রিটনি স্পিয়ার্স? তোমার ভাই এল্টন জনের চমৎকার অনুকরণ করতে পারে, সে যে শুধু গানই নিয়েছে সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নেয়নি কিভাবে নিশ্চিত হলে?
তুমি বলতে পারো এগুলো বাণিজ্যিকধারার গান। কিন্তু একটা জিনিসের বাণিজ্যিকিকরণ কখন হয়? যখন তা অনেক মানুষ কেনে। “সোনা বন্ধু তুই আমারে ভোঁতা দা দিয়া কাইট্যালা” টাইপের গান শুনে আর ভিডিও দেখে তৈরি হয় ঐ সব নরপশু যারা তিন বছরের বাচ্চাকেও রেহাই দেয়না। আমরা মুখ ফুটে কখনো এদের বাঁধা দিইনি। এই নোংরা বাণিজ্যিকিকরণের দায় তো আমাদের সুশীল সঙ্গীতের উপরেও বর্তায়, তাই নয় কি? তুমি হয়তো বলতে পারো রাগ ভৈরবীর তবলার বোল শুনে তোমার আত্মিক উন্নতি হয়। কিন্তু আমার যে সেই বোলের সাথে একজন নাচনেওয়ালীর কোমর দুলানো দেখতে ইচ্ছে করে। সপ্তাহখানেক পর সেই কোমর ধরে দেখতে ইচ্ছে করে। আর এই সমাজে আমার মত লোকই যে বেশি। বিশ্বাস করলে না? সুনীলের “সেই সময়” পড়ে দেখতে পার। আমাদের আজকের সমাজের সুপারস্টার বাঈজীদের উদ্ভব হল কিভাবে জানতে পারবে।
তুমি যদি ধর্মগুলোর মধ্যে Corruption pattern খেয়াল করে তাহলে দেখবে হিন্দুদের খোল-করতাল দিয়ে কীর্তন, খ্রিষ্টানদের পিয়ানো-গিটার দিয়ে ক্রিসমাস ক্যারল আর বাউলদের ঢোল-দোতারা দিয়ে মুর্শিদী গান সবগুলোতেই সঙ্গত-সহ-সঙ্গীতকে উপাসনার স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে। আমরা এখন গানের সুরে মিলাদ করি। বাদ্যযন্ত্র যে হারাম এই বোধটা আমাদের ভিতর থেকে চলে গেলে আমাদের মসজিদগুলোতে দেখবে বাঁশি বাজিয়ে ডাকছে কিংবা হারমোনিয়াম বাজিয়ে মিলাদ। ওরা কি বলবে জানো? আমরা তো খারাপ কিছু করছিনা, আল্লাহর গুণগান করছি।
আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তার কোন কিছুই absolute evil নয়। সুর-বাদ্যযন্ত্রেরও ভাল দিক আছে, যেমন তা আমাদের ভাললাগার একটা আবেশ দেয়। কিন্তু এটা আমাদের বিশ্বাস যে ইসলামের নিষিদ্ধ করা জিনিসগুলো আমাদের যতটুকু ভালো করে, তারচেয়ে খারাপ করে অনেক বেশি। আর সে জন্যই আমাদের বৃহত্তর ভালোর কথা চিন্তা করে আল্লাহ আমাদের সেটা নিষেধ করেছেন। তুমি হয়তো সেই শ্রেণীর মধ্যে পড়না বাদ্যযন্ত্র যাদের পশুর শ্রেণীতে নামিয়ে দেয়। কিন্তু একবার যখন কোন জিনিস নিষিদ্ধ হয় তখন তা পুরো মানব জাতির জন্যেই হয় - কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য তার অনুমতি থাকেনা। কেউ শরিয়তি নিয়মের উর্ধে নয়। বেশিভাগ মানুষের ক্ষেত্রে সুর আর ধর্ম একসাথে চলেনা। গানের আসর থেকে উঠে গিয়ে নামায পড়তে দেখেছ কাউকে? শিল্পীদের? শ্রোতাদের?
তুমি ভাবতে পারো কেন তুমি অন্যদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবে শাস্তি পাবে? এটাই তো ইসলাম। তুমি তোমার ভালোলাগাকে আল্লাহর ভালোলাগার কাছে সঁপে দিলে। তোমার ইচ্ছেকে তাঁর ইচ্ছের অধীন করে দিলে। তুমি এই আশায় বুক বাঁধলে যা তুমি ছেড়েছ তার চেয়ে বহুগুণে তুমি ফেরত পাবে। একেই বলে আত্মসমর্পণ অর্থাৎ ইসলাম।
গান শোনা ইসলামে একদম হারাম তা বলা যাবেনা। মা শিশুকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে পারে। স্ত্রী ভালোবেসে স্বামীকে গান শোনাবে তাতে দোষের কিছু নেই। ঈদ-বিয়ে ইত্যাদি পরবে ছোটরা গান গেতে পারে যাতে নোংরা কথা থাকবেনা, খুব বেশি বাজনা থাকবেনা।
কিন্তু আমাদের যে কথাটা মনে রাখতে হবে সৃজনশীলতা মানুষকে দেয়া আল্লাহর অনেক বড় দান। এ দিয়ে পরমাণু বিদ্যুত তৈরি হয়েছে বটে, হিরোশিমা-নাগাসাকিও কিন্তু এরই অবদান। মোজার্টের সৃজনশীলতায় কার কি উপকার হয়েছে জানিনা, ইবনুল কাইয়ুমের লেখা পড়ে অনেক মানুষ তাদের বিশ্বাস রক্ষা করতে পেরেছে। যে সৃজনশীলতা ধ্বংসের পথ খুলে দেয় তাকে আমরা চাইনা। যে শিল্পের পরিণাম একটা কল্যাণ আর শত অকল্যাণ তা থেকে দূরে থাকাই ভালো।
মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর লোকটিকে জিজ্ঞেস করতে পারবে সে কন্সার্টে যাবে কিনা? আমরা সবাই কিন্তু দিনকে দিন মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি। ওর সময় হয়ে এল বলে। আর আমাদেরটা আমরা জানিনা। যদি মরণকে সত্যি মানো তবে এমন কিছু করো যা মরণের পরেও কাজে আসবে। আর সেগুলো করতে গেলে দেখবে সময় কত কম। সময় আসলেই কম।
সূত্র : http://monpobon.tk/