-স্যার কি একাই এসেছেন?
-কেন? অন্য আর কারো কি সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা ছিল?
-না স্যার,আপনার পি এস বা এমন কেউ?
-না,আমি একাই এসেছি।
-সরি স্যার,এমনি জানতে চাইলাম।
-আচ্ছা আপনাদের শো শুরু হবে কখন?
-স্যার,আধঘন্টা পরেই হবে,এর মধ্যে আমরা আপনাকে হালকা মেকআপ আর কিছু ডিরেকশন দিয়ে দিব।
-আচ্ছা প্রোগ্রাম শুরু করার আগে আমি আপনাদের কিছু বলতে চাই।
-বলুন,স্যার।
-দয়া করে আপনারা আমাকে স্যার ডাকবেন না, এমনকি পোগ্রামের সময়ও না।
-তাহলে কি বলব,স্যার।
-আমাকে ভাই ডাকবেন।
-স্যার,এটা আমাদের প্রোগ্রামের টেডিশান।একজন সম্মানিত লোকের সাক্ষাৎকার নেবো অথচ তাকে ভাইয়া ডাকব।স্যার,এটা আমাদের পোগ্রামের নীতিমালা বিরোধী।তাছাড়া আমাদের পোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য গুনীজন ও সফলজনদের সম্মান দেওয়া এবং এই উদ্দেশ্যেই আমাদের এই পোগ্রামের আয়োজন।
-যার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তিনি যেহেতু চাচ্ছেন না,তারপরও আপনারা এটা কিভাবে করেন? দেখুন,স্যার ডাকলে আমি পোগ্রামে সাক্ষাৎকার দেবো না।
-সরি স্যার,আমি একটু আমাদের নির্দেশক স্যারের সাথে কথা বলে দেখি।
-সুপ্রিয় দর্শকমন্ডলি, ডিটিভি পক্ষ থেকে আপনাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।আমন্ত্রণ জানাচ্ছি,আমাদের সাপ্তাহিক আয়োজন ’সফলদের ইতিকথা’ অনুষ্ঠানে। আজ আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন এমন একজন সফল ব্যাক্তি,যিনি নিজের প্রচেষ্টা,সততা আর নিষ্ঠার বলে নিজেকে নিয়ে গেছেন সফলতার শিখরে।আপনারা প্রায় সবাই উনাকে চিনেন।যিনি একাধারে স্থাপন করেছেন অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান যেখানে কর্মরত আছে এদেশের হাজার হাজার যুবক যুবতী,কয়েকটি হসপিটাল যেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ, প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষা প্রসারে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।আমরা আপনাদের আজকের অতিথির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি,তিনি হলেনঃ বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজ সেবক, কালাম হাজারী।
কিছুটা মাথা নেড়ে কালাম হাজারী তার পরিচয়ের সত্যতা নিশ্চিত করলেন।
-সুপ্রিয় দর্শক মন্ডলি,আমরা একটা ছোট্ট বিরতিতে যাচ্ছি।আপনারা কোথাও যাবেন না,আমাদের সাথে থাকুন।
-সুপ্রিয় দর্শক মন্ডলি,আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।প্রিয় দর্শকমন্ডলি,আপনারা নিশ্চয়ই জানেন,সফল মানুষরা সবসময়ই বিনয়ী হোন।আমাদের অতিথির অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমরা উনাকে স্যার না ডাকে ভাইয়া বলেই ডাকব।ভাইয়া(কিছুটা ইতস্ততার নিয়ে) প্রথমেই আপনার পরিবার সম্বন্ধে জানতে চাইব।
