বাঁশের ৩ নং পা নিয়ে কলাবন এর ভিতর দিয়ে সেগুনের বন হয়ে সামনে চলা শুরু করলাম। মাটির রং লালছে প্রায়। আঁকাবাঁকা ট্রেইল সামনে এগিয়ে গেছে। আমরা সে পথে যাচ্ছি। যত সামনে এগুচ্ছি বন ততই গভীর হচ্ছে। আতা ভাইকে বললাম, পুরো পথই কি এরকম ? উনি মুচকি হাসি দিয়ে সামনে এগুতে বললেন। মাঝে কয়েকটা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে এসেছি। একটা ত্রীমোহনায় এসে আতা ভাই বললেন, ডানদিকের রাস্তা পাহাড়ী আর সোজাটি গেছে ঝিরি হয়ে। দুটিরই গন্তব্য হামহাম। কোন পথে যেতে চাই ? আমি জানতে চাইলাম, কোনটা তুলনামূলকভাবে সহজ পথ ? উনি বললেন, ঝিরি হয়ে গেলে পথের বেশীরভাগেই পানি পাব। শুধু একবার একটি পাহাড় পার হতে হবে। আর পানি এভয়েড করতে চাইলে পাহাড়ীয়া পথে যেতে পারি। তবে ৭ থেকে ৮ টা ছোট পাহাড় টপকাতে হবে।
পাহাড় টপকানোর চাইতে শীতে পানি বেশী হবে না ভেবে ঝিরি পথই বেছে নিলাম। এতক্ষন সাথে বয়ে নিয়ে চলা বাঁশটাকে অর্থহীন মনে হচ্ছিলো। আতা ভাইকে বললামও সেকথা। উত্তরে উনি বললেন, সামনে বাঁশ কি কাজে লাগে তা দেখতে পাবেন।
যদিও তখনও রোদের দেখা মেলেনি, তারপরও সকালবেলার পাহাড়ী পথে নাম না জানা মিষ্টি পাখির কিচির মিচির মনটাকে ভাল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। গাইডের দেখানো পথেই হঠাৎ বেতবনের ভিতর ঢুকে পড়লাম। একটি বনমোরগ আমাদের হঠাৎ আগমনে বিরক্ত হয়ে ডানা ঝাপটিয়ে বনের আরও গভীরে দে ছুট। দেশীয় মোরগের মত গাট্টাগোট্টা নয় বরং ছিপছিপে গড়নের লাল-কালো রংয়ের বনমোরগটি দেখে আমরা যে লোকালয় পেরিয়ে বনের মাঝে চলে এসেছি তাই মনে পড়িয়ে দিলো।
বানরদের একটা গ্রুপও কিছুক্ষনের মাঝেই আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালো। যদিও ভদ্রতা দেখিয়ে গাছ থেকে নামেনি।
গাইড সামনেই আমাদেরকে পানিতে নামতে হবে বলে সাবধান করে দিলো। বলতে না বলতেই হাঁটু পানির সামনে আমরা চলে এলাম। কোথাও হাঁটু, কোথাও গোড়ালী, আবার কোথাও কোমর ছাপিয়ে গেছে পানির গভীরতা। কখনও পানির পাশ দিয়ে,কখনও এর মাঝ দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বাঁশটি কি কাজে লাগবে তা এখন আর আমি মুখেও আনছিলাম না। দেখতে পাচ্ছি বাঁশটিই এখন জান-প্রাণ সবই। আমার এখন অবস্থা এরকম - দরকার হয় নিজের একটা পা ফেলে দিতে রাজী আছি তবুও বাঁশ হাত থেকে ছাড়বো না। বাঁশ ছাড়া এক পাও সামনে এগুনো সম্ভব নয়। প্রচন্ড পিচিছল পথ। পাহাড়ের ঢাল বা ঝিরির কিনার দিয়ে হাঁটার চাইতে পানির মাঝে দিয়ে এগিয়ে যাওয়াই বরং তুলনামূলক ভাবে সহজ। প্রতিটা স্টেপ ফেলার আগে হাতের বাঁশ দিয়ে পানির গভীরতা বা পানিতে অন্য কোন সমস্যা আছে কিনা তা টেষ্ট করে নিতে হচেছ। আতা ভাই আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচেছন। পিচ্ছিল জলেডোবা পথ পেরিয়ে হঠাৎই শুরু হলো পিচ্ছিল পাথুরে পথ। মনে হলো এতক্ষণই ভাল ছিলাম। পাথুরে পথ কাদামাটির পথের চাইতে আরও বেশী বিপদজনক। নিজের শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে পথ চলাটাকে চ্যালেঞ্জই মনে হচ্ছিলো। একবার না পেরে পাথরেও উপর হোঁচট খেয়ে পড়লামও। আমার ভ্রমনসঙ্গী রেজাতো একবার তার হাতের বাঁশসমেত আমার গায়ের উপর হুড়মুড় করে পড়ল। তার বাঁশটি আমার কপালে সজোরে আঘাত করেছিলো। অল্পের জন্য চোখে আঘাত পাইনি। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে শক্তি সঞ্চয় করে আবার পথচলা। শীতকাল হওয়ায় সাপ বা জোঁকের ভয় নেই ই বলা যায়। তবে অন্য সিজনে এই পথে জোঁকের চুম্বন না পাওয়টাই দুর্ভাগ্য ! এখন পর্যন্ত্য আমরাও সেই দুর্ভাগাদরেই দলে আছি মনে হয়!
নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে পথ চলাই যেখানে দায়, সেখানে ছবি তোলার কথা চিন্তা করাই বোকামী বলে মনে হচ্ছিলো। তার পরও যখনই তুলনামূলকভাবে একটু সহজ পথ পেয়েছি সেখানেই ক্যামেরাটি হাতে তুলে নিয়েছি। এভাবেই এই কঠিন পথের কয়েকটি ছবি তুলেছি, যা এই পথের সৌন্দর্য্যকে ১ পারসেন্টও তুলে আনতে পারেনি। পথের সৌন্দর্য্যকে ছবিতেতো তুলে আনতে পারিনি, ভাষায়ও প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই, তাই সে চেষ্টাও আমি করবো না। শুধু একটা কথাই বলব, লাইভ দেখা ছাড়া এই পথের বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়।
গাইড আমাদেরকে সাবধান করলো, সামনেই আমাদের যাত্রাপথের একমাত্র পাহাড় । পাথুরে পাহাড় নয়, মাটি ও পাথরের মিশ্রণ। আসলে পাহাড় নয়, বড় টিলা বলা যায়। তার কাছ থেকেই জানলাম, এটাকে মোকামটিলা বলা হয়। মানুষের হাতে তৈরী সিঁড়ির ধাপ টিলাটির মাথা পর্যন্ত্য উঠে গেছে। আল্লার নাম নিয়ে উঠা শুরু করলাম। একহাতে বাঁশ অন্য হাতে লতা-শিঁকড় যাই পাচ্ছি তাই আঁকড়ে ধরে অবশেষে টিলাটির মাথায় পৌঁছালাম। রেষ্ট নেয়ার জন্য কিছুক্ষণ থেমে আবার পথ চলা শুরু করলাম। এবার এগিয়ে যাচ্ছি বাঁশ বাগানের ভিতর দিয়ে। বাঁশের কঞ্চি এসে লাগছে চোখেমুখে।
এবার পাহাড়টির গা বেয়ে নেমে যাবার পথ দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ে উঠাটা যতটা কঠিন নামাটা তার চাইতও কম কঠিন নয়। ভোরের কুয়াশায় পুরো পথই ভিজে থাকায় চলতে অসুবিধা হচ্ছিলো। আর পথটি যদি হয় পিচ্ছিল তাহলে তো কথাই নেই ! কোনভাবে পা হড়কালে সোজা অনেক নিচের পাথুরে ঝিরি বা খালে। এই পথটিও কোন মতে পার হয়ে এলাম। আবার সামনে পড়ল পূর্বের পানিপথ। এটা বিখ্যাত পানিপথের যুদ্ধের পানিপথ নয়, হামহামে যাবার পানিপথ বা ঝিরিপথ। আড়াই ঘন্টার মত হেঁটে এসেছি। গাইড আতা ভাইকে সুধালাম, আর কতদুর ? উনি আশার বাণী শোনালেন। বললেন, আর ২৫ থেকে ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে। তারপরই আমাদের মঞ্জিলে মকসুদ ।
আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবং সুযোগসুবিধা মত থেমে দু একটা ছবি। পথে মরে পড়ে থাকা অনেক কাঠের গাছ, প্রচুর পরিমানে মরে যাওয়া বাঁশ পড়ে থাকতে দেখে আতাভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, এগুলি কেউ নেয় না ? উনি বললেন, না নেয় না কারন এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এত বিপুল পরিমান কাঠ বা বাঁশ নেবার কোন উপায় কারও নেই, তাই সরকারীভাবে শুধু বর্ষাকালে ঝিরিপথে যখন পানি বেড়ে যায় তখন নিলামে এই কাঠ ও বাঁশ বিক্রি হয়। ক্রেতা পানি দিয়ে ভাসিয়ে এগুলি বন থেকে বের করে নিয়ে যায়।
হঠাৎই পানির আওয়াজ কানে আসলো। বুঝে গেলাম আমাদের গন্তব্য হামহাম অতীব সন্নিকটে। একটা মোড় পার হবার পরই চোখের সামনে ভেসে উঠল হামহামের জীবন্ত ছবি ! একটা পাথুরে খাড়া ঢাল বেয়ে পানির শ্রোতধারা গড়িয়ে নিচে পড়ছে ! পানি যেখানে পড়ছে সেখানে ছোট একটা পুকুরের সৃষ্টি হয়েছে। শীতকাল হওয়ায় পানি অনেক কম। বুঝলাম এই ঝরনার আসল রূপ দেখতে চাইলে আমাকে আবার বর্ষায় বা বর্ষার পর পানির সিজনে আসতে হবে। যদিও এখনকার মত সহজ হবে না তখনকার আসা। আতাভাইও আমার মত সমর্থন করলেন।
