পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)-এর কর্মকর্তা মাহফুজ দম্পতি নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর দেশের মানুষ হকচকিয়ে যায়। একসঙ্গে নড়েচড়ে ওঠে পুলিশ, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ। নেশার ছোবল দেশের তারুণ্যকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে- এ দুর্ভাবনায় অাঁতকে ওঠে সবাই। আসলে সর্বনাশ যখন তার সবকটি বিষদাঁত একসঙ্গে প্রকাশ করে তখনই আমাদের কানে পানি যায়। এর আগ পর্যন্ত কোনো বিষয়ই কেউ গায়ে লাগাতে চাই না। রাজধানীর চামেলীবাগে এক তরুণী আপন মা-বাবাকে এভাবে হত্যার আগ পর্যন্ত বিষয়টি এত প্রকটভাবে সামনে আসেনি। এখন বিষয়টি সামনেও আসছে, সবাই মুখও খুলতে শুরু করেছেন। নেশায় ডুবন্ত বর্তমান তারুণ্যের দুর্দশা নিয়ে অনেক কথাই উঠছে।
নতুন নতুন নেশার ছোবলে দেশের তরুণ সমাজের মাঝে কত মারাত্মক ক্ষয় ও বিকৃতি নেমে এসেছে, চামেলীবাগের ঘটনা তার একটি বড় উদাহরণ। এ দেশের কোনো তরুণ বা তরুণী আপন মা-বাবাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ধারালো অস্ত্রে আঘাত করে করে হত্যা করতে পারে- এটা ছিল কল্পনারও অতীত। ইয়াবার নেশায় আক্রান্ত তরুণী তার মা-বাবাকে হত্যার পর সে অকল্পনীয় বিষয়টিই আতংকজনক বাস্তবে পরিণত হয়েছে। সবাই বুঝে নিয়েছেন, হ্যাঁ, এটা হতে পারে। কেবল নেশা আর উদ্দাম তারুণ্যের বাঁধা দূর করার জন্যও তরুণ সন্তান তার মা-বাবাকে হত্যা করতে পারে। এটা আর এ দেশে অকল্পনীয় ও অসম্ভব কোনো বিষয় নয়।
সমাজের সুরক্ষিত বলয়ে যারা বাস করেন তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে অন্যদের মাঝে এক ধরনের মুগ্ধতার অনুভূতি কাজ করে। অন্যেরা ধরেই নিয়ে থাকে যে সুরক্ষিতরা বেশ নিরাপদেই থাকেন। বিশেষত আইনশৃংখলার ব্যাপক অবনতি, অপরাধী ও ভুক্তভোগী উভয়ের রাজনীতিকীকরণ এবং আইনের মুখচেনা প্রয়োগ দেখে দেখে সাধারণ মানুষ ক্লান্ত। নিরাপত্তাহীনতার পাতলা চাদরে সবাই নিজেদের ঢেকে রাখতে বাধ্য হয়ে গেছেন। এরকম একটি অবস্থায় আপন সন্তানের হাতে পুলিশ কর্মকর্তার সস্ত্রীক খুন হওয়ায় সব শ্রেণীর নাগরিকদের মাঝে আরও বড় আতংক ভর করেছে। তারা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, এখানে কেউ আর নিরাপদ নেই। এ সমাজে সুরক্ষিতরাও অরক্ষিত।
নেশার উপকরণ ও প্রাপ্যতা এ দেশে নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু এ সবের ব্যাপক বিস্তার ও সহজলভ্যতা সাম্প্রতিক কালের বড় ঘটনা। কেবল দরিদ্র বা পিছিয়ে পড়া সমাজের লোকেরাই নয়, নেশার বড় ভোক্তা এখন বিত্তবান, সচ্ছল ও আপাত সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারের তরুণ-তরুণীরা। কোনো তরুণ বা তরুণী নেশায় ডুবে গেলে পরিবারের কর্তারা এতদিন কেবল এই হা-হুতাশটাই করতেন যে, ওর জীবনটা শেষ হয়ে গেল। ওকে আর রক্ষা করা গেল না। কিন্তু নেশাগ্রস্ত তারুণ্য যে শুধু নিজে নয়, পরিবারের এমনকি মা-বাবার জন্যও হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে, এ ঘটনা সেই আতংকেরই ঝাঁকুনি দিয়ে গেল।
মা-বাবা হত্যাকারী তরুণীর পেছনে প্রতি মাসে হাতখরচ জোগানো হতো প্রায় লাখ টাকা। পত্র-পত্রিকায় প্রসঙ্গটি এভাবেই এসেছে। এখানে এ প্রশ্নটিও উঠেছে, একজন পুলিশ কর্মকর্তার মাসিক আয় কত থাকলে এত পরিমাণ হাতখরচ সন্তানকে দেওয়া সম্ভব হতো? এতে কি কোনো গভীর অবক্ষয়ের আলামত নেই? এরকম একটি অবক্ষয়ের হাত ধরাধরি করেই কি অন্যান্য আরো নগদ বিপর্যয়কর অবক্ষয় সামনে চলে এসেছে? এ অবস্থা কি কেবল নিহত ওই কর্মকর্তার একার, না সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে এ রকম লাখ লাখ কর্মকর্তা বাস করছেন? আয়-উপার্জন ও সততার এই কেন্দ্রটিতে এতবড় অবক্ষয় সযত্নে লালিত হতে থাকলে সমাজে কি এর বহুমুখি কুফল পড়ার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায়?