-আমার এক ছেলে,এক মেয়ে।ছেলে থাকে আমেরিকা, সেখানে সে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে,ছেলের বউও ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাদের ঘরে একটা মেয়ে সন্তান আছে,এখনও ছোট।আর মেয়ে থাকে অষ্ট্রেলিয়া,সে একজন ডাক্তার তার হাজবেন্ডও ডাক্তার,তাদের ঘরেও একটি মেয়ে সন্তান আছে, শুনেছি প্লে-শ্রেণিতে পড়ে।আর আমার স্ত্রীর সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে পাঁচ বছর হলো,সে মেয়ের সাথে অস্ট্রেলিয়াই থাকে।
-ভাইয়া,আপনার শৈশব সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই।
-সবতো আর মনে নেই।তখন ১৯৭৩ সাল,আমার বাবা ছিলেন একজন দিনমুজুর।কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী কাজের এত সংকট দেখা দেয়, বাবা কোন কাজই সহজে জোগাতে পারতেন না,দু’একটা কাজ পেলেও টাকা পেতেন না ঠিক মত।আমার বয়স তখন ১৬ থেকে ১৭ বছর হবে।আমি সারাদিন বন্ধুদের সাথে তাস খেলতাম,আড্ডা দিতাম।বেশিরভাগ দিনই বাবা তিনসদস্যের তিনবেলা খাবার জোগাতে পারতেন না।আর সংসারের প্রতি আমার এ ধরণের অবহেলা বাবাকে একেবারেই খিটখিটে করে তুলেছিল।প্রায়ই ঘুমানোর আগে মাকে বলতেন ও আসলে যেন কিছুতেই খাবার না দেয়।অথচ তিনি নিজেই হয়তো না খেয়ে শুয়ে গেছেন। মা হয়তো দু’ একটা টাকা থাকলে বা কারো কাছ থেকে খুজে ভাত না পেলেও মুড়ি মিঠাই যেকোন একটা কিছুর ব্যবস্থা করে আমার জন্য রেখে দিতেন।আমি হয়তো এগারোটা,বারোটার দিকে ঘরে আসতাম।কিন্তু ওতটুকুন খাবার কি কোনভাবে পেট ভরতো আবার তার উপর পকেট খরচ।বাবার কাছে খরচের কথা বললেই লাঠি নিয়ে আসত।তাই বন্ধুরা মিলে একদিন তালুকদারের বাড়িতে চুরি করি।কথাটা কিভাবে সবার কাছে পৌঁছে যায়।কিন্তু কোন প্রমাণ না থাকায় তারা আমাদের কিছু করতে পারেনি।কিন্তু বাবা আমায় এমন মারা মারলেন।আসলে বাবার প্রকৃতি ছিল ভাঙবে কিন্তু মচকাবেনা।সত্যিই বাবা ভেঙ্গে গেছেন কিন্তু অসৎ পথে কখনও যাননি।
বলতে বলতে কালাম হাজারীর দু’চোখ পানিতে ভেসে গেল। উপস্থাপিকাও নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেন।
-তারপর কি হল?
-কি আর হবে? বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম। চলে আসলাম ঢাকা শহরে।
-আর যান নি?
-না,আর কখনও যাইনি।
উপস্থাপিকার মুখবয়বে কিছুটা তাচ্ছিল্লের রেশ ফুটে উঠল।
-আবারো ছোট একটা বিরতি,কোথাও যাবেন না।
-আবারো ফিরে আসলাম,আমাদের সফল একজন মানুষের জীবন কথা শুনতে।
-আচ্ছা,আপনি এ পর্যন্ত কয়টা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন।
-আমি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠা করেছি ৫০টার মত,সিমেন্ট কারখানা ১টা,১টা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি,২টা অটোমোবাইল কারখানা,৫টি হসপিটাল,১টি ব্যাংক ও ১টি বিশ্ববিদ্যালয়।
-আপনি বিয়ে করেছেন কখন?
-১৯৮৩ সালের দিকে।
-ভাবীকে এখন মিস করেন না?
-আপনারা এসব কি প্রশ্ন করছেন?আনছেন আমি কিভাবে সফল হলাম জানার জন্য আর এখন সেসব বিষয় প্রশ্ন না করে কিসব প্রশ্ন করছেন? আপনি আর দয়া করে প্রশ্ন করবেন না,আমি আমার পুরো ইতিহাসটা বলে যাচ্ছি।
বি.দ্রঃ..........
