কলিংবেল বেজেই চলছে।আমি বিছানা শুয়ে আছি।মোবাইলটাও বেজে উঠল। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করলাম।তোর সমস্যা কী? এতক্ষণ কলিংবেল বাজাচ্ছি,অথচ দরজা খুলছিস না,ঐপাশ থেকে আমার বন্ধু আসাদ আমাকে ধমক দিয়ে বলল।দাঁড়া আসছি,বলে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম।"কি ব্যাপার? ঘুমাচ্ছিলি, না বাতরুমে ছিলি? দরজা খুলছিস না? দেখে তো মনে হচ্ছে, ঘুমাচ্ছিলিও না,বাতরুমে থেকেও আসছ নাই।" "আসলে একটা রহস্য উপন্যাস পড়েছিতো, এখনও সে ঘোরেই আছি।রহস্য উপন্যাসে এত চমৎকার ঈঙ্গিত থাকে আগে দেখিনি। দেখলাম, মানুষ সারাদিন উপদেশ শুনে,অথচ তাকে দেখলে মনে হয় সে কিছু শুনছেই না।কলিংবেলটা আমার কাছে সে উপদেশের মতই মনে হল,বাজছে অথচ আমি কিছুই শুনছি না ।" "রাখ তোর উপন্যাস, বাস্তব রহস্য আমি তোকে দেখাব।আমার একটা চাকরি হয়েছে শুনেছিস।" "হু, ফেইসবুকে তোর স্ট্যাটাস থেকে জানলাম।তাইতো তোকে মিষ্টি খাওয়ানোর নিয়ত করেছি।" "ঠাট্টা করছিস,তবে চাকরিটা তৃতীয় শ্রেণীর হলেও আমি শুনেছি চাকরিটাতে মোটামুটি সম্মান ও পাওয়ার আছে।" "হু, স্ট্যাটাস দেস সব প্রথম শ্রেণীর আর চাকুরী করবি তৃতীয় শ্রেণীর।" "কি করব বল, প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণিতেতো অনেক ভাইবা দিলাম, কোথায়তো কিছু হল না।তবে এই চাকরিটাওতো হতো না, এক রহস্যময় ব্যক্তির বদৌলতে এটা হয়ে গেল।আমি তোকে তার কাছে নিয়ে যাব, তুই তার উপর একটা প্রতিবেদন তৈরী করে তোদের পত্রিকায় ছাপাস।" "কে এই মহান ব্যক্তি?শুধু মহান না,বলা যায় রহস্যে ঠাসা।" "বস,চা বানিয়ে নিয়ে আসি,চা খেতে খেতে শুনব"। "চা না, থাকলে একটা সিগারেট দেয়,ধরাই"।"ড্রয়ারে আছে,নে’,আমি একটু ওয়াস রুম থেকে আসি।"
-এই যে চাকরিটা হল,এর আগে এই চাকরিটার ভাইবা দিয়ে আমি বাড়ি গেলাম।যাবার পথে আমার সাথে রমজান পাগলার সাথে দেখা।দেখে আমার কেমন যেন মায়া হল।আমার হাতে কমলার একটা প্যাকেট ছিল।আমি বললাম, রমজান ভাই কেমন আছেন?এই কথা বলতেই উপরের দিকে তাকাল।আমি বললাম কমলা খাবা,আবারও উপরের দিকে তাকাল।তারপর আমি প্যাকেট থেকে দুইটা কমলা বের করে দিলাম।সে আমাকে বলল,অনেক দিন তো চেষ্টা করেও তোমার কোন চাকরি হচ্ছে না।এবার তোমার চাকরিটা যেন হয়, সে জন্য আমি ডি ও জি সাহেবকে বলব।
-এই ডি ও জি সাহেবটা কে?
-আরে আমিওতো জানি না।এর আগেও বেশ কয়েকজনকে সে এই ডি ও জি সাহেবের কথা বলেছেন।এর মধ্যে যাদের উপকারের কথা বলেছে, তারা সত্যিই সত্যিই সে উপকার পেয়েছে।আর যাদের ক্ষতির কথা বলেছে,তাদের ক্ষতি হয়েছে, এমনকি রক্তবমি করে একজন মারাও গেছে।সবাই তাকে পাগল বলেই জানে কিন্তু কেউ কেউ আবার বলে সে জীন সাধনা করে এসব করে আর চেয়ারম্যান সাহেবের বক্তব্য সে রাক্ষস।
-সে থাকে কোথায়?