মাদক নির্মূলে পুলিশের ভূমিকা বড়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুলিশের কর্মতৎপরতা আগাগোড়াই প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ আজ শ্রেণীগতভাবে পুলিশই হয়েছে এর করুণ শিকার। সমাজের অন্যান্য অঙ্গনে দায়-দায়িত্বের প্রশ্নটি যাদের সঙ্গে জড়িত, তাদেরও বড় অংশটি অন্য কোনো আগ্রহে যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে এটা কি অসম্ভব যে, সেসব ক্ষেত্রের বিপর্যয় থেকেও তারা রক্ষা পাবেন না? খাদ্য, পরিবহন, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তাসহ সব ক্ষেত্রেই তো এ রকম বিপর্যয় ঘটতে পারে। কারণ, সেসব খাতেও দায়-দায়িত্বের বিষয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ও অভিযোগের আলোচনা রয়েছে। দায়িত্বের মূল জায়গাটায় ঢিল দিয়ে কেবল নিজের ও নিজের পরিবারের সুরক্ষার চিন্তা করলে হতে তো পারে সেই অনিয়মের বড় ধাক্কাটি এসে আমার উপরেই বড় আকারে পড়বে । তখন তো সবার ক্ষতির পাশাপাশি নিজেরও সর্বনাশ ঘটে যাবে। সুরক্ষার কোনো উপায়ই থাকবে না।
শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও সুশীল শ্রেণীর বড় আকর্ষণ ইদানীং আধুনিকতা আর ধর্মীয় অনুশাসনমুক্ত জীবনের প্রতি। খাদ্য, অভ্যাস, জীবনরীতি ও পোশাক-আশাকে ধর্মসম্মত কোনো নিয়ন্ত্রণের কথা উঠলেই তারা ‘অন্ধকার’ খুঁজে পাওয়া শুরু করেন। ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতাপূর্ণ জীবনের প্রেরণা উচ্চারিত হলেই তারা নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেন। ধর্মের বাঁধনমুক্ত সেকুলার একটি প্রজন্ম গড়তে উঁচু স্বরে শ্লোগান তুলেন। কিন্তু চামেলীবাগের ঘটনার পর তরুণদের সামনে তারা কোন্ জীবনের দীক্ষা পেশ করবেন-এখন আর বুঝে উঠতে পারছেন না। তাদের বাতলানো পথে চলতে গিয়েই তো এখনকার তারুণ্যের বিরাট একটি অংশই ‘ইয়াবা প্রজন্মে’ পরিণত হয়েছে। নেশায় নেশায় কান্ডজ্ঞান হারানো এই তারুণ্যের ছুরির কোপ যে কখন কোনদিকে যাবে আজ কেউ বলতে পারে না।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে পুলিশ দম্পতির নৃশংস হত্যার আরো কিছু সন্দেহজনক কারণের ইঙ্গিত দেওয়া হলেও এটা মোটামুটি পরিষ্কার যে, তরুণী কন্যাই তাদের হত্যা করেছে। অথবা হত্যার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে। হত্যার ১০ দিন পর গত ২৪ আগস্ট আদালতে ১৬৪ ধারায় সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। কিন্তু এ হত্যাকান্ডের ঘটনাটি নিয়ে তরুণীটির ভেঙ্গে পড়া কিংবা অনুতাপ প্রকাশের কোনো খবর এখনও পাওয়া যায়নি। নেশাগ্রস্ততা কিংবা জেদের ঘোর নয়, পুলিশি হেফাজতে স্বাভাবিক অবস্থাতেও হত্যাকান্ডের বিষয়ে সে এক রকম নির্লিপ্ততা ও অনমনীয়তাই প্রকাশ করে গেছে। তার উদ্দাম ও উচ্ছৃংখলতাপূর্ণ জীবনে বাবা-মায়ের বাধাদানের বিষয়টিকেই সে বড় করে তুলে ধরেছে।
তরুণীর চরিত্রের এ বিষয়টি সামনে রাখলে বোঝা যায়, বেদনাদায়ক এ ঘটনাটির পেছনে একযোগে কাজ করেছে ইয়াবার নেশা, তথাকথিত আধুনিক উচ্ছৃংখল জীবনের টান, ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মুক্তি, অবৈধ অর্থের উত্তাপ আর সর্বনাশা স্বাধীনতার