ঢাকা এসে আমি প্রায় দুইদিন না খেয়ে ছিলাম।রাতে কমলাপুর ষ্টেশনে ঘুমাতাম।দেখলাম কিছু ছেলে রাতে ট্রেন আসলে অনেকের বেগ মাথা নিয়ে যায়,এর বিনিময়ে কিছু টাকাও পায়।আমিও শুরু করলাম,কিন্তু আটানা,চারআনা আমার পোষাতো না।তাই একদিন সুযোগ বুঝে একটা বেগ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাই।কিন্তু দুর্ভাগ্য পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাই।জেলে পরিচয় হয় এক জাদরেল লোকের সাথে।তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার ভাই হিসাবে পরিচয় দিতেন।কিন্তু এই বিষয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না।তবে তিনি তার সাথে আমারও জামিনের ব্যবস্থা করলেন।ঢাকাতে তখন ব্যাপক অস্থিরতা।তিনি বললেন,ব্যাংক ডাকাতি করবেন।আমার যেহেতু গোলাগুলির অভিজ্ঞতা নেই,আমার কাজ ছিল বাইরে।উনি আর উনার দুই বন্ধু মিলে মূল কাজটা করেন,ভাল পরিমাণ টাকা নিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন।কিন্তু আমাদের আস্থানা পুলিশ হানা দিলে তারা তিনজনই গোলাগুলিতে মারা যায় আর আমি এই সুযোগে টাকাগুলো সরিয়ে পেলি।পরে অবশ্য পুলিশ আমাকে ধরলেও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ী তারা আমাকে দেখেনি, ফলে আদালতে আমাকে বেকুশুর খালাস দেয়।সেই আমার পথ চলা।আবুল কালাম থেকে আমি হয়ে গেলাম, কালাম হাজারী। এমন কোন কাজ নেই যা আমি করিনি,চোরাচালান থেকে নারী প্রাচার। কত সম্পত্তি যে আমার দেশে আর দেশের বাইরে আছে তার কোন ইয়ত্তা ছিলনা।কিন্তু আমি সারারাত কাটাতাম মদপান করে।ছেলে মেয়েরা মাঝে মধ্যে ফোন করে,ব্যস, সব চাওয়া পাওয়া ওখানে মিলিয়ে যায়।মাঝে মধ্যে আমি আমেরিকায়,অষ্ট্রেলিয়া গেলে তাদের সাক্ষাৎ পাই। জীবনে এর চেয়ে বেশি কিছু যে আমি পেতে পারি না।
আজকের এই সাক্ষাৎকার দেওয়ার সপ্তাহখানেক আগে আমি গাড়ি করে অফিসে যাচ্ছিলাম।ব্যাপক জ্যামের মধ্যে গাড়িতে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম।পত্রিকার পড়ার ফাকে একটু সামনে তাকাতে দেখি একজন বয়োবৃদ্ধ মহিলা একজন লোকের পা ধরে আছে।কিছুতেই ছাড়ছেনা,গাড়ির ভেতর থেকে দেখা ছাড়া আর কিছুই শুনতে পারছিলাম না।বেশ কিছুক্ষন লোকটা পা'টা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এমন ঝাটকা মারল, মহিলা প্রায় দুইহাত দূরে গিয়ে পড়ে এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।কয়েকজন বিভিন্ন দিক থেকে দৌঁড়ে আসে।ভাবতে ছিলাম, এই দৌঁড়ে আসা লোকগুলো আছে বলে মনে হয় আমাদের পৃথিবীটা এখনও টিকে আছে।কিন্তু কি এক অস্থিরতা আমাকেও পেয়ে বসে।আমি গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে পড়লাম। ড্রাইভার বলল,স্যার সিগনাল এখনই ছাড়তে পারে।বললাম,সমস্যা নাই, গাড়িটাকে পাশ করে রেখে দাও। লোকজনের ভিড় ঠেলে ভিতরে ডুকে পড়লাম।লোকটার ঝাটকাতে কয়েকটা জায়গা থেঁতলে গেছে,রক্ত ঝরছে সেসব জায়গা থেকে।মনে হল,আমার দুনিয়ার পুরো জীবনটাই বৃথা,এইতো আমার জনম দুঃখী মা।মোবাইলে ড্রাইভারকে ডেকে এনে মাকে নিয়ে গেলাম হসপিটালে।ঘন্টাখানেক পরে মায়ের জ্ঞান ফিরে।