-আমাদের গ্রামে একটি বিশাল জঙ্গল আছে।তার দক্ষিণ দিকে একটি ড্যারা ঘরে থাকে।ঐ দিকে মানুষজন খুব একটা যায়না।
-তার অতীত ইতিহাস কিছু জানিস?
-হু, তার মা ছিল এক কাঠুরিয়ার মেয়ে । কাঠুরিয়ার মেয়ে হলেও সে ছিল অপরুপ সুন্দরী।তারা জঙ্গলের ঐ দিকেই থাকত।কোথায় থেকে তারা এসে ঐ দিকে বসবাস শুরু করে এই বিষয়ে কেউ কিছু জানেনা।কাঠুরিয়া জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে চলত।একদিন কাঠুরিয়ার ঐ মেয়ে একটি বাচ্চা নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়িতে হাজির হয় এবং চেয়ারম্যানের ছেলে গোলাম আলীকে তার সন্তানের পিতা বলে দাবী করে।চেয়ারম্যানের ছেলে তা পুরোপুরি অস্বীকার যা'।আর চেয়ারম্যানের গোমস্তারা তাকে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।এই অপমানে কাঠুরিয়া মারা যায়।তারপর ঐ মেয়ে তার বাচ্চাকে নিয়ে ঐ জায়গাতেই থাকত।সেও তার বাবার মত কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে চলত।কিন্তু সে বারবার তার সন্তানের পিতৃদাবী নিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে যেত আর প্রতিবারই মার অথবা লাঞ্চনা করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হত।সে তার সন্তানের নামও রাখে রমজান আলী।রমজান মাসে জন্মে ছিল বলে রমজান আর চেয়ারম্যানের ছেলের নামের গোলাম আলী থেকে আলী নিয়ে রমজান আলী।এভাবে ছয় সাত বছর কেটে যায়।একদিন চেয়ারম্যানের ছেলেকে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় জঙ্গলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।তার পর চেয়ারম্যান তাকে ডাইনী আক্ষা দিয়ে তার লোকজনকে লাগিয়ে দেয়।শত শত লোকের সামনে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়।তারপর ঐ ছেলে কোথায় ছিল তা আর কেউ জানে না।বিশবছর পর সে আবার হাজির হয় কোথায় থেকে।সবাই বলে, সে যেন হুবুহু চেয়ারম্যানের ছেলে গোলাম আলী।কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস করে নাই।ঐ ছেলে এখন ঐ জঙ্গলে থাকে।চুলে দাড়িয়ে উসকো খুসকো সবাই তাকে পাগল বলে,তবে চেয়ারম্যানের লোকেরা বলে সে রাক্ষস।আবার কেউ কেউ বলে সে সম্ভবত জীন সাধনা করে।
-আমি অবশ্যই যাবো, কোনদিন যাওয়া যায় ঠিক কর।
-হু,আমিও চাচ্ছি তুই তার উপর একটা রিপোর্ট কর।আবার না চেয়ারম্যানের লোকেরা তার কোন ক্ষতি করে।
আমরা একদিন সকালে রওয়ানা দিলাম।বাগেরহাটে খবিসের আখড়া আসাদদের এলাকার নাম।একসময় নাকি অনেক খবিস এখানে আখড়া জমাত।তাই জায়গার নাম এরকম।পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর তিনটা বেজে গেল। আসাদ বলল, আজকে বাড়ি গিয়ে রেষ্ট নিই, কালকে সকালের দিকে আমরা ঐ দিকে যাবো।আমি বললাম না আগে আমাকে যে কাজে আসছি সে কাজ করতে হবে, তারপর রেস্ট।আমরা আর আসাদের বাড়ি না গিয়ে সোজা রমজান আলীর ড্যারার কাছে উপস্থিত হই। একেবারে জরাজীর্ণ ড্যারা যেন সামান্য বাতাসেই পড়ে যাবে।