চারিদিক তাকিয়ে প্রকৃতির অসাধারন রূপ দেখে নিজেকে প্রকৃতির সন্তান ভাবতে ভালই লাগছিলো। হঠাৎই চারিদিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো, শহুরে শিক্ষিত আমাদের বিবেচনাবোধ দেখে। চারিদিকে হেন ময়লা নেই যা সেখানে পড়ে নেই। কোকের খালি ক্যান, পানির খালি বোতল, বিস্কুট-চিপসের খালি প্যাকেট, সুইংগামের খোসা, সিগারেটের প্যাকেট কি নেই সেখানে। সেগুলি যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মনে পড়ে গেলো আসার পথেও এই একই দ্রব্যগুলি যত্রতত্র বিপুল পরিমানে পড়ে ছিলো।
এক কিশোর সেখানে চা-বিস্কুটের দোকান খুলে বসেছে পর্যটকদের প্রয়োজনে, বলাবাহুল্য তা অবশ্যই পরিবেশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। তার দেখাদেখি আরও কয়েকটা দোকানও নির্মানাধীন। সবগুলিই সেখানের প্রাকৃতিক পরিবেশটাকে বিনষ্ট করে। তদুপরিও বাঙ্গালীর ব্যাবসায়িক বুদ্ধির তারিফ করতেই হয় ! আমরাই আজকের দিনের প্রথম পর্যটকগ্রুপ , সেই কিশোর আমাদের পূর্বেই এখানে এসেছে এবং দোকান খুলে বসেছে। সে বিকেলের দিকে পর্যটকরা চলে গেলে দোকান গুটিয়ে কলাবন ফিরে আসে।
চারদিকের সুনশান নীরবতা পুরোটাই উপভোগ করেছিলাম, ঝমঝম করে পড়া পানির আওয়াজ তখন ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিকের মত লাগছিলো। আতাভাই জানালেন ঝর্ণার উৎসে বিএসএফ এর ক্যাম্প থাকায় তারা পানি আটকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যাবহার করে, তাই শীতে খুবই কম পানি আসে। আসার পথে ঝিরিপথে কোন মাছ চোখে পড়লো না কেন, তা জানতে চাইলাম উনার কাছে ? উত্তরে উনি একটা ভয়ানক তথ্য দিলেন। বললেন, সীমান্তবর্তী স্থান হওয়ায় অনেক গরীব বাংলাদেশী এই ঝিরিতে মাছ ধরতে আসে, ভারতীয় বাহিনী বিএসএফ এই মাছধরা বন্ধ করার জন্য কয়েক মাস আগে ঝর্ণার উৎসে বিষ প্রয়োগ করে, ফলশ্রুতিতে ঝিরির ছোটছোট মাছগুলি সমূলে মারা গিয়েছে। তথ্যটি জেনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তথ্যটি কতটুকু সত্য তা যাচাই করার ক্ষমতা না থাকায় মনখারাপ করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার রইলো না।
আমরা একঘন্টামত ছিলাম ঝর্ণার পাদদেশে। তারপর পূর্বের পথ ধরে আবার ফিরে যাওয়ার পথ ধরলাম। অর্ধেক পথ পাড়ি দেবার পর প্রায় ১৫ জনের এক অভিযাত্রী গ্রুপের মুখোমুখি হলাম। নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে কিছু উপদেশ দিয়ে নিজেদের পথে এগিয়ে গেলাম। পথে আরও ছোটখাট কয়েকটি দলের সাথে দেখা হলো।
রাতে এখানে থাকা যাবে কিনা জানতে চাইলাম আমাদের গাইড এর কাছে। তিনি বললেন রাতে থাকাটা বিপদজনক। কারন সীমান্তবর্তী হওয়ায় রাতে আলো জ্বললে আলোর উৎসে গুলি করে বসতে পারে বিএসএফ জঙ্গীগ্রুপ ভেবে। তাছাড়া পাহাড়ী ভাল্লুক ও গেছো বাঘ এর আক্রমনের মুখে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদিও এরা বনের গভীরে থাকে। মানুষের চলার পথ পারতে মাড়ায় না।
অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা যাবার সময়ের চাইতে কম সময়ে কলাবনের যেখানে আমাদের মোটর সাইকেল চালক লোকমান ভাই অপেক্ষা করছিলো সেখানে ফিরে আসলাম।
আতাভাই এর পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লোকমান ভাইয়ের গাড়ীতে চড়ে আমরা হীডের রেষ্টহাউজে যখন ফিরে আসলাম তখন বিকেল ৪ টা।
১ম পর্বের লিংক Click This Link