শুরুতেই আমরা দেখে নেই, আইএলও আদিবাসী আর উপজাতির কি সংজ্ঞা দেয় ?
আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী - "তারাই উপজাতি হিসেবে বিবেচিত হবে যারা নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রথাগত জীবন যাপন করে। যাদের সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রা মূল জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা এবং যাদের নিজস্ব সামাজিক প্রতিষ্ঠান, প্রথা ও আইন আছে।"
আর আদিবাসীদের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য ছাড়াও আরো একটি বাড়তি বৈশিষ্ট্য যোগ করে বলা হয়েছে - "কোনো এলাকা অন্য কারো দ্বারা দখলকৃত হওয়ার আগে বা ওই এলাকায় অন্য কারো আগমনের আগ পর্যন্ত (প্রাক-ঔপনিবেশিক) যাদের ঐ এলাকায় বসবাসের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে" তারাই ওই এলাকার আদিবাসী। বস্তুত এই অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্যটিই আইএলও কনভেনশনে উপজাতি এবং আদিবাসীদের আলাদা করেছে।
এ প্রেক্ষিতে আদিবাসী সংজ্ঞাটি মূলত কোনো জনগোষ্ঠীর নিজ মূল আবাসভূমিতেই প্রযোজ্য হবে যেখানে উক্ত গোষ্ঠী ধারাবাহিকভাবে বসবাস করে আসছে।
আমরা এবার আসি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের মূল সন্ধানে। প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বিরান ভূমি হিসেবে পড়ে ছিলো মূলত বসবাসের অনুপোযোগীতার কারনে। মূলত ব্রিটিশ আমল ( ঔপনিবেশিক আমল) থেকেই এঅঞ্চলে দু-একটি ছোটখাট যাযাবর জাতীয় জনগোষ্ঠি সহজ শিকারএর উদ্দেশ্যে অস্থায়ীভাবে এখানে অবস্থান করা শুরু করে। তখন থেকেই ব্রিটিশ সরকারের স্থানীয় ফোর্সের সাথে এই উপজাতি গোষ্ঠির খুটখাট সংঘর্ষ ঘটা শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার এই উপজাতীয় গোষ্ঠিগুলিকে নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্যে নেপালীজ গুর্খাদেরকে এখানে নিয়ে আসে, কালক্রমে এই গুর্খারাও এখানে রয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকারেরই নীতির (মূলত আর্থিক) কারনে হিমালয় অঞ্চল থেকে গুর্খারা, ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরা থেকে ত্রিপুরারা, বার্মার আরাকান থেকে চাকমারা, ভারতের লুসাই পাহাড় অঞ্চল থেকে লুসাইরা এবং আরও ছোটছোট ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি এখানে এসে বসতি স্থাপন করে।
অন্যদিকে ইতিহাস এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমাদের লোকগাথা অনুযায়ী তাদের মূল নিবাস ছিলো ঐতিহাসিক চম্পকনগরে। এখন প্রশ্ন আসে এই চম্পকনগরের অবস্থান কোথায় ? সেই ইতিহাসই আবার উত্তর দেয় বর্তমান মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের ইরাবতী নদীর তীরেই ছিলো এই চম্পকনগরের অবস্থান। তারমানে ঔপনিবেশিক আমলে সৃষ্ট উপজাতিয় গোষ্ঠির মূল আবাসস্থল পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিলো না। নৃতাত্বিক দিক থেকে পার্বত্য উপজাতিরা মঙ্গোলীয়ড রক্তের এবং সিনো-টিবেটিয়ান ভাষা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রামের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এর অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা ডিস্ট্রিক্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আর ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম এক্ট জারি করে মূলত পাহাড়ী উপজাতি জনগোষ্ঠি থেকে সুষ্ঠভাবে ট্যাক্স আদায় করার্থে। সেখানকার বর্তমান প্রশাসনিক নিয়মকানুনএর (রাজা/সার্কেল চীফ/হেডম্যান/কারবারী) প্রায় সবগুলিই ব্রিটিশদের তৈরী করা।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এই উপজাতীয় জনগোষ্ঠির বৃটিশ সরকার কর্তৃক সৃষ্ট নেতাস্থানীয়রা ইন্ডিয়ার সাথে মার্জ করারই পক্ষপাতী ছিলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত্য সেটা আর হয়ে উঠেনি। পার্বত্য সমস্যার শুরুও সেখান থেকেই। পাকিস্থান আমলে কাপ্তাই লেক তৈরী করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনএর সময় অনেক সেটেলার পাহাড়ী জনগোষ্ঠির পুনরায় ভারতে টেম্পরারী সেটেলার হওয়া দিয়েই যার বিস্তৃতি। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর নতুন সংবিধান আমাদের জাতিগত পরিচয় ঠিক করে "বাঙ্গালী"। আর সেবাস্তবতায় পাহাড়ী ছোট-ছোট নৃ-গোষ্ঠির প্রতি বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহবান ছিলো - "তোমরা বাঙ্গালী হয়ে যাও"। কিন্তু উপজাতিয় নেতারা তাতে সাড়া দেন নি বা দেয়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এর কিছুদিন পরেই মানবেন্দ্র লারমারা ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করে যেটাকে খুনোখুনির পরিস্থিতিতে নিয়ে যায় বৈদেশিক সহায়তায়। এই জনসংহতি সমিতিরই সামরিক উইং ছিলো "শান্তি বাহিনী"। সে আরেক ইতিহাস।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:২০