কিন্তু জঙ্গলের দিক থেকে প্রবল বাতাসেও ড্যারাটা দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে।আমরা ড্যারার দিকে অগ্রসর হতেই কোথায় থেকে এক বিশালাকার কুকুর সেখানে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল।আমি এতবড় কুকুর এবং এরকম কুচকুচে কালো কুকুর আর কখনো দেখিনি।সে কিছুতেই আমাদের ড্যারার কাছে ভিড়তে দিলনা।সন্ধ্যে হওয়ার কিছুক্ষণ আগে রমজান আলী মাথায় কতগুলো কাঠ নিয়ে হাজির হল।তাকে দেখেই আমরা তার দিকে এগিয়ে গেলাম।চুলে দাড়িতে একাকার লোকটাকে যে কেউ পাগল মনে করবে।আমাদের দেখে স্মৃত হাসি দিয়ে বললেন, এসেছেন মনে হয় অনেকক্ষণ হয়েছে।আমার পরিচয় দিতে যাব, এসময় সে বলল আমি আপনাকে চিনি।আপনি 'কালের সাক্ষীর' রিপোটার হাসান মুসাফির।এটা বলতে বলতে সে ড্যারার দিকে ডুকে পড়ল।আমরাও তার পিছন পিছন ডুকলাম।কুকুরটা এবার আর আমাদের বাধা দিলনা।ভিতরেই ডুকেই আমি থ’ হয়ে গেলাম।সেখানে কালের সাক্ষীর অনেকগুলো কপি।ডুকেই আমাদেরকে তার মাটিতে বিছানো ছাটাইতে বসতে বলল।
-আপনি এরই মধ্যে অনেকগুলো অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে দেশব্যাপী সমালোচিত হয়েছেন।আপনাকে বেশ কয়েকটা মামলাও ফেস করতে হয়েছে।আসলে এই সমাজের মানুষরা সত্যকে পছন্দ করে না।তারা মিথ্যাকে নিরাপদ মনে করে।আর ভয়ের গোলামী করে।
-আমি আপনার সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
-আসাদতো আপনাকে সবই বলেছে।
-হু,তা ঠিক।আপনার মায়ের উপর আর এখন আপনার উপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে,সবই শুনেছি।তারপরও কিছু প্রশ্ন ...
-হু,বলুন কি জানতে চান?
-আচ্ছা, আপনার এই ডি ও জি সাহেব কে?
তিনি স্মৃত হেসে আবার বাহির হলেন, এসে কুকুরটার সামনে বসলেন।
আমি বললাম,এরকম বিশাল এবং রুষ্টপুষ্ট কুকুর আমি কোনদিন দেখেনি। তিনি বললেন,সে তো তেমনই থাকবে, যেমনটি আমি থাকি।কারণ সেতো আমার অধিনস্ত।
তারপর কুকুরটি গলায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ডি ও জি সাহেব আপনি কেমন আছেন?
সাথে সাথে আমার মাথায় বিদ্যুৎ চমকে গেল।ডি ও জি তো DOG, মানে কুকুর। কি অবাক করা বিষয়, কুকুরটি মুখ উপরের দিকে তুলে আ...উ বলে ডাক দিল।আমার মনে হল সে বলছে, সকল প্রশংসা তার, যিনি আমাকে এ অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন এবং ভাল রেখেছেন।
আমি আর সেখানে অবস্থান না করে ঢাকার দিকে ফিরে আসি।আসাদও বাড়ি না গিয়ে আমার সাথে ঢাকার দিকে রওনা দেয়।সারাদিনের ক্লান্তির ফলে দু’জনে পুরো পথ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই।সকালেই বাসায় পৌঁছে যাই।আসাদ আমাকে প্রশ্ন করল,উনাকে নিয়ে রির্পোট করব না।আমি বললাম, না।উনাকে উনার মতো থাকতে দেয়।সমাজের কিছু দুষ্ট লোকদের ভয় দেখানোর জন্য এধরণের কিছু পাগল থাকা দরকার আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৩:০১