যেন চির অচেনা এক ব্যাক্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে।বলল,বাবা তুমি কে? আর আমি এখানে কেন? বুঝতেছিলাম,তার দৃষ্টি শক্তি অনেক কমে গেছে।তার পাশে বসে বললাম,মা তুমি কয়দিন না খেয়ে আছ? বলল,গতকাল থেকে কিছু খাইনি।বললাম,তুমি ঢাকা কেন? বলল, আমার এক বোন ঝি গার্মেন্টে-এ চাকরি করে, সে আমাকে ঢাকা নিয়ে এসেছে।সকালে সে গার্মেন্টে যাওয়ার সময় আমাকে ঐখানে নামিয়ে দিয়ে যায়,সন্ধ্যায় সময় নিয়ে যায়।কালকে সন্ধ্যার সময় সে আসেনি।তাই ক্ষুধায় আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি।মায়ের সামনে বসে অঝোর ধারায় কেঁদে চলছিলাম।মা বলল,তুমি এত কাঁদছ কেন? আমার এখন মোটামুটি ভাল লাগছে। তুমি মনে হয় আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ, বাবা তোমার জন্য দোয়া করি।আমার বোন ঝি জাপানের বস্তিতে থাকে,যদি তাকে কষ্ট করে একটু খবর দিতে, সে এসে আমাকে নিয়ে যেত।জিজ্ঞেস করলাম, মা তোমার না একটা ছেলে ছিল আবুল কালাম,সে কোথায়? মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন,আঁচল দিয়ে মুখ ডাকলেন।বললেন,বাবা তুমি তাকে কিভাবে চিন? ছেলেটা আমার, আমাদের ওপর অভিমান করে কোথায় যে চলে গেল? তার বাবা সে শোকে দু’বছরের মাথায় কাঁদতে কাঁদতে মারা গেলেন।আমি কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,মা আমি তোমার আবুল কালাম। মা আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার মুখ,শরীর হাত দিয়ে বুলাতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন,হ্যাঁ,সে মুখ, সে নাক, সে চোখ । হ্যাঁ, তুমি আমার আবুল কালাম। মা আবারও আমাকে জড়িয়ে ধরলেন,আর চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,মাবুদ তুমি সত্যি মায়ের কান্না শোন।
কান্না বিজড়িত কালাম হাজারী চোখের পানি, নাকের পানি মুছতে মুছতে বললেন,গত সপ্তাহে আমি আমার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ওয়াকফ করে দিয়েছি।তাই আজ আমি নিঃস্ব হলেও সুখী।আমার শরীরে এখনও পর্যাপ্ত পরিশ্রম করার সামর্থ আছে, গ্রামে ফিরে গিয়ে নিজে পরিশ্রম করে মাকে নিয়ে বাকী জীবন কাটিয়ে দিব।এই বলে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে আসলেন।সবার চোখে পানি কিন্তু এগিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ এগিয়ে এলেন না।
হয়তো এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা,আমরা দৃশ্যমান সফলতাকে সব মনে করি,অদৃশ্য স্বার্থকতা আমাদের কাছে মূল্যহীন।
বি.দ্রঃ কালাম হাজারী যখন উপস্থাপিকার প্রশ্ন করা বন্ধ করে নিজের ইতিহাস বলা আরম্ভ করলেন,তখনই অনুষ্ঠান নির্দেশকের নির্দেশক্রমে অনুষ্ঠানটির সম্প্রচার যান্ত্রিক গোলযোগ দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।যা আবুল কালাম বুঝতে পারেনি,আর তাতে আবুল কালামের কিছু যায় আসে না। কারন সকল যশ,খ্যাতি,অর্থকে সে পা দিয়ে মাড়িয়ে প্রকৃত স্বার্থকতার পথে চলে গেছেন।
ছবিসূত্রঃ-নেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৩:২২