বগালেক
কেওক্রাডং যাওয়ার পথে
অবশেষে কেওক্রাডং জয়
পৃথিবীতে রহস্যের কোন শেষ নেই। অনেক রহস্যের যেমন উদ্ঘাটন হয়েছে আবার এমন অনেক রহস্য রয়েছে যেগুলোর কোনো কুলকিনারা তাবৎ দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা উদ্ঘাটন করতে পারেনি; যেমন বারমুডা ট্রাই-এঙ্গেল, সাইলেন্স অব জোন্স, ফ্লাইং সসা, ক্রপ সার্কেল। বিশ্বে ছড়িয়ে আছে আরো অনেক রহস্য যেগুলো সম্বন্ধে অনেকেই জানেনা। এ রকম এক রহস্য পাহাড়ে ঘেরা হৃদ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল বান্দরবানের রুমা উপজেলার পূর্ব দিকে কেওক্রাডং এর সন্নিকটে অবস্থিত বগাকাইন হৃদ, স্থানীয়দের কাছে তা বগালেক নামে পরিচিত।এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার স্বাদু পানির একটি হৃদ। বান্দরবান শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে কেওক্রাডং পর্বতের গা ঘেষে, রুমা উপজেলায় এটি অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৭০০ ফুট। বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিকগণের মতে বগাকাইন হৃদ মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ কিংবা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিন্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি। অনেকে আবার ভূমিধ্বসের কারণেও এটি সৃষ্টি বলে মত প্রকাশ করেন। বগালেকের পাশে একটি বম পাড়া (বগামুখপাড়া) এবং একটি মুরংপাড়া আছে। স্থানীয় উপকথা অনুযায়ী, অনেককাল আগে পাহাড়ের গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো। বম ভাষায় ড্রাগনকে বলা হয় ‘বগা’। ড্রাগন দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য স্থানীয়রা গবাদী পশু উৎসর্গ করত। আর তখন আজকের এই বগালেক ছিল সমতল ভূমি যা অনেকটা ক্ষুদ্র মালভূমির আকারে। এই ভূমিতে বাস করত তারা। দুই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা ছিলেন তাদের ধর্মীয় অভিভাবক ও নেতা। একদিন কয়েকজন দুষ্ট বৃদ্ধদের না জানিয়ে ড্রাগনটিকে হত্যা করে এবং রান্না করে খেয়ে ফেলে। ফলে রাতে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা একটি স্বপ্ন দেখেন যে তাদের পুরো জনপদ তলিয়ে দেওয়া হবে। বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা তাদেরকে এই মালভূমি ছেড়ে চলে যেতে বলেন কিন্তু তারা তাদের কথা শুনল না। এক পর্যায়ে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা ঐ এলাকা ছেড়ে চলে যান। এরপর একদিন পুরো জনপদ সহকারে মালভূমিটি তলিয়ে যায় আর সৃষ্টি হয় এই লেকের। যদিও উপকথার কোন বাস্তব প্রমাণ নেই তথাপিও এর রহস্যময় আচরণ কৌতূহলের সৃষ্টি করে। এর পাশে অবস্থিত বম পাড়ার মানুষের বিচিত্র রকম আচরণ সন্দেহের সৃষ্টি করে। পুরো জনপদে পানির উৎস কিছু ছোটখাট ঝর্ণা সেখানে সারা বছর এতে পানির উপস্থিতি এর নিজের রহস্যময়তা ফুটে উঠে।
আমরা একুশ জন বন্ধু নিয়ে কেওক্রাডং পর্বতে (যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার পর্বত) যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেই। আর বগালেককে বলা যায় কেওক্রাডং যাওয়ার বেস ক্যাম্প। বগালেকে যাওয়াটা ছিল যেমন ভয়ংকর তেমনি রমাঞ্চকর।পাহাড়ের ঢাল ঘেসে যাওয়া রাস্তাগুলো যেমন ছিল সরু তেমনি ভঙ্গুর। কিন্তু ড্রাইভারদের মনে হলো বিমান চালাচ্ছে। এই জন্য বোধ হয় গাড়িগুলোকে চাঁন্দের গাড়ি বলে। তবে বগালেকে পৌঁছে মনে হল পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে পৌঁছে গেছি। চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ এ লেকের আশপাশে রয়েছে প্রচুর কলা ও পেঁপে গাছ। বগালেকের পানির রং বিচিত্র কারণে বছরের বিভিন্ন সময়ে বদলে যায়। যা কিনা আজব মনে হয়। বগালেকে অবস্থান করার কালে যে জিনিস আমাদের সবাইকে আলোড়িত করল তা হল লেকের পাশে অবস্থানের রাতে ঘুমের মধ্যে আমরা সবাই একসাথে চিৎকার শুরু করি। কি কারণে একযোগে ঘুমের মধ্যে সবাই চিৎকার দিলাম তার কোন সুরাহা করতে পারলাম না।
পরের দিন ভোরেই আমরা কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিই।যার সাধ্যে যতটুকু সম্ভব হয়েছে তার কাঁধে ততটুকু খাবার ও পানি তুলে দেওয়া হয়েছে। সে এক দূর্বেদ্য যাত্রা।যখনই সামনে কোন বিশাল পাহাড় পড়েছে ভেবেছি এটাই কেওক্রাডং। খুশিতে গাইডকে জিজ্ঞাসা করলে সে হতাশ করত। এভাবে কত পাহাড় যে বেয়ে উপরে উঠছি আর নামছি, তার হিসাব রাখার মানাসিকতাই ছিল না।পথে অনেকবার বিশ্রাম নিতে হয়েছে। পথে অনেকগুলো ছোট ছোট ঝর্ণা এক স্বর্গীয় আমেজ এনে দিত।পথে সেনাক্যাম্প, বিজিবি ক্যাম্প গুলো নির্জনতার ভয় দূর করে দিয়েছিল। বাঙ্গালীদের বসবাস একেবারেই নেই। বেশ দূরে দূরে কিছু পাহাড়ী বসতি আছে, যাদের সাথে কথা বলে অনেক কিছু জানতে পেরেছি।অবশেষে বেলা ১২টা নাগাদ পৌঁছলাম স্বপ্নের কেওক্রাডং। নিজের আত্মবিশ্বাসে অনেক ঘাটতি থাকলেও আমি ছিলাম দ্বিতীয় জন যে কেওক্রাডং পৌঁছল।এত আনন্দ লাগছিল মনে হচ্ছিল আর এতটু হলে আকাশ ছুতে পারতাম।দুঃখের বিষয় ছিল আমদের সকল সঙ্গী সেখানে পৌঁছতে পারেনি। তাদের পথে রেখে আসতে হল। যাক অনেক মজা করে সন্ধ্যা নাগাদ বগালেকে পৌঁছি।অসাধারণ রমাঞ্চকর ভ্রমণ শেষে যখন চট্টগ্রামে পৌঁছলাম,তখন আস্তে আস্তে টের পাঁছছিলাম কি কঠিন কাজ করে পেললাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:১৯